
সমুদ্র হক ॥ শকুন। কুসংস্কারের ফাঁদে সাধারণের কাছে কথিত অলক্ষুণের প্রতীক। বিশ্বের জীববৈচিত্রে উপকারী পাখি। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতা কর্মী হয়ে বিষাক্ত বায়ুর থাবা থেকে রক্ষা করছে মানবজাতিকে। এই শকুন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কখনও খাবার না পেয়ে। কখনও মানুষের হিংস্রতার শিকার হয়ে। দেশে শকুনের সংখ্যা মাত্র ২শ’৬০ টি। বিশ্বে ১৮ প্রজাতির শকুনের দেখা মেলে। যে সংখ্যা খুব কম। শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস। বাংলাদেশেও পরিবেশবিদগণ আজ দিবসটি উদযাপন করছেন।
বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির শকুন বড় বড় গাছে লুকিয়ে বাস করছে। এর মধ্যে দুই প্রজাতি স্থায়ী। বাকিরা পরিযায়ী। আসা-যাওয়া করে ভরবছর। এদেরই একটি জাত হিমালয়ান গৃধিনী। হিমালয়ে খাবার না পেয়ে ডানার শক্তি হারিয়ে সম্প্রতি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার জুড়ি অনন্তপুর গ্রামে এবং শাজাহানপুর উপজেলার গ্রামে দুটি বৃহদাকার শকুন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এদের ভাগ্য ভাল। হিংস্রতার কবলে পড়েনি। বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা পরিবেশবাদী সংগঠন তীরের কর্মীরা উদ্ধার করে বাঁচিয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর এদের পাঠানো হয় দিনাজপুরের পরিচর্যা কেন্দ্রে।
শকুন বিলুপ্তির কারণে দেশে এ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক ও অন্যান্য জুনোটিক রোগের সংক্রমণ ঘটছে। শকুনের প্রজাতিগুলোকে রক্ষার লক্ষ্যে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন নেচার (আইইউসিএন) দেশে দেশে নানা কর্মসূচী নিয়েছে। বাংলাদেশে বন অধিদফতর ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর শকুন রক্ষায় নিরাপদ দুটি জোন ঘোষণা করেছে। যার আয়তন ৪৭ হাজার ৩শ’ ৮০ বর্গকিলোমিটার। সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়ির ১৯ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এক নম্বর জোন। দ্বিতীয় জোনের আয়তন ২৭ হাজার ৭শ’ ১৩ বর্গকিলোমিটার। এর আওতায় পড়েছে ফরিদপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাদারীপুর, নড়াইল, শরিয়তপুর, বরিশাল, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালি ও বরগুনা।
১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশের ৯৯ শতাংশ শকুন হারিয়ে গেছে। এরপর শকুন বিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধান শুরু হয়। দেখা যায়- পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রফেন ওষুধ শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। এই ওষুধ যে পশুর পেটে থাকে সেই পশু মারা গেলে এবং শকুন তা খেলে দিনাদুয়েকের মধ্যে মারা যায়। শকুন রক্ষায় ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে প্রমান করে দিয়েছেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ওষুধ প্রয়োগের কারণে শকুন বিলুপ্ত হচ্ছে। শকুন রক্ষায় দেশে ২০১০ সালে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও শকুনের নিরাপদ এলাকায় ২০১৭ সালে কিটোপ্রফেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই দুই ওষুধের পরিবর্তে পশু চিকিৎসায় মেলেক্সিকান ওষুধ প্রয়োগের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
আইইউসিএনের বাংলাদেশের কনসালট্যান্ট মোঃ মিজানুর রহমান জানান, আইইউসিএন ও বন অধিদফতর বাংলাদেশের দুই এলাকাকে শকুনের নিরাপদ আশ্রম ঘোষণা করেছে। একটি হলো, সিলেটের রেমাকালিঙ্গা। অপরটি সুন্দরবন সংলগ্ন ৬টি পয়েন্ট। সেখানে বিশেষায়িত খাদ্য গুদামে শকুনের খাবার সংরক্ষণ করা হয়। কোন পশু মারা গেলে তা শকুনের ভক্ষণের আগে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এর বাইরে অসুস্থ শকুনের চিকিৎসা ও পরিচর্যায় নাটোরের সিংড়া জাতীয় উদ্যানে একটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
বন অধিদফতর জানায়, সত্তরের দশকে দেশে যত শকুন দেখা যেত তার ৯৮ শতাংশই বিলুপ্ত হয়েছে। শকুনের প্রধান খাদ্য মৃত প্রাণীর মাংস। তীক্ষ দৃষ্টি ও ঘ্রাণ শক্তির অধিকারী হিসেবে শিকারি পাখি শকুন মৃত পশুর সন্ধান পায়। বিশ্বে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতি ও পূর্ব গোলার্ধে ১১ প্রজাতির শকুন টিকে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে আছে ৬ প্রজাতি। এগুলো হলো : বাংলা, রাজ, গ্রীফন, হিমালয়ী, ইউরোপীয় ও কালা শকুন। গ্রীফন প্রজাতির শকুন চোখে পড়ে না। মহাবিপদের মধ্যে আছে রাজ শকুন। রাজ শকুন বাচ্চা ফুটানোর জন্য ঠোঁটে পাথর বহন করে ডিমের ওপর নিক্ষেপ করে।
আইইউসিএন জানায়, গত শতকের ৮০’র দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপালে প্রায় ৪ কোটি শকুন ছিল। এই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৪০ হাজারে। গত তিন দশকে উপমহাদেশে ৭৫ শতাংশ শকুন মারা গেছে। ভারতে প্রতিবছর ৩০ শতাংশ করে শকুন মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে শকুন বিলুপ্তির পথযাত্রায় টিকে আছে। প্রজননের মাধ্যমে শকুন উৎপাদন হচ্ছে না। খাদ্য শৃঙ্খলে শকুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন মরা-পচা খেয়ে এরা রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। একদল শকুনের একটি মরা বড় গরু ভক্ষণে সময় নেয় মাত্র পনেরো মিনিট। শকুনের গলা, ঘাড় ও মাথায় কোন পালক থাকে না। প্রশস্থ ডানায় খাবারের সন্ধানে এরা একটানা ৩২ হাজার বর্গকিলোমিটার উড়তে পারে। এদের আবাস পুরাতন বট-পাকুড় অশত্থ, ডুমুরসহ বিশাল শাখা প্রশাখার গাছ। কখনও থাকে গুহা ও পর্বতের চূড়ায়। শকুনের আবাসের বড় বৃক্ষ কাটা হচ্ছে। বগুড়ার প্রবীণ ব্যক্তি মাসুদার রহমান বললেন, আগে অনেক শকুন দেখেছেন। এখন চোখে পড়ে না। স্মৃতি থেকে বললেন, কোথাও মরা গরু পড়ে থাকলে একটি শকুন উড়ে গিয়ে অন্য শকুনদের খবর দেয়। বিভিন্ন স্থান থেকে দলবেঁধে উড়ে এসে জড়ো হয়। প্রধান শকুন আসার পর ওরা মরা পশু খেতে শুরু করে।