ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

সংবিধানের মৌলিক সংস্কারে গণভোটের প্রস্তাব

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০০:০০, ১৬ জুলাই ২০২৫

সংবিধানের মৌলিক সংস্কারে গণভোটের প্রস্তাব

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে টানা তিনদিনের বেশি আলোচনা করেও ঐকমত্যে আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষের আসন অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন প্রস্তাবে অনড় রয়েছে বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল জানায়, কমিশনের প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর) উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হতে হবে।

তারা উভয়কক্ষের পাশাপাশি সংরক্ষিত নারী আসনেও পিআর চায়। আবার পিআর পদ্ধতি চাইলেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিরোধিতা করেছে সিপিবিসহ সমমনা কয়েকটি দল। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্তিসহ সংবিধানের মৌলিক সংস্কারে গণভোটের প্রস্তাবের পক্ষে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।
মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের ১৪তম দিনে এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আগামী রবিবার আবারও সংলাপে বসবে কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সংলাপ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আলোচনায় সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে। যদি উচ্চকক্ষ গঠিত না হয় বা উচ্চকক্ষ হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের সংশোধনের জন্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের প্রয়োজন হবে। তবে, সুনির্দিষ্ট কিছু অনুচ্ছেদ যেমন প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রের মূলনীতি, অনুচ্ছেদ ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিষয়ক ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ এবং ৫৮ঙ অনুচ্ছেদের দ্বারা সংবিধানে যুক্ত হলে তা সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে। 
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনোরকম মতভিন্নতা নেই বলে এই ব্যবস্থা পরিবর্তনে গণভোটের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্তির পর ভবিষ্যতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে। আশাকরি, আগামী সপ্তাহে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হবে। 
সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ও জোট দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সমর্থন দিয়েছে মন্তব্য করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এ মত প্রকাশ করেছে। তবে, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আজও (মঙ্গলবার) ঐকমত্য হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে ভোটের সংখ্যানুপাতে যেন উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্যদিকে আসনের সংখ্যানুপাতেও উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আছে।

যেহেতু রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো এ বিষয়ে একাধিক আলোচনার পরও ঐকমত্যের জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি, সেহেতু দল ও জোটগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার কমিশনের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট বিষয়ে নিজেদের মধ্যে, পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে আগামী সপ্তাহে একটি অবস্থানে আসবে।
ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাজের অংশীদার জানিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, যদি আমরা কোথাও ব্যর্থ হই, সেই ব্যর্থতা আমাদের সবার। কমিশনের ব্যর্থতা যদি হয়, তাহলে এটা সবার ব্যর্থতা হবে। তাই ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, সে দায়িত্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে আপনাদের। আমরা আপনাদের প্রচেষ্টার অংশীদার হয়েছে, আলাদা সত্তা হিসেবে যুক্ত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোকে এক বছর আগের পরিস্থিতি অনুধাবন করার অনুরোধ জানান তিনি।
দীর্ঘ আলোচনার পরও ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ায় কমিশন কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেটির ওপর ভিত্তি করে বিএনপি প্রতিক্রিয়া দিবে বলে জানিয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের ব্যাপারে মোটামুটি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত। কিন্তু তার গঠন প্রক্রিয়া কী রকম হবে এবং পাওয়ার ফাংশন কীভাবে হবে সেটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে। নিম্নকক্ষে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। উচ্চকক্ষ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 
তিনি বলেন, আমাদের দলের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা সেই জায়গাতেই আছি। আমাদের ৩১ দফার ভিত্তিতে আমরা যে আইডিয়া নিয়ে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে বলেছিলাম। সেটি হলো, যারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজন, যাদের জাতি গঠনে অবদান আছে এবং যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তাদের মেধা, প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার অবদান যেন জাতিগঠনের কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়। জাতি যাতে সমৃদ্ধ হয় সেই আইডিয়া থেকেই আমরা এই প্রস্তাবটি রেখেছিলাম।

সেখানে আমরা উচ্চকক্ষে ১০০টি আসন রাখার জন্য বলেছিলাম। আমরা বলেছি, বিদ্যমান নারী সংরক্ষিত আসনে যেভাবে আসনের অনুপাতে নির্ধারণ করা হয় সেভাবে উচ্চকক্ষেও হবে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হচ্ছে। কেউ চান পিআর পদ্ধতিতে। এখানে আবার পাওয়ার ফাংশনের বিষয় আছে। সাধারণ বিল কীভাবে পাস হবে, সংবিধান সংশোধন হলে উচ্চকক্ষে কীভাবে পাস হবে ইত্যাদি। আবার এখন বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজন আছে কি না সে প্রশ্নও অনেক দল তুলছে। 
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সমস্ত বিষয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন একটা সিদ্ধান্তে আসার কথা। সেই সিদ্ধান্ত জানানোর পরই আমাদের প্রতিক্রিয়া বা সম্মতি-অসম্মতির বিষয়ে জানাতে পারব। সেজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সংবিধানের সংশোধন কীভাবে হবে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি একটি অতিরিক্ত প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেটি মোটামুটি সকলেই গ্রহণ করেছে। গণভোট নিয়ে বেশকিছু মতামত আছে। সেগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আগামীতে আরো আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, অধিকাংশ দল পিআর পদ্ধতিকেই সাপোর্ট দিচ্ছে। শুধু এক লাইনে ব্যাখ্যা দিতে চাই, জনসমর্থনের দিক থেকে পাঁচটা-ছয়টা দল হলো- বিএনপি, এনসিপি, চরমোনাই পীর, সকল ইসলামী দলগুলো, গণঅধিকার পরিষদ। আমরা পিআরের পক্ষে আছি। দু’একটি দল না চাইলে কোনো প্রস্তাব আটকে যাওয়াটা অবিচার হবে, বৈষম্য হবে।

কারণ মেজরিটি তো পক্ষেই আছে। কোনো এক জায়গাতে একটা সলিউশন দিতে হবে।
ডা. মোহাম্মদ তাহের বলেন, দ্বিকক্ষ বৈশিষ্ট্য পার্লামেন্ট নতুনভাবে ইন্ট্রোডিউস করার প্রস্তাব হচ্ছে। তবে পৃথিবীতে এটা নতুন নয়, বহু দেশে এই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট আছে। কিছু সংখ্যক দল ছাড়া সকলেই আমরা একমত হয়েছি, দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট চাই। তবে কিছুটা ডিফারেন্স হচ্ছে এটা ফরমেশন বিষয় কিভাবে এটা ফর্ম করবে এবং এটার ফাংশন কি হবে? সে নিয়ে এটা কমিশনের প্রস্তাব আসছে।

এগুলো কনক্লুড করা হয়েছে। কমিশন সব শুনেছে ও বক্তব্য রেখেছে এবং কমিশন বলেছেন, আগামী রবিবার কমিশনই এ বিষয়টা চূড়ান্ত করবে। কমিশন এটা ফাইনাল সিদ্ধান্ত আকারে পেশ করবে। তিনি আরো বলেন, সংবিধান সংশোধনটাকে একটু কঠিন করে দেওয়া হোক। যাতে কোন একক দল সংবিধান সংশোধনটাকেও একটু ইচ্ছামত করতে না পারে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সকলে সেখানে ঐক্যবদ্ধ ও সংবিধান সংশোধন হয়।
নারীদের জন্য ১০০ আসনের পক্ষে একমত জামায়েত ইসলামীর এই নেতা বলেন, এ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আমাদের ডিফারেন্স আছে। নারী আসনে নারীরাই ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। এটা পিআর পদ্ধতিতে যদি হয় তাহলে এটা সহজতর হবে এবং ভোটার যারা আছে তাদের জন্য সহজ আছে। উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে না হলে যদি সংসদীয় মেম্বারের আসন সংখানুপাতিক হয়। তবে এটা তো আবার ডাবলই হলো, সেম রিপ্রেজেন্টেশন, সেম সেন্টিমেন্ট, সেম ডিসিশন। যদি সব সেম সেম হয়, তাহলে দরকার কি? 
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, নিম্নকক্ষের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হলে ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা আসবে না। এমন উচ্চকক্ষ চাই, যেখানে এক শতাংশ ভোট পাওয়া দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কার্যকর উচ্চকক্ষ থাকতে হবে। কিছু দলের মধ্যে উচ্চকক্ষকে দুর্বল করার প্রবণতা রয়েছে। আমরা সংবিধান সংশোধনে নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতা এবং কিছু কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোটের প্রস্তাব করেছি।
মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি বিরোধীতা করছে দাবি করে আখতার হোসেন বলেন, অধিকাংশ দল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি একমত হলেও বিএনপিসহ গুটি কয়েক দল আপত্তি জানিয়েছে। এখন উচ্চকক্ষের আলোচনা বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রবনতা দেখতে পাচ্ছি। সংস্কারকে এখন সংখ্যাতাত্ত্বিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেমন- ২০টি সংস্কার প্রস্তাব, আমরা ১২টা মেনেছি, ৮টা মানিনি, সবগুলোকেই কেন মানতে হবে, এমন কথা বলা হচ্ছে।

যখন মৌলিক সংস্কারের কথা আসছে, তখন তারা বেঁকে বসছেন। কিন্তু মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে এনসিপি কোন ছাড় দেবে না। মৌলিক সংস্কার ছাড়া জুলাই সনদের দিকে নিয়ে যাওয়া হলে জনগণের প্রত্যাশা পুরণ হবে না। সেক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়টি যদি মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়, আমরা সেটাই করবো।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এদেশের ভৌগোলিক বিবেচনায় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজন নেই। আমরা পিআর পদ্ধতি চাই। সংস্কার যা হয়েছে, তা নিয়ে জাতীয় সনদ হতে পারে, সময়ক্ষেপণ করলে দেশ ও গণতন্ত্রের জন্যে হুমকি হবে।

×