ডলার বেচা কেনায় ৬ ব্যাংকের কারসাজি
গত তিন মাস ধরেই অস্থির মুদ্রা বাজার। এর মধ্যে এক মাসেই কোন কোন ব্যাংক ডলার কেনাবেচা করে চারগুণ মুনাফা করেছে। যার মাধ্যমে ডলারের বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে দেশী-বিদেশী ছয় ব্যাংক। ব্যাংক ছয়টি হলো- দেশের বেসরকারী খাতের প্রাইম, ব্র্যাক, দি সিটি, ডাচ্-বাংলা ও সাউথইস্ট এবং বিদেশী খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে ডলার কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে, শুধু ট্রেজারি প্রধান নয়, ব্যাংকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে ডলার কারসাজির অভিযোগে একাধিক মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স বাতিল ও সিলগালা করা হয়। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন ও পুলিশের নিয়মিত অভিযানের পরও পাগলা ঘোড়ার মতোই ছুটছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা- ডলারের দাম। সঙ্কটের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে ২৫ টাকা বেশিতে অর্থাৎ এখন ১২০ টাকায় খোলাবাজারে কিনতে হচ্ছে মুদ্রাটি। দেশের ইতিহাসে এর আগে এই ঘটনা কখনও ঘটেনি। গত ২৭ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের দর উঠেছিল ১১২ টাকা। এর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির পর কয়েকদিন সেখান থেকে কিছুটা কমে ১০৮ টাকায় থিতু হয়। কিন্তু চলতি সপ্তাহ থেকে আবার শুরু হয় উর্ধগতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরের বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। তখন ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ও খোলাবাজারের দরের মধ্যে পার্থক্য ছিল কমই। বরং গোটা বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে দর ধরে রাখতে চেষ্টা করেছে। তবে মহামারী করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমদানি অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্য, জ্বালানি, শিল্পের উপকরণের দর বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের সঙ্কট দেখা দেয়।
আমদানি খরচ বাড়ায় চলতি বছরের মে মাস থেকে দেশে ডলারের সঙ্কট চলছে। রফতানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি দায় শোধ করা যাচ্ছে না। এর ফলে বেড়ে গেছে ডলারের দাম। ডলারের সঙ্কট শুরু হলে গত জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শক দল দেশী-বিদেশী ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করে। এতে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের যে ঘোষণা দিয়েছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে কেনাবেচা করছে। ডলার কেনাবেচায় দামের পার্থক্য (স্প্রেড) তিন টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আবার অনেক ব্যাংক ডলার ধারণের মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এর মাধ্যমে বেশি দামে ডলার বিক্রি করে ট্রেজারি বিভাগ মুনাফায় অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি করেছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর জবাব চেয়ে চিঠি পাঠায় বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ। এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার ছয় ব্যাংকের এমডিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ব্যাংক ছয়টির এমডিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লিখেছে- ‘২০২১ সালের জানুয়ারি-মে মেয়াদের তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে উচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য বৈদেশিক বাজারকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। এ জন্য আপনাদের ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, কোন কোন ব্যাংক ডলার কেনাবেচা করে এক মাসে চারগুণ মুনাফা করেছে। যার মাধ্যমে ডলারের বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত এক দশকে একসঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের ছয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। ২০০২ সালে ওম প্রকাশ আগরওয়াল নামের এক ব্যবসায়ী জালিয়াতির মাধ্যমে পাঁচটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ওই ঘটনায় একসঙ্গে পাঁচ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডলার বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে কয়েকটি ব্যাংক। এ জন্য তাদের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত কঠিন হলেও এমন পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বাংলাদেশের টাকার মান অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের সঙ্গে ব্যাংকগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে।
টাকার অবমূল্যায়ন যাতে না হয়। এ ক্ষেত্রে যারা ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে কাজ করেন তাদের কয়েক ব্যক্তিকে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট থেকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন পদক্ষেপ। কিন্তু আমার মনে হয় এটার প্রয়োজন ছিল। কারণ,ব্যাংকগুলোর যারা দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ছয়জনকে বরখাস্ত করাই যথেষ্ট নয় জানিয়ে সাবেক এই গবর্নর আরও বলেন, এটাই যথেষ্ট নয়- কারণ অনেক সময় দেখা যায়, উপরের নির্দেশে বিশেষ করে পরিচালকদের নির্দেশে বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নির্দেশে বা উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তারা (ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা) মুনাফা করার জন্য এগুলো করে থাকেন। শুধু ফরেন এক্সচেঞ্জের বেলায় নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা এটা করে থাকেন।
অতএব, সেখানে ব্যাংকগুলোর পর্ষদেরও দায়বদ্ধ, দায়িত্বশীলতার জায়গা রয়েছে। এ জন্য আমি মনে করি, ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট, ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালক- তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সার্বিকভাবে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে, এই সমস্যার সমাধান হবে না। পূর্বে দেখা গেছে, কোন কোন ব্যাংকের এমডিকে দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে। এটা ব্যাংকগুলোকে একটা কঠোর বার্তা দেবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এটা মনিটরিং করবে। বেসরকারী একটি ব্যাংকের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে ডলার মার্কেট অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। রফতানি থেকে যা আসে, তার চেয়ে আমদানির এলসি বেশি রয়েছে। সেসব এলসির পেমেন্ট করার জন্য বাধ্য হয়ে বেশি দামে আমাদের ডলার কিনতে হচ্ছে, সেটা বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। তিনি বলেন, দুবাই বা লন্ডনের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো একশ’ টাকার অনেক উপরে ডলার কিনছে।
ফলে ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় সর্বোচ্চ এক থেকে দুই টাকা লাভের কথা বলা হয়েছে। ডলারের ক্রয় হারের চেয়ে অনেক বেশি লাভে বিক্রি করার প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, কোন কোন ব্যাংক হয়ত বেশি মুনাফা করার একটু সুযোগ নিতে চেয়েছে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংকই কিন্তু নিয়মের মধ্যে থেকে ডলার কেনাবেচা করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, যারা খোলাবাজারে ডলারের অবৈধ ব্যবসা করছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জ হাউজের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ৪৫টিকে কারণ দর্শাতে (শোকজ) বলা হয়েছে। শোকজের পাশাপাশি আরও ৯টি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়েই ব্যবসা করে আসছিল।
এদিকে সঙ্কটের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে ২৫ টাকা বেশিতে, অর্থাৎ এখন ১২০ টাকায় খোলাবাজারে কিনতে হচ্ছে মুদ্রাটি। দেশের ইতিহাসে এর আগে এই ঘটনা কখনও ঘটেনি। গত ২৭ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের দর উঠেছিল ১১২ টাকা। এর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির পর কয়েক দিন সেখান থেকে কিছুটা কমে ১০৮ টাকায় থিতু হয়। কিন্তু চলতি সপ্তাহ থেকে আবার শুরু হয় উর্ধগতি।
সোমবার খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হয় ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দর সেদিনও ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। পরদিন তা আরও ৩০ পয়সা বাড়িয়ে করা হয় ৯৫ পয়সা। এর পরদিন খোলাবাজারে আবার লাফ দেয় ডলার। এক দিনে বাড়ে ৪ টাকা ৪০ পয়সা।
খোলাবাজার ব্যবসায়ীরা বলছেন, তীব্র সঙ্কট রয়েছে ডলারের। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে, বিদেশী পর্যটকরাও কম আসছেন। এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম। দিলকুশা দোহার মানি এক্সচেঞ্জে ডলার কিনতে আসা এক ক্রেতা বলেন, ‘প্রতি ডলার ১২০ টাকা চাচ্ছে। ব্যাংকরেট ৯৫ টাকা বললে প্রতিষ্ঠানটি বলে, ওসব বলে লাভ নেই। আমাদের যে রেটে দিতে পারব সেটা বলেছি। এতে সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকে গিয়েও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো বলছে ডলার নেই।’
ডলার সঙ্কট ও ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ মানি এক্সচেঞ্জ এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোঃ হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছি। অনেকের কাছ থেকে শুনছি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকা, ১১৭ টাকা, ১২০ টাকা। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, ১১২ টাকার বেশি দরে ডলার বিক্রি করব না। এটার বাস্তবায়ন রয়েছে সব হাউজে।
হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, তবে এখন ডলার বিক্রি আর আগের মতো নেই, নগদ ডলারের সঙ্কট রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযান শুরুর পর থেকে মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। এখন চাইলেই যে কেউ এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে ডলার নিতে পারছেন না। এখন অবশ্যই পাসপোর্ট-ভিসা দেখাতে হবে। তবে খুচরায় বেশি দাম নেয়া হচ্ছে কিনা, জানা নেই।