ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

ডিআইএ চলছে কচ্ছপ গতিতে

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ০০:২৮, ৯ জুলাই ২০২৫

ডিআইএ চলছে কচ্ছপ গতিতে

.

বছরে অন্তত আড়াই হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম তুলে আনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। কিন্তু এ বছর তারা মাত্র ৬৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তদন্ত করেছে। অর্থাৎ শতকে ৩৩ নম্বরকে পাস মাস ধরা হলে এখন পর্যন্ত তারা কৃতকার্য হতে পারেননি। উল্টো ঝটপট নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজন ও ফল প্রকাশের কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুলিশখ্যাত ডিআইএ। নিয়োগ পরীক্ষার অস্বচ্ছতার অভিযোগে এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে চলছে তদন্ত। স্থগিত করা হয়েছে বাকি নিয়োগ পরীক্ষা।

তবে তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠেছে জাল সনদের শিক্ষকদের চাকরি ফেরানোর উদ্যোগ। যা এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আটকে দিয়েছে। এছাড়াও গণঅভ্যুত্থানের পর যাচাই ছাড়াই হাজারো প্রতিবেদন ঝটপট পাস করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। দপ্তরের পরিচালক ও যুগ্মপরিচালক একই কলেজ থেকে এখানে এসে বসেছেন প্রধান দুই পদে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরেও উপপরিচালক, পরিদর্শকদের মধ্যে ব্যাপক রেষারেষি চলছে। তদন্তকারী সংস্থাটির গতি মন্থর করেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের এসব বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, পরিদর্শকরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠা পরিদর্শনে যেয়ে নানা ধরনের সুবিধা নেন। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যে কারণে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনলাইনে যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে কারণে কাজগুলো খানিকটা ধীরে চলছে। পরিচালক  ও যুগ্ম পরিচালক একই কলেজের প্রসঙ্গে তিনি জানান, তারা দুজন এক কলেজের হয়ে ভালো দল হিসেবেও কাজ করতে পারেন। আবার খারাপ উদ্দেশ্যও হাসিল করতে পারেন। দুই সম্ভাবনাই রয়েছে। এ বিষয়ে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ থাকবে। তবে বিগত সরকারের সময় ৭০ হাজার প্রতিবেদন পেন্ডিং রয়েছে। যে কারণে নতুন করে কিছু উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। জালসনদের শিক্ষকদের চাকরিতে ফেরানোর বিষয়ে সিনিয়র সচিব আরও জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করেছে। যারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
চাকরি ফেরাতে তোড়জোড়, জালসনদের শিক্ষকদের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রলণালয়ের কমিটি ॥ ২০২৪ সালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭৭৬ শিক্ষকদের ভুয়া সনদ শনাক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে এসব শিক্ষকের বেতন বাবদ প্রায় শত কোটি টাকা সরকারকে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সরকারি নির্দেশনায় আপত্তি তুলে আদালতে একাধিক মামলা ও প্রায় শতাধিক রিট করেন শিক্ষকরা। তবে ডিআইএর কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, জালসনদধারী শিক্ষকদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে কাজ করছে ডিআইএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিযোগ উঠেছে, এ বিষয়ে লাখ লাখ টাকা লেনদেন হচ্ছে।
জানা যায়, ২০২২ সালে প্রাথমিকভাবে ৮১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জালসনদ চিহ্নিত করে ডিআইএ। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দপ্তর ও সনদ ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ থেকে সনদ যাচাই করা হয়। একাধিক বৈঠকে তা যাচাই-বাছাই শেষে মোট ৬৭৮ জনের সনদ জাল হিসেবে প্রমাণিত হয়। জালসনদ চিহ্নিত হওয়াদের মধ্যে ৫১০ জনের নিবন্ধন সনদ, ১২৩ জনের কম্পিউটার, ১৫ জনের সাচিবিক বিদ্যা, ৫ জনের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান, ৫ জনের বিডিএস, একজনের বিএড এবং ১৭ জনের অন্যান্য সনদ জাল বলে প্রমাণিত হয়। এসব শিক্ষককের চাকরিচ্যুত এবং বেতন-ভাতা বন্ধের নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে শিক্ষকরা হাইকোর্টে ৮৭টি রিট আবেদন করেন। যেখানে পক্ষভুক্ত হয়েছেন ২৩০ জন। এর মধ্যে ২৬ জন কম্পিউটার শিক্ষককে সাময়িকভাবে এমপিও সুবিধা দেওয়ার জন্য উচ্চ আদালত আদেশ দেন। মামলাগুলো বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও এসব শিক্ষককে হঠাৎ চাকরিতে পুনর্বহাল করার প্রক্রিয়ায় হাত দেয় ডিআইএ। অভিযোগ উঠেছে বর্তমানে একটি সিন্ডিকেট চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের জনকণ্ঠকে বলেন, এসব শিক্ষকরা সে সময় বৈধ প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ সংগ্রহ করতে পারেননি। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন।

পরবর্তীতে চাকরি পাওয়ার পর অনেকেই বৈধ প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়েছেন। এ বিষয়গুলো আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। যে কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করেছে। এই কমিটি তাদের পুনঃপরীক্ষা বা অন্যান্যভাবে মূল্যায়নের কথা চিন্তাভাবনা করছে। এই প্রক্রিয়াটা কমিটির মাধ্যমেই হবে। তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি বাস্তবায়ন করা হবে।
তবে শিক্ষকের সনদ যাচাইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন সাবেক একাধিক শিক্ষা কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, শিক্ষকদের জন্য প্রথম নিয়োগবিধি হয় ১৯৮২ সালে। এরপর তা সংশোধন হয় ১৯৯৫ ও ২০১০ সালে। যেসব শিক্ষকের সনদ জাল প্রমাণিত হয়েছে, তাদের নিবন্ধন সনদ জাল। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, যদি কম্পিউটার সনদে ১২৩ জনের ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় হয়, তাহলে বাকি শিক্ষকদের কীভাবে দায়মুক্তি দেবে? একই সঙ্গে জানা যায়, এর আগেও এসব জালসনদধারী শিক্ষক তাদের নাম কাটাকে ডিআইএতে দিনের পর দিন ধরনা দিয়েছেন। ১০-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ অফার করেছেন জালসনদে অভিযুক্ত শিক্ষকরা। 
পরিচালক ও যুগ্ম পরিচালক চাকরি করতেন একই কলেজে ॥ ডিআইএর বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। ৫ আগস্টের আগে তিনি জয়পুরহাট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। একই সঙ্গে অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তিনি। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ডিআইএতে পদায়ন করে পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর তিনি এই দপ্তরে যোগ দেন। কিন্তু সে সময় কোনো যুগ্মপরিচালক ছিলেন না। অর্থাৎ পদটি ছিল ফাঁকা। পরে জয়পুরহাট সরকারি কলেজের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের প্রফেসর খন্দকার মাহফুজুল আলমকে যুগ্মপরিচালক পদে পদায়ন করা হয়। বিষয়টি যে কাকতালীয় নয়, তা নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ বিষয়ে যুগ্মপরিচালক প্রফেসর খন্দকার মাহফুজুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, পদায়নের বিষয়ে তার কোনো হাত নেই। মন্ত্রণালয় যাকে যেখানে ইচ্ছা তাকে সেখানে পদায়ন দিতে পারে। 
একই সঙ্গে দুজনই একই কলেজ থেকে একই দপ্তরে পদায়নে কোনো সমস্যা নেই বলেও দাবি করেন। তবে ১৪ হাজার শিক্ষা ক্যাডারদের মধ্যে একই কলেজের একটি বিভাগের দুই অধ্যাপক একটি দপ্তরের দায়িত্ব পালন করছেন, সেটি বেশ আশ্চর্যজনক। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের জনকণ্ঠকে বলেন, তারা দুজন এক কলেজের হয়ে ভালো দল হিসেবেও কাজ করতে পারেন। মন্ত্রণালয় এমনটিই প্রত্যাশা করে। আবার তাদের খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে, সেটিও দলগতভাবে হাসিল করতে পারেন। দুই সম্ভাবনায় রয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। 
পরিদর্শনে পাস নম্বরও তুলতে পারেনি ডিআইএ ॥ ডিআইএর তথ্য অনুযায়ী, এই দপ্তরটির প্রতিবছর অন্তত ২৫০০ প্রতিষ্ঠানে তদন্ত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ৬ শতাধিক প্রতিষ্ঠান দপ্তরের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছে। এতে এপিএতে ডিআইএ তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পিছিয়ে পড়বে। অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিদর্শক নির্ধারণে অতিমাত্রায় পছন্দের কর্মকর্তাদের তদন্তে পাঠানো ও অপছন্দের ব্যক্তিদের বসিয়ে রাখার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। এতে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতেও (এপিএ) পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা দলিল হলো এপিএ। সরকারি কর্মকা-ে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়নে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি কাজ করে। এর ফলে,  কৌশলগত উদ্দেশ্য ও অর্জনের ফল নির্ধারণে কর্মসম্পাদন সূচক মন্ত্রণালয়ের গতিমাত্রার নির্ণায়কও বলা হয়। তবে গতিহীন হওয়ার কারণ হিসেবে দেশে অস্থিরতা ও মাঠপর্যায়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসেনি বলে দাবি করেছেন দপ্তরের যুগ্মপরিচালক প্রফেসর খন্দকার মাহফুজুল আলম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক জেলা-উপজেলায় তদন্ত করার মতো অবস্থা ছিল না। এর আগে আমাদের কর্মকর্তারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লাঞ্ছিত হয়েছেন। আর তাতেই পরিদর্শনের গতি কমেছে। নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি তা অস্বীকার করেন। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানটির এ বিষয়ে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। যে কারণে  নিয়োগ পরীক্ষা ও জাল ও সনদের শিক্ষকদের বিষয়ে বেশি সময় ব্যয় করা হয়েছে।
নিয়োগে অসচ্ছতা, তদন্ত করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ॥ শুধু কচ্ছপ গতিই নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজন নিয়েও বিপাকে পড়েছে ডিআইএ। গত ৯ মে ডিআইএর কয়েকটি পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তিন হাজার ১০৫ জন প্রার্থী। ওই রাতেই লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে ডিআইএ কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর তিনটি কেন্দ্রে পরীক্ষা হলেও রাতেই ১৫২ জনের ফল প্রকাশ করা হয়। এছাড়া ডিপিসি (ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি) কমিটিতে নিয়ম ভেঙে একজন শিক্ষা পরিদর্শককে দায়িত্ব দেওয়ার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে প্রশ্নপত্র তৈরি থেকে খাতা মূল্যায়ন এবং ফল প্রকাশ সবই অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে এ কাজ করা হয়েছে। এ নিয়ে চাকরিপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনেকে অভিযোগ করেন, ডিআইএর বর্তমান পরিচালকের চাকরির মেয়াদ শেষ হতে চলায় তড়িঘড়ি করে নিয়োগ সম্পন্নের চেষ্টা করা হয়। তবে এই ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে শিক্ষামন্ত্রণালয়। গত ১৭ জুন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়াও অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- বেসরকারি কলেজ শাখার উপসচিব আ. কুদ্দুস ও সিনিয়র সহকারী সচিব জাবের মো. সোয়াইব। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে মতামতসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। সরেজমিন ডিআইএতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তদন্ত করতে আসতে দেখা গেছে। এরই মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্তে কি বিষয়ে উঠে এসেছে তা নিয়ে কেউ মুখ খোলেনি।

প্যানেল মজি

×