তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে ॥ সুন্দর পৃথিবীকে পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য রাখতে গাছের কোন বিকল্প নেই। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট ভূ-ভাগের প্রায় ২৫ ভাগ বনভূমি দরকার। গাছ মানুষের বন্ধু ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপকরণ। কিন্তু সব গাছ মানুষের জন্য উপকারী কিংবা পরিবেশবান্ধব নয়। মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে রাক্ষুসী গাছ ইউক্যালিপটাস। এই ইউক্যালিপটাস গাছের হাজার হাজার বাগান ও পথঘাটের ধারে সারি সারি ইউক্যালিপটাস পরিবেশের কি ক্ষতিই না করেছে তা উত্তরাঞ্চলের গ্রামের মানুষজন বুঝতেই পারছে না। অথচ এ গাছের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে এ অঞ্চলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন একটি পানিখেকো ইউক্যালিপটাস ৪০ থেকে ৫০ লিটার পানি শোষণ করে মাটিকে নিরস ও শুষ্ক করে ফেলে। এছাড়া মাটির নিচের গোড়ায় ২০-৩০ ফুট জায়গা নিয়ে চারদিকে থেকে গাছটি পানি শোষণ করে বলে অন্যান্য ফলদ গাছের ফলন ভাল হয় না। এতে খরা যেমন লেগেই থাকছে তেমনি বর্ষাকালে নেই বৃষ্টি এতে করে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। কমছে বৃষ্টিপাত। এর সবই ইউক্যালিপটাস গাছের কারণে ক্ষতিকর প্রভাব বলে মনে করেন অনেকেই। জানা যায়, ইউক্যালিপটাসের আদিবাস অস্ট্রেলিয়ায়। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) উদ্যোগে ইউক্যালিপটাসসহ বিভিন্ন বিদেশী দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির গাছ আমাদের দেশে আসে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে উপজেলা পর্যায়ের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী এবং সরকারের বন বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি, পাইন ইত্যাদি বিদেশী গাছ ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়েছে। এ গাছের চারা প্রথমে ব্যাপকভাবে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশের জলবায়ু, মাটি ও কৃষি জমি তো বটেই দ্রুত বর্ধনশীল এই গাছটি পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। সাধারণ মানুষের ওপর একসময় ইউক্যালিপটাস চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ক্ষতিকারক দিক স¤পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছাড়াই।
তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিবেশ উপযোগী না হওয়ায় ২০০৮ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে দেশে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কৃষক বা নার্সারি মালিকরা না জেনে ইউক্যালিপটাসের চারা বপন করছেন। এভাবেই গড়ে উঠেছে শত শত ইউক্যালিপটাসের বাগান। নিষিদ্ধ গাছটির চারা উৎপাদনের সরকারী নিয়ম-নীতির কথা জানেন না স্থানীয় নার্সারি মালিকরা। এতে করে উত্তরাঞ্চলের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার, বাসাবাড়ি রাস্তা-ঘাটে, খেলার মাঠে, হাটবাজারসহ ফসলের মাঠজুড়ে অন্যান্য ফসলের সঙ্গে ব্যাপকভাবে শোভা পাচ্ছে ইউক্যালিপটাস গাছ। সবকিছু মিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। ছয় ঋতুর পরিক্রমায় ক্যালেন্ডারের পাতায় এখন চলছে বর্ষাকাল। কিন্তু বর্ষাকাল এলেও উত্তরাঞ্চলের আকাশে বৃষ্টি নেই। আষাঢ়ে চলছে খরতাপ। যা এর আগে দেখেনি উত্তরের মানুষ। অতিষ্ঠ জনজীবন। কাঠফাঁটা রোদ আর গরমে হাসফাঁস করছে প্রাণিকুল। স্থানীয় মানুষজন বলেন, বৈশাখ মাসে হাঁটু জলও থাকে না। আর আষাঢ় মাসে বৃষ্টিও নেই। খালি রোদ আর গরম। বেশিরভাগ নদী বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেয়ার জন্য উত্তরাঞ্চল আরও শুকনো হয়ে যাচ্ছে। এই রকম শুকনো জমিতে ইউক্যালিপটাস গাছটি রোপণ করার মানে নেই। রংপুর বিভাগে ব্যাপকভাবে ছেয়ে গেছে ইউক্যালিপটাস গাছ। পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা রংপুর ও সৈয়দপুর ইত্যাদি এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এর বিস্তার অনেক। সচেতন মহল বলছে আমাদের জলবায়ুর জন্য ইউক্যালিপটাস গাছ মোটেই উপযোগী নয় উপরন্তু মাটি থেকে অতিমাত্রায় পানি শোষণ করে মারাত্মকভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। কৃষকরা অনেকটা না জেনেই ইউক্যালিপটাস গাছ, কৃষিজমির পাশে, বাড়ির আঙিনায় ও রাস্তার পাশে ব্যাপকভাবে রোপণ করছেন। ফলে ভূগর্ভে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ ব্যবস্থা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষীরা। দেখা গেছে, জমির আইলে ইউক্যালিপটাস রোপণ করার পর থেকে ক্ষেতে আর পানি থাকে না।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, ২০০৮ সালে উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৬.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দশ বছর পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। আর গত তিন বছরে রংপুর অঞ্চলে অর্ধেকে নেমে এসেছে বৃষ্টিপাত। রংপুর আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এমন হচ্ছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের ইউক্যালিপটাস গাছ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় তাপমাত্রা বাড়ছে। বসবাসের পরিবেশের জন্য যে সকল বৃক্ষরোপণের প্রয়োজন ঠিক সেভাবে বনায়ন হচ্ছে না।