ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

জোট ও ভোটের অঙ্কে জমে উঠেছে

তৃণমূলের রাজনীতি

উত্তম চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ২০ নভেম্বর ২০২৩

তৃণমূলের রাজনীতি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জোট ও ভোটের অঙ্কে জমে উঠেছে তৃণমূলের রাজনীতি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জোট ও ভোটের অঙ্কে জমে উঠেছে তৃণমূলের রাজনীতি। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ঘটছে রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ। সকল শঙ্কা কাটিয়ে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে নির্বাচনী মাঠে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই নির্বাচনমুখী এবং জামায়াতের নিবন্ধন সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হওয়ায় ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা। উল্টো বিএনপির ঘাড়ে ঘর ভাঙার নিঃশ্বাস ফেলছে তৃণমূল বিএনপিসহ বিভিন্ন ইসলামী জোট। অতীতের মতো নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটলে বিএনপি শেষ পর্যন্ত অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে এমন আলোচনাও রয়েছে রাজনীতির মাঠে। 
ইতোমধ্যে পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। সংশয় ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী মাঠে নেমেছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এ দু’দলের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পাওয়া প্রার্থীরা দলের মনোনয়ন ফর্ম জমা দিয়েই ছুটছে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায়। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, এ নিয়ে কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তিনশ’ আসনেই দলটির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তৃণমূলে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় দলের প্রার্থীদের পদচারণায় সারাদেশের তৃণমূলে জমে উঠেছে ভোটের রাজনীতি। সেক্ষত্রে বিএনপি নির্বাচনে না এলে দলটির অনেক জনপ্রিয় সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং নেতার তৃণমূলসহ অন্যান্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে আসার সম্ভাবনাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

নানা সূত্র থেকেই জানা গেছে, এখনো বর্জনের পথে থাকলেও বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আনতে দেশী-বিদেশী মহলের নানা তৎপরতা অব্যাহত। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসার ব্যাপারে সম্মত হলে সেক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল সামান্য কিছুদিন পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি জানাবে না আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমনা দলগুলো। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে এমনটা ধরে নিয়েই দল ও জোটের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ।

কেননা তিনশ’ আসনেই দলটির সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সক্রিয় থেকে নির্বাচনী কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নির্বাচনে না এসে অতীতের মতো অগ্নিসন্ত্রাসসহ সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতি অব্যাহত রাখলে সেক্ষেত্রে ন্যূনতম ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। এমনটা হলে বিএনপির একটি বড় অংশ বিদ্রোহ করে নানা জোটে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিলে তাতে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। 
নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কেটে গেছে নির্বাচন নিয়ে নানা মহলের শঙ্কা-উৎকণ্ঠা। সংবিধান অনুযায়ী সঠিক সময়ে অর্থাৎ ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে এই নির্বাচন। আওয়ামী লীগসহ নিবন্ধিত এক-চতুর্থাংশ রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে অংশ নেওয়ার আগ্রহ জানিয়ে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। এর মধ্যে সাতটি দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। তবে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনকে কোনো তথ্য জানায়নি।
যেসব রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছে তার মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ও তৃণমূল বিএনপি রয়েছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে দুটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। রওশনপন্থি জাপার অংশ জোটবদ্ধ হয়ে আর জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার অংশ এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানিয়েছে ইসিতে। 
অন্যদিকে, জামায়াতের নিবন্ধন চূড়ান্তভাবে বাতিল করেছে সর্বোচ্চ আদালত। ভোটের হিসাবে সারাদেশে একমাত্র বিএনপি ছাড়া তাদের সঙ্গে যেসব দল জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে রয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই নাম ও প্যাডসর্বস্ব। জনপ্রিয়তার বিচারে বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলোর দু’একটি আসনেও বিজয়ী হওয়ার মতো কোনো নেতা নেই। আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা প্রথমে মনে করেছিল নিবন্ধিত অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই তফসিল প্রত্যাখ্যান করে তাদের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে উল্টো অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই নির্বাচনমুখী হয়ে পড়ায় বিএনপি ক্রমশ একা হয়ে পড়ছে। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি যদি এবারও নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটে তবে দলটির অস্তিত্ব টিকে রাখাই কঠিন হবে। কেননা বিএনপির অসংখ্য নেতা আছেন যারা নিজ নিজ আসনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু বিএনপির বারবার নির্বাচন বর্জনের নেতিবাচক রাজনীতির কারণে এসব নেতাও নিজ নিজ আসনে জনপ্রিয়তা হারিয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়ছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে সেক্ষেত্রে দলটির এসব জনপ্রিয় নেতা তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তৃণমূল বিএনপি কিংবা অন্যকোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের ব্যানারে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে নামতে পারেন। তেমনটি হলে বিএনপির সাংগঠনিক চেন অব কমান্ডও হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরা। 
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি মাস দেড়েক। ঘোষণা হয়ে গেছে তফসিল। এখনো সেই অর্থে আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি। বিদেশ নির্ভরতা, দলনেতার অভাব ও মিত্রদের নিষ্ক্রিয়তা আর অতীতের মতো সন্ত্রাসনির্ভর হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে ভর করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না দলটির। দাবি আদায়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতার মধ্যে সফলভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি রাজপথে যতটুকু কর্মসূচি পালন করতে সক্ষম হয়েছে তার পাল্টা কর্মসূচিতেও এগিয়ে ছিল ক্ষমতাসীনরা।

রাজনীতি সচেতন নেতাদের মতে, ঈদের পর, পূজার পর, তফসিল ঘোষণার পর আন্দোলনসহ নানা আল্টিমেটাম দিয়ে রীতিমতো হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে বিএনপি। নানান সুযোগ ও ইস্যু থাকা সত্ত্বেও জনস্বার্থ ঘিরে গণআন্দোলন করতেও ব্যর্থ হয়েছে দলটি। নিজ দল ও নেতাদের স্বার্থকেন্দ্রিক আন্দোলনে ব্যস্ত বিএনপির নেতারা বক্তব্য, বিবৃতিতে যতটা ‘বাঘ’, মাঠের আন্দোলনে ততটাই ‘বিড়ালের’ ভূমিকা প্রদর্শন করেছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের শক্তি এবং কৌশল মোকাবিলায় ধোপে টেকেনি বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। এখন পর্যন্ত নিজেরা নির্বাচনে না আসাই তাদের একমাত্র ‘সফলতা’। কিন্তু এটা তাদের ক্ষমতার স্বপ্ন থেকে আরও ছিটকে দেবে।
ভয়াল করোনার ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে নিষেধাজ্ঞা-পাল্টানিষেধাজ্ঞা, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, ভোট নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ-ভিসা নীতির হুমকি এসবও কৌশলে সামলে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেছে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানি এড়িয়ে এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির আশঙ্কা কাঁধে নিয়েই টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পথে দৌড়াচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের সূত্রগুলো জানায়, ১৪ দলের বাইরে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে দলীয় মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি শুরু করেছে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না এলে জোট-মহাজোটের অতীতের অঙ্কে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটবে। কিছু আসনে সমঝোতা হলেও জাতীয় পার্টি সব আসনেই তাদের প্রার্থী দিতে কাজ করে যাচ্ছে। আরও আছে বিকল্প ধারা ও বিভিন্ন ইসলামী দল। এর বাইরে এবার যুক্ত হয়েছে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি। 
বিএনপি থেকে বের হয়ে অনেকেই এসব দলে কিংবা স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে এবার আসনভিত্তিক সমঝোতা হতে পারে বড়। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শরিক ও সমমনাদের জন্য ৬০ থেকে ৬৫টি আসন ছেড়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টিকে সবচেয়ে বেশি আসন ছাড়তে হতে পারে। তবে বিএনপি থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কেউ বেরিয়ে এসে নির্বাচন করতে চাইলে সেক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া আসনের সংখ্যা আরও কিছুটা বাড়তে পারে। 
আওয়ামী লীগের অন্য একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, দলটি এবার সব মিলিয়ে যত আসন ছাড়ার চিন্তা করছে, তার চেয়ে বেশি আসন প্রত্যাশা করছে ১৪ দলের শরিকসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। ১৪ দলের শরিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এবার অন্তত ৭০ থেকে ৮০ আসনের তালিকা দেবে। তবে বাস্তবতার নিরিখে আওয়ামী লীগ এবারের চ্যালেঞ্জিং নির্বাচনে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। সেজন্য আওয়ামী লীগ ১০ থেকে ১৫টি আসনের বেশি শরিকদের ছেড়ে দিতে রাজি নয়। 
জানা গেছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর ১৪ দলের শরিকদের কাছ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা চাওয়া হবে। প্রত্যাহারের শেষ সময়ে শরিকদের আসন নিশ্চিত করা হবে। শরিকদের আপত্তি থাকলে কিছু আসনে নিজেদের প্রতীকে ভোট করার পরামর্শ দেবে আওয়ামী লীগ। এছাড়া সমঝোতার বাইরে কিছু আসন উন্মুক্ত রাখা হতে পারে। যেখানে শরিক দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ নিজ দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন। 
এদিকে, সর্বাত্মক ভোট যুদ্ধে নেমে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। চলছে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে মনোনয়ন ফর্ম বিক্রির মহাযজ্ঞ। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সারাদেশ থেকে দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বড় বড় শোডাউন করে গত তিনদিন ধরে মনোনয়ন ফর্ম সংগ্রহ করছেন। তবে এবার যে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি ঘটবে ইতোমধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 
তিনশ’ আসনে দলের একক প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে দ্রুত গণভবনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিয়ে বৈঠক করতে পারেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। সেক্ষেত্রে বিভাগওয়ারি দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক করে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবেন দলটির প্রধান। ইতোমধ্যে গণভবনের মাঠে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। তবে এবার দলের মনোনয়নের ব্যাপারে কঠিন অবস্থানে থাকবে আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে তৃণমূল নেতাদের স্পষ্ট করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দিয়েছেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে তার পক্ষে কাজ করে বিজয়ী করে আনতে হবে।

×