ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক প্রয়োজনে শুরু, বন্ধ হচ্ছে কালের পরিক্রমায়

বিবিসি বাংলা রেডিওর জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের সেই দিন এই দিন

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ১ অক্টোবর ২০২২

বিবিসি বাংলা রেডিওর জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের সেই দিন এই দিন

পাবনার রূপপুরে ১৯৭১ সালে স্থাপিত বিবিসি টি স্টল

বর্তমানে টেলিভিশন ও অনলাইনের জোয়ারে বিবিসি বেতারের শ্রোতা হয়তো কিছুটা কমেছিল। তবে কোন ঘটনার বিস্তারিত জানতে বাংলাদেশের মানুষ ও বিশ্বের সকল বাংলাভাষাভাষী আজও বিবিসি বেতারের বাংলা অনুষ্ঠানের ওপর ভরসা করে। বড় ঘটনাগুলোতে দেশের টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজের পাশাপাশি বিবিসি বেতারের শ্রোতা, বিবিসি অনলাইনের পাঠক ও বিবিসি টেলিভিশনের দর্শক হয়ে যায় এ দেশের মানুষ। অনেকের এ্যান্ড্রয়েড ফোনে বিবিসি অনলাইন সার্ভিস নেয়া আছে। ফেসবুকেও বিবিসির স্ট্রিমিংয়ের (লাইভ ভিডিও) দর্শক আছে। বিবিসির এই জনপ্রিয়তার বিবিসি বাংলা বিভাগ হীরকজয়ন্তি পালন করেছে।
৮১ বছরের সেই বিবিসি বাংলা রেডিওর সম্প্রচার এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলেছে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনলাইন কার্যক্রম চালু থাকবে। রেডিও শ্রোতা ও অনলাইনের দর্শক শ্রোতা ভিন্ন। রেডিও যত সহজে কমিউনিকেট করতে পারে অনলাইন তা পারে না। বিবিসি বলেছে তাদের লোকবল কমানো হয়েছে। লাইসেন্সের ওপর নির্ভর করে বিবিসি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
সপ্তাহে মাত্র ১৫ মিনিটের যে বাংলা অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর বর্তমানে তা সপ্তাহে প্রায় ১০ ঘণ্টা প্রচারিতে হচ্ছে সকালে ও রাতের তিনটি শ্লটে। এই বাংলা অধিবেশনে ২০১৫ সাল থেকে সপ্তাহে একদিন প্রবাহ অনুষ্ঠানে বিবিসি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বিবিসি যে কতটা জনপ্রিয় ছিল তার প্রমাণ আজও ধরে রেখেছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পাবনা জেলার পাকশীর রূপপুর বাজার। এই বাজার আজও বিবিসি বাজার নামে পরিচিতি বহন করছে।

মহাসড়কের পথ ধরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে পৌঁছার দুই কিলোমিটার আগেই এই বাজার। একদা নাম ছিল রূপপুর বাজার। সেই হাটখোলার মতো ছোট্ট এই বাজারে বাঁশ চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে ঘেরা কাশেম মোল্লার একটি চায়ের দোকান ছিল। সেই দোকানে কাশেম মোল্লা তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও বাজাতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিবিসি অনুষ্ঠান শুনতেন। এই রেডিও (তখন রেডিওকে লোকজন বলতো ট্রানজিস্টর) কিনেছিলেন ১৯৬২ সালে তার বিয়ের পর।

হাটখোলায় নিত্যদিন আসা মানুষ সন্ধ্যায় বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান (মূলত খবর ও সংবাদ ভাষ্য) শুনে বাড়ি ফিরত। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ওই ছোট্ট চায়ের স্টলে প্রতিদিন অন্তত ৩শ’ লোক খবর শুনত। বিবিসির খবর শোনা হতো বলে ওই রূপপুর বাজারের নাম লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে বিবিসির বাজারে পরিণত হয়।
দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ৫১ বছর পরও ওই বাজারের নাম বিবিসি বাজার রয়ে গেছে। বিবিসির এই জনপ্রিয়তা হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। বিজয়ের মাত্র ৪ দিন আগে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী তাদের দোসর জামায়াতের রাজাকাররা বিবিসির ঢাকার সাংবাদিক নিজাম উদ্দিনকে তুলে নিয়ে হত্যা করে।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাই কমিশনার টনি গোল্ড কুমিল্লা গেলে লোকজন তাকে বিবিসির সাংবাদিক মনে করে ঘিরে ধরে শুভেচ্ছা জানায়। জানতে চায় তিনি বিবিসির সাংবাদিক কিনা। এ থেকে বোঝা যায় কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিবিসি। অতীতে প্রতিটি সংবাদপত্রে রেডিও মনিটরিংয়ের যুগে বিবিসির খবর রেকর্ড করা ছিল বাধ্যতামূলক। তখন বিবিসি ছিল সংবাদ সংগ্রহের বড় একটি সূত্র। বিবিসির চড়াই উৎরাইয়ের পথ পেরিয়ে তাকে এতদূর আসতে হয়েছে।
বেতার যন্ত্র আবিষ্কারের পর যে বেতার কেন্দ্র বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করে তা ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন সংক্ষেপে বিবিসি। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীসহ ৩৬টি ভাষার মানুষ বিবিসির নামই শুধু শোনেনি বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর ৯৭ শতাংশ বিবিসি বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনেছে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯২২ সালে বিশ্ব ইতিহাস রক্ষার অস্তিত্বের প্রয়োজনে বেতার যন্ত্রের সাফল্যের মাপকাঠিতে লন্ডনে ব্যক্তি মালিকানায় স্থাপিত হয় একটি বেতার কোম্পানি। নাম দেয়া হয় ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানি।

তখন বেতার কেন্দ্রের অনুমোদন দিত পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার জেনারেল। তার অনুমোদনে বেতার কোম্পানিটি শুধু সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে এবং অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ যেন বেতারের ভূমিধস বিজয়। কয়েক মাসের মধ্যে পোস্ট অফিস ৩৫ হাজার বেতারের লাইসেন্স ফি পায়। চার বছরে এই লাইসেন্সের সংখ্যা দাঁড়ায় দশ লাখেরও বেশি।

গত শতকে শুরু হওয়া এই গতি আর থেমে থাকেনি। উল্লেখ্য, ব্রিটিশরা প্রথমে বেতার যন্ত্রের লাইসেন্স ফি প্রথা চালু করে। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের সকল দেশেই তা চালু হয়। যা আদায় করে পোস্ট অফিস। বাংলাদেশেও এক সময় বেতার যন্ত্রের লাইসেন্স ফি ছিল। যা জমা দিতে হতো পোস্ট অফিসে।
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানির অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব সফলতায় ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানিটি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) নাম ধারণ করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বিবিসি নামে বেতার, বিবিসি টেলিভিশন, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্রিমিং সার্ভিস চালু আছে।
বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শুরু হয় ঐতিহাসিক প্রয়োজনে। এর আগে উপমহাদেশের ভাষাভাষীর জন্য অনুষ্ঠান শুরু হয় ১৯৪০ সালে। প্রথম শুরু হয় হিন্দি ভাষায়। এর এক বছর পর ১৯৪১ সালে বাংলা, তামিল, মারাঠী ভাষায় সপ্তাহে ১৫ মিনিট করে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। বাংলা অনুষ্ঠান প্রথম শুরু হয় ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর সন্ধ্যায়, সপ্তাহে মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য। ওই সময়ে অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য বাংলা ভাষার সার্বক্ষণিক কর্মী ছিল না। এ্যারিক ব্লেয়ার বাংলা অনুষ্ঠান ইংরেজীতে লিখে দিতেন। তারপর ক্রমেই বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান প্রচারের সময় ও পরিধি বাড়তে থাকে।
বিবিসি বেতারের সাফল্যের পর বিবিসি টেলিভিশনের সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৩৬ সালে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তা বন্ধ হয়। ফের বিবিসি টিভির সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। সারা বিশ্বে বিবিসির টিভি অনুষ্ঠান প্রথম রঙ্গিন সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। বিবিসি বেতারের সাফল্যে বাংলা অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ১৯৪৪ সালের ২৩ জানুয়ারি সপ্তাহে একটি বাংলা অনুষ্ঠানের বদলে সকাল ও সন্ধ্যায় ১৫ মিনিট করে সপ্তাহে মোট ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়।

এর সাত মাস পর ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে অল ইন্ডিয়া রেডিওর মনোনয়ন নিয়ে বাংলা অনুষ্ঠানে পূর্ণকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক হয়ে প্রথম যে দুই বাঙালী যোগদান করেন তারা হলেন রেখা আলী ও কমল বোস। তাদের পরিচিতি হয় অনুষ্ঠান সহকারী। সপ্তাহে দুই সøটে ১৫ মিনিট করে দুটি অনুষ্ঠান সাজানো হয় সংবাদের সঙ্গে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যোগ করে। নাম দেয়া হয় বিচিত্রা। পণ্ডিত রবি শঙ্কর বিচিত্রার জন্য সেতার বাজিয়ে সূচনা সঙ্গীত নির্মাণ করে দেন। বিচিত্রায় গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক প্রসঙ্গ ছাড়াও সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় স্থান পায়।

এমন কি কোন ইংরেজ পরিবারে যিনি বাঙালী বধূ হয়ে এসেছে তাও বাদ যেত না। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার প্রচার করা হতো। যা চলমান ছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তৎকালীন বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিলেত গেলে তার বক্তব্য প্রচার করা হয় বাংলা অনুষ্ঠানে। তার ইংরেজী বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছিলেন সুধীর ঘোষ।
বেতার সম্প্রচারের আদিকালে রেকর্ড করে অনুষ্ঠান প্রচার হতো খুবই কম। তা খুব সহজও ছিল না। বিবিসির স্টুডিওতে সরাসরি মাইক্রোফোনের সামনে বসে কথা বলতে হতো। যা ছিল খুবই সেনসিটিভ।

১৯৪৯ সালের ৩০ অক্টোবর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্য আলাদা করে বাংলা ভাষার ৩০ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই অনুষ্ঠান প্রচার হতো প্রতি বুধবার সন্ধ্যায়। প্রথম এই অনুষ্ঠানের নাম ছিল আঞ্জুমান। ১৯৬৭ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দিগন্ত। তখন সপ্তাহের অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল শনিবার সন্ধ্যায় বিচিত্রা, বুধবার সন্ধ্যায় দিগন্ত। তৃতীয় আরেকটি ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠান প্রচার হতো প্রতি সোমবার। এই অনুষ্ঠান শুরু হয় ১৯৫৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর।
ষাটের দশকের শুরুতে বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতাদের দাবির মুখে বিবিসি কর্তৃপক্ষের ভাবনায় এলো বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান বিচ্ছিন্ন ভাবে সপ্তাহে প্রচার না করে প্রতিদিন প্রচারের। শ্রোতাদের এই দাবি জোরালো হলে বিবিসি কর্তৃপক্ষ ১৯৬৫ সালের ১৬ নবেম্বর প্রতিদিন সকালে ১৫ মিনিটের প্রভাতী অনুষ্ঠান শুরু করে। প্রথম ১০ মিনিট ছিল বিশ্ব সংবাদ। পরের ৫ মিনিট থাকত সংবাদ ভাষ্য।

রবিবার এই ৫ মিনিট প্রচার হতো পপ এক্সপ্রেস নামের মিউজিক অনুষ্ঠান । ১৯৬৬ সালের ১৬ নবেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ব্রিটেন সফরে গেলে বাংলাভাষী শ্রোতাদের সফরের বিবরণ দিতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ১৫ মিনিট অনুষ্ঠান বাড়ানো হয়। বাড়তি এই অনুষ্ঠান চলেছিল ১১ দিন। তারপর পূর্ববস্থার সময় ফিরে আসে।
এরপর বিভিন্ন সময় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এলেই সন্ধ্যায় ১৫ মিনিট বাংলা অনুষ্ঠান বাড়ানো হতো। তা থাকতো অস্থায়ী। এভাবে বাংলা অনুষ্ঠানের গুরুত্ব পুনর্বিন্যাস হতে থাকে। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন সকালে ১৫ মিনিটের সংবাদ ও সংবাদ ভাষ্য ছাড়াও শনিবার, সোমবার ও বুধবার আধা ঘণ্টা করে তিনটি অনুষ্ঠান চালু থাকে। বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বছর ১৯৬৯ সালের ১ জুন।

ওই দিন ভারতীয় বাংলা ভাষাভাষী (পশ্চিমবঙ্গ) ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য দুই সেকশনে যে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো তা এক হয়ে বিবিসির বাংলা বিভাগ নামকরণ হয়। বাংলা বিভাগের দায়িত্ব পান হিন্দি বিভাগের সংগঠক ডেভিড বার্লো। পরের দিন ২ জুন প্রতিদিন সন্ধ্যায় ১৫ মিনিটের বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। নাম দেয়া হয় প্রবাহ। প্রথম দিন থেকেই এই প্রবাহ অনুষ্ঠানে সংবাদ ছাড়াও রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিষয় সমান গুরুত্ব পায়।

১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ল-ভ- হয়ে গেলে ওই দিনের বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠানের আনন্দের সূচনা সঙ্গীত বাজানো হয়নি। ভয়াবহ এই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের খবর প্রচারে সান্ধ্য অধিবেশনের সময় ১৫ মিনিট বাড়ানো হয়। ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়তি ১৫ মিনিট চালু ছিল।
এই ঘূর্ণিঝড়ের খবর ও বিশ্লেষণ প্রচারের পর বাংলা অনুষ্ঠান এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে বিশ্বের বাংলাভাষাভাষী সকল মানুষ কার্যত সঠিক সংবাদের জন্য বিবিসির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই নির্ভরশীলতা সর্বজনীন হয়ে ওঠে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শান্তিপ্রিয় বাঙালীর ওপর যে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা এবং গণহত্যা শুরু করে তা আজও বিশ্বের ইতিহাসে বর্বরতা, নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার বড় অধ্যায় হয়ে আছে।

ওই দিন ঢাকা তথা বাংলাদেশের খবর জানার জন্য বিশ্বের মানুষ বিবিসির এই ১৫ মিনিটের বাংলা অনুষ্ঠান শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থেকেছে। বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান এবং আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ ও সংবাদ প্রবাহ ছিল ঘটনা জানার অবলম্বন। দেশের ভেতরে মানুষ রেডিও নিয়ে অপেক্ষায় থেকেছে কখন শুরু হবে বিবিসির অনুষ্ঠান। বিবিসি ওই সময় তাদের সংবাদে সততা নিরপেক্ষতা রাখার জন্য একাধিক সোর্স থেকে খবর সংগ্রহ করে প্রচার করত। ১৯৭১ এর দিনগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থা এমন ছিল বিবিসির খবর শুনতে হতো লুকিয়ে।
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বিবিসির সান্ধ্যকালীন বাংলা অনুষ্ঠান ১৫ মিনিট বাড়ানো হয়। তা চলে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। এর তিন দিন পর ১৩ জানুয়ারি থেকে সান্ধ্য অনুষ্ঠান প্রতিদিন আধা ঘণ্টা বাড়ানো হয়। বিবিসির জনপ্রিয়তা দিনে দিনে এতটাই বেড়ে যায় ১৯৭২ সালের ৫ জুলাই সান্ধ্য অধিবেশন আরও ১৫ মিনিট বাড়িয়ে ৪৫ মিনিট করা হয়। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে প্রভাতী অধিবেশন ১০ মিনিট থেকে ২০ মিনিট করা হয়।

বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তায় ১৯৮৮ সালের ২৭ মার্চ সান্ধ্যকালীন অধিবেশন ৪৫ মিনিটের স্থলে ১৫ মিনিট কমিয়ে আধা ঘণ্টা করে রাতে আরও আধা ঘণ্টার আরেকটি অধিবেশন যোগ করে মোট এক ঘণ্টা করা হয়। ১৯৯১ সালের ১ এপ্রিল সান্ধ্য অধিবেশন ৩০ মিনিটের স্থলে ১০ মিনিট বাড়িয়ে ৪০ মিনিট করা হয়। এই সময় প্রভাতী অধিবেশন ২০ মিনিটের স্থলে ৫ মিনিট কমিয়ে ১৫ মিনিট করা হয়। ২ হাজার ১৫ সালে বিবিসি বেতার তাদের টেলিভিশনের সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান প্রবাহের সঙ্গে যোগ করে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
 গত শতকের পুরোটা সময় রেডিওর গুরুত্ব ছিল বেশি। বিবিসি ছিল সবচেয় জনপ্রিয়। বিবিসির ২৪ ঘণ্টা ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ৩৬টি ভাষায় প্রচারিত হতো। তবে বেশি সময় ব্যয় হয় ইংরেজী ভাষার অনুষ্ঠান। বিবিসির ¯œায়ু ও হার্ট হলো তাদের সংবাদ ও ভাষ্য। বড় বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুত সংবাদ পরিবেশন করা তবে তা হতে হবে নির্ভুল। তারপরও বিবিসির মতো বিশ্বখ্যাত বেতার কেন্দ্রেরও ভুল হয়। ১৯৯৮ সালের বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের বন্যার সময় বিবিসির একটি ভুল সংবাদ শ্রোতাদের বিব্রত করে তোলে।

পরে বিবিসি তাদের ভুল শুধরে নেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের বক্তব্য প্রচার করে। বিবিসি নিজেদের সূত্র ছাড়াও দ্বিতীয় সূত্রের সমর্থনে সংবাদ প্রচার করে। তবে বিবিসির বড় বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুত ভুল শুধরে পূর্বের সংবাদকে তুলে নেয়া। বিবিসি বেতারের ক্ষেত্রে যেমন বিবিসি টেলিভিশন ও অনলাইনের ক্ষেত্রেও একই পলিসি। ১৯২২ সালে বিবিসির নিয়মিত অনুষ্ঠান শুরুর দশ বছর পরই ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে বহির্দেশীয় অনুষ্ঠান শুরু করে। তখন নাম ছিল এম্পায়ার সার্ভিস।

×