
মোরসালিন মিজান ॥ চন্দ্রমল্লিকার গল্পটা করি, আসুন। এখনই সময়। শীতকাল চলছে। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে বাগান। তবে যে ফুলটি সর্বত্রই কম বেশি চোখে পড়ছে সেটি চন্দ্রমল্লিকা। ফুলের দোকানে আর কোন ফুল থাক বা না থাক, আপনি চন্দ্রমল্লিকা পেয়ে যাবেন। আর নিজের বাগানে থাকলে তো কথাই নেই। কিন্তু চেনা এই ফুলকে আসলে কতটা চেনেন? তারাপদ রায়ের কথাই যদি বলি, কবি কিন্তু ফুলটি নিয়ে বেশ বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন। লিখেছিলেন: কোনটা যে চন্দ্রমল্লিকার ফুল/আর কোনটা যে সূর্যমুখী- বার বার দেখেও/আমার ভুল হয়ে যায়,/আমি আলাদা করতে পারি না...।
চন্দ্রমল্লিকা চেনা আসলেই কিছুটা মুশকিল। সূর্যমুখীর সঙ্গে এর ভাল মিল। জারবেরা সঙ্গেও। দোকানিরা প্রায়শই চন্দ্রমল্লিকা নাম করে জারবেরা ফুল ধরিয়ে দেন। চন্দ্রমল্লিকারও জাতপাত অনেক। একেকটি একেক রঙের। গঠনের দিক থেকেও কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এসব কারণে চট্ করে চন্দ্রমল্লিকা চেনা যায় না।
তো, চেনার সুবিধার্থেই বলি, ফুলটি বাইরের দেশে ক্রিসানথেমাম নামে পরিচিত। বাংলাদেশে চন্দ্রমল্লিকা। চন্দ্র বা চাঁদ থেকে চন্দ্রমল্লিকা নাম। ডাকা হয় চন্দ্রমুখী নামেও। অক্টোবরে এর কুঁড়ি আসা শুরু হয়। নবেম্বর থেকে ফুল। আর এখন তো জানুয়ারি। ভরা মৌসুম। সৌন্দর্যের সবটুকু নিয়ে ফুটে আছে চন্দ্রমল্লিকা। কোনটি ছোট টেনিস বলের মতো দেখতে। পাপড়ি ভেতরের দিকে মোড়ানো। কোনটির পাপড়ি বাইরের দিকে। ঝুলন্ত। কিছু ফুলের মাঝখানটা আবার চাকতির মতো।
রং দিয়েও চেনা যায় ফুলটিকে। চন্দ্রমল্লিকার, আগেই বলেছিলাম, অনেক রং। সাদা, হলুদ, মেরুন, হাল্কা গোলাপী, কালচে লাল- সবই গায়ে মেখে আছে। সাদা রং চন্দ্রমল্লিকা শুদ্ধতার প্রতীক। পবিত্র একটি আবহ তৈরি করে। এ বিবেচনায় প্রিয়জনের কফিনে, সমাধির ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয় সফেদ চন্দ্রমল্লিকা। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে এ দৃশ্য বেশি চোখে পড়ে। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়ায় সাদা চন্দ্রমল্লিকায় শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। প্রয়াত প্রিয়জনের স্মরণানুষ্ঠানে বা প্রার্থনাসভায়ও সাদা ফুলটি ব্যবহৃত হয়। তাই বলে সাদা চন্দ্রমল্লিকা মানে শুধুই শোক, এমন নয়। বিয়ের অনুষ্ঠানেও চন্দ্রমল্লিকার বিশেষ ব্যবহার হয়ে আসছে। নব দম্পতির শুভ কামনায় সাদা চন্দ্রমল্লিকা উপহার দেয়া হয়। জন্মদিনসহ আনন্দঘন উৎসব অনুষ্ঠানে অনিবার্য হয়ে ওঠে ফুলটি। জাপানে শুধু এই ফুলে বড় একটি উৎসব হয়। উৎসবের নাম- ফ্যাস্টিভ্যাল অব হ্যাপিনেস।
এবার আরও একটু পেছনে যাই। চলুন। জাপানে অষ্টম শতকে চাষ শুরু হয় চন্দ্রমল্লিকার। দেশটির এটি জাতীয় ফুল। জাপান থেকে ধীরে ধীরে ফুলটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রবেশ করে আশপাশের দেশগুলোতে। পনেরো শতকে চাষ শুরু হয় চীনে। চীন ও কোরিয়া ফুলটিকে বিশেষভাবে আপন করে নিয়েছে। দেশগুলোর মানুষ ফুলটিকে নিজেদের জ্ঞান করে। চন্দ্রমল্লিকা ১৭ শতকে আসে ইউরোপে। বর্তমানে প্রায় সব দেশেই হয়।
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে, ইউরোপ ও ইংল্যান্ডের প্রজাতিটির নাম ক্রিসানথেমাম সেগেটাম। এই গাছ ৩০ থেকে ৬০ সেমি লম্বা। ফুল চওড়ায় ৫ সেমি পর্যন্ত হয়। পাপড়িতে সাদা ও হলুদ রঙের মিশেল। কখনও আবার মাঝখানে বাদামি। পাপড়িতে হালকা হলুদ রং দেখা যায়। মেক্সিকোর প্রজাতিটির নাম ক্রিসানথেমাম কারিনেটাম। গাছ প্রায় ৬০ সেমি উঁচু। ফুলের পাপড়িতে সাদা হলুদ লাল গোলাপী কমলা ও বেগুনি রঙের মিশেল। পাপড়ির গোড়া ও মাঝখানে গাঢ় রং। চীন ও জাপানের প্রজাতি চন্দ্রমল্লিকা সঙ্করণ ও নির্বাচনের মাধ্যমে ইউরোপ ও আমেরিকায় শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো হয়। পাপড়ির গঠন ও ফুলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চন্দ্রমল্লিকা কয়েকটি শ্রেণীর হয়ে থাকে। হেয়ারি, কেয়ারি, জাপানিজ, ইনকারভড, পমপরা ইত্যাদি এ ফুলের উন্নত জাত। বর্তমানে শুধু থাইল্যান্ডে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার জাতের চন্দ্রমল্লিকা হয়।
কি, অবাক হচ্ছেন? না, বাংলাদেশে অতো জাত পাত নেই। তবে যে কটাই আছে, সুখ বা দুঃখের অনুভূতিগুলোকে ধারণ করে আছে। তাই সুখের ফুল এবং শোকের ফুল চন্দ্রমল্লিকা।