
পবিত্র মাহে রমজান আসলে মানুষ পরকাল নিয়ে একটু বেশি চিন্তায় বিভোর হয়ে ওঠে
পবিত্র মাহে রমজান আসলে মানুষ পরকাল নিয়ে একটু বেশি চিন্তায় বিভোর হয়ে ওঠে। অন্য এগারো মাস মানুষ থাকে দুনিয়া ও জীবন-জীবিকার প্রতিযোগিতার দৌড়ে। কিন্তু এটি কোনো জীবন নয়। এ জীবনের পর কবর জীবন থেকে যে অনন্ত জীবন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাকে নিয়ে নিত্যদিন একজন মুমিনের ভাবনা ও পেরেশানি থাকা দরকার।
আল্লাহপাক যেন মাহে রমজানের বরকতে আমাদের ও আমাদের মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি ও আত্মীয়-স্বজনের অন্ধকার কবরে নূরের বাতি জ্বালিয়ে দেন। মহান স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ার জীবনে যেমন মানুষের জন্য সুন্দর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থাপনা রয়েছে, মানুষের মৃত্যুর পরও তার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
যেহেতু মানুষ সৃষ্টির সেরা সেহেতু মানুষ অন্যান্য জীব-জানোয়ারের মতো মৃত্যুবরণ করে যেখানে-সেখানে পড়ে থাকতে পারে না, পচে-গলে দুর্গন্ধময় হতে পারে না, শিয়াল কুকুর ও অন্যান্য জীব- জানোয়ারের খাদ্য হতেও পারে না। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে মৃত্যুর পর মানুষকে মাটিতে কবর দেওয়ার।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ কবর ব্যবস্থাপনা চালু হয়ে আসছে। বিশ্বের প্রথম মানব হচ্ছেন হজরত আদম (আ.)। তারপর আদম থেকে সৃষ্টি হয় মা হাওয়া (আ.)। পরবর্তীতে তাদের থেকে জন্ম নেয় কাবিল ও হাবিল নামে দুই সন্তান। তাদের সঙ্গে জন্ম নেয় আরও দুই কন্যা। এরাই হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ। যেহেতু সে সময় তারা ভাই-বোন ছাড়া অন্য কোনো মানুষ ছিল না। তাই ভাই-বোনদের মধ্যে বিয়ে প্রথা প্রবর্তিত হয়।
কিন্তু পার্থক্য এতটুকু ছিল যে, যে ছেলের সঙ্গে যে মেয়ের জন্ম হয়েছে তার সঙ্গে তার বিয়ে হারাম ছিল। কাবিলের সঙ্গে যে মেয়ের জন্ম হয়েছিল সে ছিল সুন্দরী এবং হাবিলের সঙ্গে যে মেয়ের জন্ম হয়েছিল সে ছিল অসুন্দরী। কিন্তু তৎকালীন শরীয়ত অনুযায়ী কাবিলের ভাগে অসুন্দরী এবং হাবিলের ভাগে সুন্দরী পড়েছিল। তাই কাবিল হাবিলকে হত্যা করেছিল সুন্দরীকে বিয়ে করার জন্য।
কিন্তু হাবিলকে হত্যার পর কাবিল লাশটি ঘাড়ে নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। লাশ দাফন করা বা কবর দেওয়ার কোনো নিয়ম তার জানা ছিল না। আল্লাহপাক সৃষ্টির সেরা মানুষের মরদেহ সম্মানের সঙ্গে দাফন ও কবর দেওয়ার নিয়ম শিক্ষা দেওয়ার জন্য আসমান থেকে ব্যবস্থা করেছেন।
আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন: আল্লাহ ওই সময় এক কাক প্রেরণ করলেন। সে মাটি খনন করছিলÑযাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ কিভাবে আবৃত করবে। (তখন) সে (কাবিল) বলল, ‘আফসোস, আমি কি কাকের সমতুল্যও হতে পারলাম না যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ আবৃত করি। অতঃপর সে অনুতাপ করতে লাগল।’
কাকটি এসে তার ঠোঁট দ্বারা মাটিতে গর্ত করতে আরম্ভ করে এবং পরে পার্শ্ববর্তী একটি মরা কাককে ওই গর্তে নিয়ে তার ওপর মাটি চাপা দেয়। অতঃপর কাবিল একটি গর্ত খনন করে হাবিলের লাশ দাফন করে। এখানে মুসলমানদের আক্বীদা হলো, দুনিয়ার জীবন শেষ জীবন নয়। দুনিয়াবী জীবনের পর আছে কবর জীবন। ইহকাল ও পরকালের সেতুবন্ধন এটি। এখানে কিয়ামত পর্যন্ত থাকতে হবে, ওই জীবনকে বরযখের জীবনও বলা হয়।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের এই জীবনের পর একটি বরযাখী জীবন আছে, তাতে কিয়ামত পর্যন্ত থাকতে হবে।’ কবরের শাস্তি ও সুখ হলো বরযাখের শাস্তি ও সুখ। আর বরযাখ হলো দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী সময়। শূলে চড়া, ডুবে মরা, আগুনে পুড়ে মরা এবং যাদেরকে হিংস্র প্রাণী, পাখি ও মাছ ভক্ষণ করেছে তাদের প্রত্যেকে বরযাখের শাস্তি ও সুখের অংশ ভোগ করবে। এমনকি পাপী ব্যক্তিকে যদি গাছের আগায় বা বাতাসের ঢেউয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়, সেখানেও এ শাস্তির অংশ তার দেহে পৌঁছানো হবে।
কবরের আযাব সম্পর্কে একটি অলৌকিক ঘটনা ॥ ঘটনা ঘটেছিল রাওয়ালপিন্ডির কাছে একটি গ্রামে। পাকিস্তানের জাতীয় পত্রপত্রিকায় ঘটনাটি প্রকাশিত হয়, পরে লাহোর কাশ্মিরী বাজারের রাজা বশীর আহমদ তাজেরে কুতুব ঘটনাটি একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন। এই বই ‘গুনাহ কি শামত বেআদব আওরত’ পাঞ্জাবি ভাষায় লেখা ছিল, উর্দুতে তার অনুবাদ হয়েছে। এর চুম্বক অংশ হলো:
তখন রমজান মাস। রমজানের ৪ তারিখে একজন মহিলা মারা যায়। প্রচ- গরমকাল। কিছু লোককে কবর খনন করার জন্য কবরস্থানে পাঠানো হলো। কেউ খনন করছিল আর অন্যরা মাটি নিয়ে যাচ্ছিল। কিছু খনন করার পরই খননকারী ব্যক্তি ভয়ে চিৎকার করে কবর থেকে বেরিয়ে পড়ল। সে দেখল, একটি কালো অদ্ভুত ধরনের সাপ কবরে।
সাপটি মারার জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির করেও যখন কিছু করা গেল না, তখন একজনকে গ্রামের দিকে পাঠানো হলো। সে গিয়ে গ্রামবাসীর কাছে ঘটনা ব্যক্ত করল। তখন অনেক লোক একত্রিত হয়ে যায়। কিছু কবরস্থানের দিকে এবং কিছু মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গেল। ইমাম সাহেব ঘটনা শুনে বললেন, সম্ভবত যেখানে আপনার কবর খনন করছেন, সেখানে কোনো বুজুর্গ ওলির কবর হবে।
আপনারা জায়গাটা ছেড়ে দিন। অন্য কোথাও কবর খনন করুন। ইমাম সাহেবের কথামতো তাই করা হলো। অন্য জায়গায় কবর খননের ব্যবস্থা হলো। কবরের খনন কাজ সমাপ্ত হয়ে গেছে, কবর প্রস্তুত, খননকারী কবর থেকে উঠে আসছে। এমতাবস্থায় লাশ কবরস্থানে পৌঁছতেই ওই দ্বিতীয় কবরেও সাপ দেখা গেল। ভয়ে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। কিছু লোক সিদ্ধান্ত নিল, সাপটি মেরে ফেলা হোক।
তাই সাপ মারার জন্য চেষ্টা-তদবির শুরু করা হলো। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও কেউ ওই সাপের কোনোরকম ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হলো না। আসলে এই সাপটি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো একটি আজাব ছিল।
শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, লাশ ওই কবরেই দাফন করা হবে, তবে লোকেরা আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, আয় আল্লাহ! এই সাপকে কিছুক্ষণের জন্য পৃথক করে দিন। যাতে করে লাশ জায়গামতো নিয়ে দাফন করা যায়। আল্লাহপাক মানুষের দোয়া কবুল করে নিলেন এবং সাপ দেখতে না দেখতেই গায়েব হয়ে গেল। এখন মানুষের আশ্চর্য ভাব আরও বেড়ে গেল। কবরস্থানে শুধু মানুষ আর মানুষ নজরে আসছিল।
লাশ কবরে রাখার জন্য কেউ রাজি হচ্ছিল না। অনেক কষ্টে লাশকে কবরে রাখা হলো। যখন বাঁশ লাগাতে শুরু করল, তখন পরিষ্কারভাবে ওই সাপের আওয়াজ শোনা গেল। লোকেরা দেখল যে, সাপটি লাশের বুকের ওপর বসে আছে। সে লাশের মুখের ওপর থেকে কফিনের কাপড় সরিয়ে ফেলল এবং লাশের মুখের ওপর দংশন করতে শুরু করল। সাপটি একবার দংশন করে পিছু হটে যাচ্ছিল আবার সামনে এসে দংশন করছিল। মনে হচ্ছিল যেন, এই সিলসিলা কেয়ামত পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে। (সূত্র: যুগান্তর, ২৪.৭.০৪)।
আসুন না আমরা পাপ তাপ হিংসা দ্বেষ থেকে দূরে থেকে নিজের সাড়ে তিন হাত শরীরকে কবর জীবনের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলি।