ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২

বিদেশি টাকায় প্রকল্প, কাজ হয় না সময়মতো, এবার ৬টি বাধ্যতামূলক শর্ত দিচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ১৫ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:৩৬, ১৫ জুলাই ২০২৫

বিদেশি টাকায় প্রকল্প, কাজ হয় না সময়মতো, এবার ৬টি বাধ্যতামূলক শর্ত দিচ্ছে সরকার

ছবি:সংগৃহীত

দেশে বিদেশি সাহায্যে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়, কিন্তু কাজ শেষ হতে হতে পেরিয়ে যায় বছরকে বছর। জমি অধিগ্রহণ হয় না, দরপত্র ঝুলে থাকে, প্রকল্প পরিচালকেরই খোঁজ মেলে না! আর এই বিলম্বের মাসুল গুনতে হয় আমাদের সবাইকে—প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা চলে যায় ‘কমিটমেন্ট চার্জ’ হিসেবে। অর্থাৎ, টাকা ছিল, কিন্তু খরচ না করায় জরিমানা দিতে হলো!

এই অপচয় আর দেরি ঠেকাতে এবার কঠোর হচ্ছে সরকার। এবার থেকে যেসব প্রকল্প বিদেশি ঋণে বাস্তবায়িত হবে, সেগুলোর জন্য ঋণচুক্তি করার আগেই ৬টি শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র সম্পন্ন, প্রকল্প পরিচালকের নিয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতির কাজ।

ইতিমধ্যে এই শর্তগুলো নিয়ে একটি খসড়া প্রজ্ঞাপন তৈরি করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), যা প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের অপেক্ষায়।

তাহলে এই ৬টি শর্ত কী?
১. প্রকল্প অনুমোদন: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে DPP বা TAPP অনুমোদন নিতে হবে।
২. প্রকল্প পরিচালক ও মূল জনবল নিয়োগ: কাজ শুরুর আগেই নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে।
৩. জমি অধিগ্রহণ: পুরো জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ থাকতে হবে।
৪. পুনর্বাসন পরিকল্পনা: ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিস্তারিত পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রস্তুত থাকতে হবে।
৫. দরপত্র চূড়ান্তকরণ: দরপত্র ডকুমেন্ট, খরচ নির্ধারণ ও ঠিকাদার নির্বাচনসহ পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
6. ইউটিলিটি সরানো: বিদ্যুৎ-গ্যাস-নালা সরানোর দরকার হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে MoU সই এবং অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হবে।

পুরনো সমস্যার সমাধানে নতুন আশাবাদ
ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, পরিকল্পনার এই পরিবর্তন সময় ও অর্থ বাঁচাবে। অনেক প্রকল্পে দেখা গেছে, ঋণের সময়সীমা শেষ হয়ে যায় অথচ কাজই শুরু হয়নি! ফলে দেশে উন্নয়ন আসে না, অথচ আমরা বিদেশে টাকা পাঠাই ‘কমিটমেন্ট চার্জ’ হিসেবে।

উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা-সিলেট চার লেন মহাসড়ক প্রকল্প শুরু হয়েছে ৪ বছর আগে, অথচ এখনো অগ্রগতি মাত্র ৪.৫৫%! প্রায় পুরো পথেই জমি অধিগ্রহণ হয়নি, কাজ হচ্ছে কেবল ১৭ কিমিতে।

আরেকটি প্রকল্প, সিলেট-চরখাই-শেওলা সড়ক উন্নয়ন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে হলেও এখনো দরপত্র চূড়ান্ত হয়নি। প্রকল্প অফিসে নেই প্রকৌশলী, নেই ম্যানেজার—কার কাজ কে করবে?

বছরে কতো টাকা অপচয়?
শুধু ২০২৪ সালেই এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (ADB) ঋণের ওপর কমিটমেন্ট চার্জ হিসেবে বাংলাদেশ পরিশোধ করেছে ৩.৫৮ মিলিয়ন ডলার! অথচ এই টাকা যদি কাজে লাগত, অনেক সেতু, রাস্তা, স্কুল হয়ে যেত।

ADB জানায়, বাংলাদেশে বর্তমানে তাদের $৭.০৭ বিলিয়ন ঋণের মধ্যে $২.৩৯ বিলিয়ন এখনো খরচই হয়নি—মানে কাজই শুরু হয়নি, অথচ ঋণ চুক্তি হয়েই গেছে।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. মুস্তাফা কে মুজেরি বললেন, “প্রকল্প শুরুর আগে প্রস্তুতি না থাকলে পরে শুধু দেরিই হয় না, খরচও বাড়ে। আবার কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত দেরি করে মেয়াদ বাড়ান—যার পেছনে দুর্নীতির সুযোগও থাকে।”

তাঁর মতে, শর্তগুলো বাস্তবায়ন হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসবে, তবে মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কাগজে-কলমে সবই থাকবে।

বিদেশি ঋণ নেওয়ার পর সেটি কাজে লাগাতে না পারা শুধু একটি প্রশাসনিক ভুল নয়—এটি একটি জাতীয় ক্ষতি। সরকারের এই ৬টি শর্ত বাস্তবায়ন হলে হয়তো ভবিষ্যতে উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আর এত অভিযোগ থাকবে না। তবে, শর্ত থাকা আর বাস্তবে তা মানা—এই দুইয়ের মধ্যে যে দূরত্ব, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তথ্যসূত্রঃ https://www.tbsnews.net/bangladesh/infrastructure/govt-set-six-conditions-prevent-delays-waste-foreign-funded-projects

 
 

মারিয়া

×