ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়

ঘোড়াশাল থেকেই সূত্রপাত

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ৫ অক্টোবর ২০২২

ঘোড়াশাল থেকেই সূত্রপাত

জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয়

জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয় সামলে স্বাভাবিক হয়েছে দেশে বিদ্যুত সরবরাহ। কিন্তু হঠাৎ করে এমন বিপর্যয় কেন? তার কারণ জানতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। সেই কমিটি কারণ অনুসন্ধানে ঘোড়াশাল গেছে। বিদ্যুত বিভাগের প্রকৌশলীরা নিশ্চিত ঘোড়াশাল থেকেই এই বিপর্যয়ের সূত্রপাত। তবে ঠিক কীভাবে বা কেন এই সূত্রপাত তা জানা যাবে কমিটির সদস্যরা ঢাকায় ফিরলে।
ফ্রিকোয়েন্সি গরমিলের কারণে মাত্র এক মাসের মাথায় ব্ল্যাকআউটের কবলে পড়ে দেশের পূর্বাঞ্চলের প্রায় সবগুলো জেলা। দেশের ইতিহাসে বিদ্যুতে বড় কয়েকটি বিপর্যয়ের মধ্যে মঙ্গলবার একটি দেখে দেশবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুত যে তরঙ্গে প্রবাহিত হয়, কোন কারণে এর হেরফের হলেই এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে। এর একমাত্র সমাধান বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে শুরু করে সঞ্চালন, বিতরণ সব পর্যায়ে আধুনিকীকরণ। একমাত্র পুরো প্রক্রিয়াটা স্মার্ট গ্রিডকরণের মাধ্যমেই ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত মিলি সেকেন্ডের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। এমন ঘটনা প্রতিরোধ করার মতো নানা ধরনের ব্যবস্থা থাকলেও বিভিন্ন দেশে মাঝে মাঝে গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। কোন সঞ্চালন লাইনে হয়তো একসঙ্গে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত প্রবাহিত হচ্ছে। যদি কোন বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ হয় এর দশ ভাগ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে গ্রিড ট্রিপ  করার মতো ঘটনা ঘটে থাকে।
জানা যায়, বাংলাদেশে ৫০ মেগা হার্টজ তরঙ্গে বিদ্যুত প্রবাহিত হয়। কোন কারণে এই তরঙ্গ যদি ৪৮-এ নেমে আসে বা ৫২-তে উঠে যায়, তাহলেই ট্রিপের ঘটনা ঘটতে পারে।
এর আগে ২০১৪ সালে যখন বিদ্যুত বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল তখন ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা কয়েক মিলি সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এতে জাতীয় গ্রিড ট্রিপ করে। আর একবার গ্রিডে বিদ্যুত বিপর্যয় দেখা দিলে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়।

বড় বিপর্যয় ঠেকাতে কেন্দ্রগুলোতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এ ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকে। বিদ্যুত  কেন্দ্র বন্ধ হলে কারিগরি কারণে সেটি চালু হতে সময় লাগে। ফলে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুত সরবরাহ করা যায় না। এই বিপর্যয় কোনভাবে এড়ানো যায় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, এটি এড়ানো সম্ভব আসলে স্মার্ট গ্রিডের মাধ্যমেই। আমাদের বিদ্যুত উৎপাদন থেকে শুরু করে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই সনাতনী পদ্ধতিতে চলে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর আধুনিকীকরণের কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু জায়গায় গ্রাহক পর্যায়ে স্মার্ট গ্রিড সরবরাহ করা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটিই স্মার্ট করার কাজ চলছে। আরও অন্তত দুই বছর সময় লাগবে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে। তখন আমরা সব জায়গা সর্বক্ষণিক মনিটর করতে পারব। কোথাও যদি বিপর্যয় ঘটে বা এর আগেও আমরা খবর পেয়ে যাব। তাতে করে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে খুব সহজেই। তবে যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এমন বিপর্যয় ঘটে তাই শতভাগ এড়ানোর সুযোগ থাকবে কিনা বলা যাচ্ছে না।
গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মঙ্গলবার কেন এই ঘটনা ঘটেছে সেটি এখনও আমরা জানতে পারিনি। তদন্ত করার আগে এটি বলা সম্ভব নয়। তবে ফ্রিকোয়েন্সিতে গরমিল হলেই এটি হতে পারে। ফ্রিকোয়েন্সিতে গরমিল নানা কারণে হয়।

কোথাও সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিলে বা হুট করে কোথাও থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এমন হতে পারে। গ্রিড লাইনের কোন একটি অংশ কোথাও বিকল হয়ে গেলেও এটি হতে পারে।
এ বিষয়ে বিদ্যুত সচিব মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের তদন্ত কমিটি বুধবার সকালে ঘোড়াশাল বিদ্যুত  কেন্দ্রে গেছে। কমিটি এলে আমরা প্রাথমিক ধারণা পাব। তার আগে বলা যাচ্ছে না কী কারণে সমস্যা হয়েছিল।
বিদ্যুত বিপর্যয়ের বিষয়ে সচিব বলেন, ঘোড়াশাল বিদ্যুত  কেন্দ্রে দুটি সাব-স্টেশনের মাঝখানে যে ইন্টার কানেকশন রয়েছে, সেখানেই মূলত সমস্যা। কিন্তু সমস্যাটা কেন হলো সেটা এখনও জানা যায়নি। তা উদ্ঘাটনের জন্য আমাদের অভিজ্ঞ টিম সেখানে গেছে। সেটা জানতে পারব তদন্ত কমিটি ফিরলে। তবে এখন সারাদেশে বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
আকস্মিক এই বিপর্যয়ের ঘটনায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) একটি তদন্ত কমিটি করেছে। সেই কমিটিও তদন্ত করছে। এ বিষয়ে পিজিসিবির মুখপাত্র এ বি এম বদরুদ্দোজা খান সাংবাদিকদের জানান, পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক (পিএ্যান্ডই) ইয়াকুব ইলাহীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দুটি তদন্ত কমিটি করার নির্দেশ দেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই ঘটনা তদন্তে বিদ্যুত বিভাগের একটি এবং তৃতীয় পক্ষের একটি কমিটি বিভ্রাটের কারণ খুঁজে বের করতে কাজ করবে। তিনি বলেন, পিজিসিবি এবং বিদ্যুত বিভাগ পৃথকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করবে। বিদ্যুত বিভাগ, সঞ্চালন, উৎপাদন এবং বিতরণ কোম্পানির প্রতিনিধিরাও তদন্ত কমিটিতে থাকবেন।
কিন্তু শুধু তদন্ত কমিটি গঠন করে বসে থাকলেই হবে না বরং এর ফল কি আসে তাও খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন বিদ্যুত ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত মাসে যখন দক্ষিণাঞ্চলে গ্রিড বিপর্যয় ঘটল তখনও দেখেছি একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা কি প্রতিবেদন দিয়েছে আমরা আজও জানি না।

এই ঘটনা কেন ঘটেছে তাও নিশ্চয়ই আমরা জানতে পারব না। তবে পুরো প্রক্রিয়াটা আধুনিক হয়ে গেলে হয়তো সহজেই জানা যাবে এমনকি বিপর্যয় প্রতিরোধও করা যেতে পারে। তবে যারা এই কাজটি যারা করবেন তাদের অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে, না হলে ভবিষ্যতেও এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের এক প্রকৌশলী জানান, এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত দল ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। তারা প্রতিবেদন দেবেন। তদন্ত টিমের সদস্যদের হাতে প্রতিবেদন দেয়ার মতো সময় আছে। আশা করি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করবেন তারা।
তবে এখনও সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুত ফেরেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা সমস্যা হলে তা পুরোপুরি সমাধান হতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। তবে শতভাগ সমাধান খুব দ্রুতই হবে।
স্বাভাবিক হয়েছে বিদ্যুত সরবরাহ ॥ এদিকে গ্রিড বিপর্যয়ের পর দীর্ঘ প্রায় সাত ঘণ্টা পর মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ঢাকার বাইরেও বহু এলাকায় বিদ্যুত এসেছে ওইদিন রাত ১১টার মধ্যেই। তবে পুরোপুরি চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত না পাওয়ায় কিছুটা লোডশেডিং করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
এসব বিষয় নিয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ডিপিডিসির অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুত চলে এসেছে। তবে সব এলাকায় পুরোপুরি দিতে পারিনি এখনও। কোথাও কোথাও আংশিক বিদ্যুত দিতে পেরেছি। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুত প্রয়োজন ১৪০০ মেগাওয়াট, এখন বিদ্যুত পাচ্ছি ৯০০ মেগাওয়াট।’
একই কথা বলেন ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী বলেন, ‘ডেসকোর অধীনে বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আমাদের এখনকার যে আবহাওয়া, তাতে ৯০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। আপাতত আমরা ৭০০ মেগাওয়াট পাচ্ছি। তাই লোড ম্যানেজমেন্ট করেই বিদ্যুত সরবরাহ শুরু করেছি।’
বুধবারও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সময়ে সময়ে লোডশেডিং হলে বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিকই ছিল বলে জানা গেছে।
তদন্ত কমিটির পরিদর্শন ॥ স্টাফ রিপোর্টার, নরসিংদী থেকে জানান, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত বিপর্যয়ের পর নরসিংদীর পলাশে ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুত কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ছয় সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি।
বুধবার সকালে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব এলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা বিদ্যুত কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুম পরিদর্শন করতে যান। এ সময় অন্যদের মধ্যে তার সঙ্গে পিজিসিবির পরামর্শক শামছুর জোহা, নির্বাহী প্রকৌশলী আরেফিন সিদ্দিক ও সাইদুল ইসলাম ছিলেন।

দীর্ঘ চার ঘণ্টা বিদ্যুত কেন্দ্রের বিভিন্ন মেশিনারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিকেল সাড়ে তিনটায় তারা ঘোড়াশাল বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দেন।
এ সময় তদন্ত কমিটির প্রধান পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব এলাহী চৌধুরী জানান, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত বিপর্যয়ে দেশের কয়েকটি বিদ্যুত কেন্দ্রের পাওয়ার কন্ট্রোল রুমগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। শেষ হলে জানা যাবে কী কারণে বিপর্যয় ঘটেছিল।
এদিকে, মঙ্গলবার দুপুর ২টা ৫ মিনিটে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের ৪ ও ৫নং ইউনিটের বিদ্যুত উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। বুধবার দুপুর ১২টায় ৩৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪নং ইউনিটের বিদ্যুত উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে ৫নং ইউনিটের উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৫নং ইউনিটের মেরামত কাজ চলছে। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি চালু করা সম্ভব হয়নি। এই ইউনিট চালু করতে আরও দুই-তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে।

×