ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

ভোগান্তির অপর নাম

পুলিশ ক্লিয়ারেন্স

আজাদ সুলায়মান 

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২২ আগস্ট ২০২৩; আপডেট: ১৮:৪৯, ২৩ আগস্ট ২০২৩

পুলিশ ক্লিয়ারেন্স

পুলিশ ক্লিয়ারেন্স

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজের জন্য মোজাহিদুর রহমান অনীকের পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের প্রয়োজন। তিনি যথারীতি প্রথমে নিজ থানা পাকুন্দিয়ায় গিয়ে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স চান। থানা থেকে বলা হলো- ডিএসবি অফিসে গিয়ে আবেদন করতে। সেখানে যাওয়ার পর বলা হলো অনীকের নিজ ইউনিয়ন পুলিশের তদন্ত কেন্দ্র মসুয়া সেন্টারে যেতে। সেখানে যাওয়ার পর বলা হয়, আবেদন পূরণ করে সুপারিশসহ আবার পাকুন্দিয়া থানায় যেতে। অনীকের আর কোনো উপায় না থাকায় তাই মেনে গেলেন পাকুন্দিয়া। সেখান থেকে সেই আবেদন নিয়ে ফের কিশোরগঞ্জ জেলা স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে।

শেষ পর্যন্ত সেখান থেকেই তার হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই বহুল কাক্সিক্ষত পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে তার সময় লেগেছে দেড় মাসের বেশি। মে মাসে আবেদন করে জুনে হাতে পান। আবেদন করার পরও কিশোরগঞ্জের গ্রামের বাড়ি থেকে ক্লিয়ারেন্স পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে কমপক্ষে এক মাস। অথচ তার দরকার ছিল মাত্র ৭ দিনের মধ্যে একটি ক্লিয়ারেন্স। 
জহিরুল ইসলাম ওমরাহ করবেন। পাসপোর্ট তৈরির জন্য গত ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর আঞ্চলিক অফিসে আবেদন করেন। সেখান থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশন চাওয়া হয় এসবি অফিসের মাধ্যমে। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় জহিরুল ইসলামের ঠিকানা- মনোহরদী থানার চালাকচর পীরপুর গ্রামে পুলিশের কেউ যোগাযোগ করেনি। এত দিনেও পাসপোর্ট না পেয়ে তিনি নরসিংদী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ ও তদবির করলে তাকে একটি সিøপ দেওয়া হয়, যেখানে লেখা, ‘পেন্ডির ফর পুলিশ ভেরিফিকেশন।’ তারপর বিশেষ তদবিরের পর তার বাড়িতে অনুসন্ধানে যায় পুলিশ। এভাবেই তার ক্লিয়ারেন্স আসে পাসপোর্ট অফিসে। 
এটাই বাংলাদেশে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে দুর্ভোগের আংশিক চিত্র। অনীক ও জহিরের মতো এভাবেই ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে গোটা দেশের লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে। এখানে ভোগান্তি তো আছেই কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, যেমন তেমন, শত প্রয়োজন থাকলেও তা দ্রুত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভিন্ন পথে গেলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তখন আবার একদিনেই থানা থেকে হাতে পাওয়া যায়। 
সাধারণত চাকরি কিংবা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণের জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়। আপনি দেশের একজন সুনাগরিক কিংবা কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ননÑ তার প্রমাণই হচ্ছে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট। যদিও পুলিশ সদর দপ্তর দাবি করছে, এখন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য অনলাইনে আবেদন করা হয়। তবে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটির জন্য অনেক সময় আবেদন বাতিল হয়ে যায়। 
তথ্য প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, দেশ এখন ডিজিটাল থেকে স্মার্ট হতে যাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে যদি সময় লাগে এক থেকে দেড় মাস তা হলে স্মার্ট কনসেপ্টের ওপর আস্থা হারাবে মানুষ? 
মোজাহিদুর রহমান অনীক ও জহিরুল ইসলামের মতো অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স মানেই ভোগান্তি। জরুরি প্রয়োজনেও তা সহজে মিলছে না। পাসপোর্ট, দেশে বিদেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে যোগদান ও অন্যান্য প্রয়োজনে দ্রুত পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পাওয়াটা সৌভাগ্যের বিষয়। মানুষের মনে প্রশ্ন, কেন পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য এত সময় লাগবে? আবার যারা তদবির করেন, তারা দ্রুত সময়েই পেয়ে যান। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ ভেরিফিকেশন্স বা ক্লিয়ারেন্স মেলে না। সীমাহীন ভোগান্তির কোনো বিকল্প নেই। সময় মতো ক্লিয়ারেন্স না আসাতে অনেকেই পরিকল্পনা মতো হজে যেতে পারছেন না। আবার অনেকেরই কাজ ছুটে যায়। 
মাঠ পর্যায়ে আলাপ করে জানা যায়, দেশ যখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অনেক দূর এগিয়েছে, ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্যসেবা কেন্দ্র চালু করা সম্ভব হয়েছে। তখনো সহজে মিলছে না পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। এটা এখনো রয়ে গেছে সেই মান্ধাতা আমলের মতোই। ক্লিয়ারেন্স পেতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নোটিস পাঠাতে হবে জেলা পুলিশ সুপার ও ডিএসবি কার্যালয়ে। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় তা পাঠিয়ে দিয়ে অপরাধের খতিয়ান যাচাই করা হয়। তারপর প্রকৃত গ্রহীতার কাছে সেই রিপোর্ট পৌঁছানো হয়। এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে কমপক্ষে এক মাস লাগে। অনেক ক্ষেত্রে ২/৩ মাসও লাগে। আবার যিনি অন্য পথের আশ্রয় নেন তিনি ২/৩ দিনের মধ্যেই পেয়ে যান।

এ জন্য তাকে খরচ করতে হয় বাড়তি অর্থ। অর্থাৎ টাকা দিলে সরাসরি থানা থেকেই একদিনে মিলছে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। না দিলে আইন দেখানো হয়, এসপি অফিসের মাধ্যমেই নিতে হবে এ রিপোর্ট। সম্প্রতি কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে রিপোর্ট একদিনেই দেওয়া সম্ভব- সেটা পেতে সময় লাগে মাসেরও বেশি। জরুরি প্রয়োজনে ২/৩ দিনের মধ্যে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে হলে হয় বড় তদবির নয় নগদ নারায়ণ লাগবেই। প্রশ্ন উঠছে, কেন এত সময় লাগবে, কেন এত ভোগান্তি। ব্যক্তির নামে তার নিজ থানায় কোনো মামলা মোকদ্দমা আছে কিনা বা তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তি কিনা সে তথ্য তো নিজ নিজ থানাতেই সংরক্ষিত থাকে। ওই থানা ইচ্ছে করলে এক ঘণ্টার মধ্যেই তা যাচাই-বাছাই করে একটা সনদ লিখে দিতে পারে। এ জন্য সেই জটিল পদ্ধতি দরকার হবে কেন? কেন সেই নোটিস জেলা পুলিশ সুপারের মাধ্যম হয়ে আসতে হবে থানায়? 
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বিষয়টি অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। মানুষ যাতে আরও দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স রিপোর্ট পায়- সে উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে এত সময় লাগছে কেন তা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বলা যাবে। সাধারণত একটা প্রক্রিয়া তো ফলো করতে হয়। এখন আগের চেয়ে অনেক সহজে এটা পাওয়া যায়। রাজধানীবাসীর জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের অফিসে ওয়ান স্টপ সেন্টারের মাধ্যমে খুুব দ্রুত সময়ে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। যাদের দরকার তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পারেন। সেখানে খুব সহজেই ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায়। এ নিয়ে কোনো অভিযোগ এখনো শুনিনি। 
এদিকে ভুক্তভোগীরা যারা চরম ভোগান্তির মাধ্যমে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সংগ্রহ করেছেন, তাদের সচেতন অংশটা বেশ জোর ও যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, বর্তমানে যেখানে ন্যাশনাল আইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক- সেখানে কেন আবার পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দরকার? এমনকি দুদকও সর্বশেষ তাদের মতামতে পাসপোর্ট তৈরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। পাসপোর্ট তৈরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং সত্যায়িত করার বিষয়টি বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে দুদক। রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ৮.৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, পাসপোর্ট যাচাই কার্যক্রমে পুলিশ কর্তৃক কথিত ঘুষ গ্রহণের সুযোগ থাকে।

এ কারণে পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে পুলিশকে একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে অথবা এ পদ্ধতি বিলুপ্ত করা যেতে পারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন বিষয়ক যে বৈঠক হয়, সেখানেও সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ‘সামনে থেকে দেশের জনগণের পাসপোর্ট আবেদনের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের আর প্রয়োজন নেই।’ কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত এখনো আলোর মুখ দেখেনি। 
জানা গেছে, বৈঠকের অধিকাংশ কর্মকর্তা পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার পক্ষে মত দেন। সাধারণ মানুষও এতে আপত্তি তুলছে। তাদের মতে, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বা ভেরিফিকেশনের নামে সবচেয়ে বেশি হয় ঘুষ বাণিজ্য। এটি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক হলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেটি আর এগোয় না। একজন নাগরিকের যদি জাতীয় পরিচয়পত্র থাকেÑ তা হলে কেন তাকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
এমন অসংখ্য ভুক্তভোগী ও হয়রানির উদাহরণ পাওয়া গেছে। উত্তরার গৃহবধূ ফারজানার মতে- পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি বা হয়রানির চেয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের হয়রানি পাসপোর্ট গ্রাহকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যারা দেশের বাইরে থাকে, জরুরি প্রয়োজনে তাদের আরও বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়। হাবিব নামে বিমানের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী জানান, তার চাকরির বেতন ভাতাদি নিশ্চিত করার অন্যতম শর্ত হচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশন। বিমান থেকে তার ভেরিফিকেশন চেয়ে মালিবাগের এসবি অফিসে বছর খানেক আগে একবার চিঠি পাঠানোর পরও কোনো সাড়া আসেনি। সেই চিঠির খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন ওই অফিস থেকেই সেটা গায়েব হয়ে গেছে।

পরে তিনি বিমান থেকে আবারও চিঠি পাঠিয়েছেন মাস তিনেক আগে। এখনো সেটার কোনো খোঁজ নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বা ভেরিফিকেশন আনতে হলে বিশেষ তদবির করতে হয়। সে ক্ষেত্রে আর এত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা লাগে না। সাধারণ নিয়মানুযায়ী তখন আর জেলা পুলিশ সুপারের দ্বারস্থ হতে হয় না। সরাসরি নিজ থানা থেকেই সংগ্রহ করা যায়। একই অবস্থা পিরোজপুরের মান্নান, শফিকুল ইসলাম, ঢাকার রেশমা ও মামুনের। তারা বারবার থানায় ধরনা দিয়েও পুলিশ রিপোর্ট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। তাদেরও থানা থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় জেলা পুলিশ সুপারের অফিস হয়ে দরখাস্ত আনা লাগবে। তা হলে দেওয়া যাবে। 
সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয় পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) তাদের ছাড়পত্রের (ভেরিফিকেশন) জন্য। পুলিশের এই দপ্তর আবেদনপত্রে ত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। জঙ্গি কার্যক্রম বা অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহের কথা বলে ভয় দেখায়। বাড়িতে না গিয়ে চায়ের দোকান বা থানায় ডেকে পাঠায়। ঘুষ দাবি করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমেও পাঠাতে বলে। পুলিশ জানিয়েছে, সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসছে এই ভেরিফিকেশনের বিষয়টি। আগে কোনো কাজে পুলিশের কাছে থেকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট লাগত। সেখানে লেখা থাকত, ওই ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত নয়।

এ সম্পর্কে মামুন নামে এক ব্যক্তি বলেন, যে নাগরিকের জাতীয় নাগরিকত্ব সনদ রয়েছে- সেই নাগরিকের পাসপোর্ট পাওয়ারও অধিকার রয়েছে। যদিও পুলিশের একটি খোঁড়া অজুহাত থাকে, ভেরিফিকেশন না থাকলে খারাপ লোকেরা পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। আমার প্রশ্ন, এখনো তো অনেক খারাপ লোক পাসপোর্ট পাচ্ছে। নইলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ গিয়ে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি করছে কেমন করে। পুলিশ ভেরিফিকেশনে এলে টাকা দিলেই যদি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, তবে খারাপ লোকের তো ওই সামান্য টাকা দিতে সমস্যা থাকার কথা নয়। পাসপোর্ট তো কোনো নাগরিকের সার্টিফিকেট নয়। একজন মানুষ অপরাধী কিনা বা কোনো সামাজিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিনা সেটা তো পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনা হতে পারে না। তা হলে তাকে কেন জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হলো। সে সময়ই তো তাকে আটকানোর কথা।
পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে এত জটিলতা ও বিলম্ব হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে উল্লেখ করে সাবেক আইজিপি নুরুল আনোয়ার জনকণ্ঠকে বলেন, ইচ্ছা করলে কোনো নাগরিককে চাওয়ার মাত্র তিনদিনের মধ্যেই এটা দেওয়া সম্ভব। মানুষ তার প্রয়োজনে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স চাওয়ার জন্য এখন জেলা পুলিশ সুপার ও এসবি অফিসের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে অনেক হেনস্তার শিকার হচ্ছে। এক সময় থানা থেকে সরাসরি দেওয়া হতো। তখন আরও বেশি অনৈতিক সুবিধা আদায় করা হতো। পরে সেটা এসপি ও এসবি অফিসের মাধ্যমে চালু করা হয়। আমি মনে করি এই পদ্ধতি আরও সহজ করা যেতে পারে।

কোনো থানায় গিয়ে নাগরিক সরাসরি এটা চাইলে- তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ভালো-মন্দ যেটা পাওয়া যায় সেটা তিন দিনের মধ্যে লিখে দেওয়া সম্ভব। তিনদিনের মধ্যে কিছু না পাওয়া গেলে সেটা চিঠিতে শর্তও দেওয়া যেতে পারে। যেমন এখন পর্যন্ত কোনো কিছু পাওয়া যায়নি পরে পাওয়া গেলে জানানো হবে। তিনি বলেন এখন কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা মোকদ্দমা আছে কিনা কিংবা তার নাম-ঠিকানা নাগরিকত্ব ঠিক আছে কিনা তা থানায় বসে ইউপি তথ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে দু’-একদিনের মধ্যে জানা ও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কিংবা নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে সেটা অনায়াসে যাচাই করার সুযোগ আছে। আর থানার রেকর্ডে কিছু থাকলেও সেটা একদিনেই অনায়াসে বের করা সম্ভব। এ জন্য মাসের পর মাস কিংবা দীর্ঘ সময় লাগার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই আমি মনে করি এখনই এ বিষয়ে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিতে হবে। 
এদিকে এক গবেষণায় টিআইবি নতুন পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতির কারণে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা ওই ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করেছে। টিআইবির মতে, নতুন পাসপোর্টের আবেদনকারীদের তিন-চতুর্থাংশকেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে হয়। হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নিয়ম বাতিল করা উচিত। এমনকি পাসপোর্ট অফিসের অনেক কর্মকর্তারও একই মত থাকলেও পুলিশের একটি অংশ চায় না এটি বাতিল হোক। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানি হচ্ছে কাজেই এটার কোনো দরকারই নেই।

এর বদলে সকল নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ এবং ‘অপরাধী তথ্য ভা-ার- তৈরি করে তার সঙ্গে পাসপোর্ট অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সংযোগ স্থাপন করার সুপারিশ করা হয়। টিআইবির জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ পাসপোর্ট সংশ্লিষ্ট কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর ২৭ শতাংশ উত্তারদাতা অযথা সময়ক্ষেপণের শিকার হওয়ার এবং ২ দশমিক ২ শতাংশ পাসপোর্টগ্রহীতা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কথা বলেছেন। জরিপের তথ্যানুযায়ী, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও অনিয়ম হয় পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে। ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা এ কাজের জন্য অনিয়ম ও হয়ারনির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাদের ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে হয়েছে। ঘুষের গড় পারিমাণ ৭৯৭ টাকা। আর পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের গড় পরিমাণ দুই হাজার ২২১ টাকা।
তবে টিআইবির এই রিপোর্টের পর পাসপোর্ট অফিসের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে তিনি টিআইবির বেশ কিছু বিষয়ে আপত্তি তুললেও পুলিশ ভেরিফিকেশন এখনো দরকার বলে মত দেন। অনেক রোহিঙ্গা ও ভারতীয় কিছু নাগরিক পাসপোর্ট করতে এসেছে, যা ধরা পড়েছে বলেও জানানো হয়। সবার স্মার্ট আইডি কার্ড হয়ে গেলে তখন এটি বিবেচনা করা হতে পারে। 
 

×