ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঈশপের চশমায়

দিলরুবা শাহানা

প্রকাশিত: ১৭:০৯, ১২ জুন ২০২৫

ঈশপের চশমায়

ওরা তিন বান্ধবী। কিভাবে কিভাবে যেন ওদের মেলবোর্নে মিলন ঘটলো। ঈদের সকালেই গোসল সেরে নতুন পোশাক-আশাকে সজ্জিত হয়ে আতর লোবাননয় পারফিউম ঢেলে মৌ মৌসুবাসে বাতাস মোহিত করে ওরা প্রথমে গেল ঈদের নামাজে।
তিনজনের একজন সদ্য বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছে। ছোটবেলাতে কিছুদিন তিনজন একসাথে ময়মনসিংহে স্কুলে পড়েছিলো। বাকি দুজন এদেশে আছে অনেকদিন। তাদের সন্তানরাও ইউনিভার্সিটি শেষ করবে শীঘ্র। বাংলাদেশ থেকে আসা রাফিয়া নিঃসন্তান। বিশাল ট্রাভেল এজেন্সির মালিক নিজে। স্বামীও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্ণধার। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে প্রায় সব মহাদেশ ঘুরেছে বাকি ছিল অস্ট্রেলিয়া। এবার তাই অস্ট্রেলিয়া আগমন।
রাফিয়ার ভাইয়ের বাসা থেকে তিন বান্ধবীর ঈদ আনন্দ ভ্রমণ শুরু। অন্য দুজন ডলি ও রওনক। তারা বললো
-মেলবোর্নে ঈদ দেখাবো তোমাকে, কত মজার কাণ্ড দেখবে চল।
প্রথম মসজিদ নাম দেওয়া এক বড় ঘরে নামাজ পড়তে গেল তারা। রাফিয়ার জন্য এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সে গোড়া নয়। তবে মেয়েদের বসার জায়গাটা অস্বস্তিকর রকমের খোলামেলা লাগলো। রাফিয়ার মনে হলো মেয়েদের নামাজের জায়গা স্বতন্ত্র হলে শোভন হতো। খোলামেলা হওয়াতে পুরুষদের সবাই নয় কেউ কেউ মেয়েদের ঈদসজ্জার প্রদর্শনী দেখতেই বেশি মনোযোগী হলেন। ঈদ মেলা হলে বিষয়টা মানা যেতো হয়তো। নামাজ বলে কথা। মেয়েরা ব্যস্ত সাজসজ্জার সচেতন প্রদর্শনে। শিশু-কিশোর-পুরুষরা ব্যস্ত বিভিন্ন বাড়ি থেকে নিয়ে আসা মুখরোচক খাবার আস্বাদনে। বাংলাদেশে মসজিদে যাওয়া হয়নি কখনো এই অভিজ্ঞতা রাফিয়ার কাছে অভিনব।
নামাজ শেষে পরিচিত বন্ধুবান্ধবের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো ওরা। রাফিয়া চুপচাপ দেখছে আর ভাবছে। আবহাওয়া চমৎকার, দিনটিও ছুটির। ঈদের নয় তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তায় গিজ গিজে ভিড় নেই, গাড়ি-বাসে ধুলার আস্তরণ নেই। এমন নির্মল পরিবেশে মনের আনন্দে চুটিয়ে ঈদ উৎসব উদ্যাপন করছে কিছু লোকজন। মিষ্টি ভাষী রওনক বললে
‘রাফিয়া কিছু বললে না যে,’
‘কি বলবো বল?’
ডলি তখন অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠলো
‘কেন নামাজ কেমন লাগলো?’
‘নতুনরকম, আগে কখনো এমন দেখিনি তো’।
রাফিয়ার গলার স্বর এমনি শান্ত ধীরস্থির শুনে বোঝার উপায় নেই মন্দ লেগেছে নাকি আনন্দ পেয়েছে। 
তারপর তারা গেল একজনের বাড়ি ঈদ মোলাকাত করতে। সুন্দর লন বাগানসহ বড়সর বাড়ি। বাড়ির মেজবান হেনা অতিথিদের আন্তরিক উষ্ণতায় ভরিয়ে দিলো। নানা ধরনের টকণ্ড মিষ্টি ও ঝাল খাবারের এন্তার আয়োজন। খাবার দাবার রাখাও হয়েছে সর্বাধুনিক নানা আকারের শে^ত পাথরের মতো তৈজসপত্রে। হেনা নিজের হাতে এটা সেটা প্লেটে তুলে দিতে চাইছিল। ওরা তিনজন অনেক দোহাই, অনেক অনুরোধ উপরোধ শেষে হেনার অত্যাচারী আপ্যায়নের হাত থেকে রেহাই পেল। ডলি যদিও প্রত্যেকটি খাবারের পদ সম্পর্কে খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করলো। তারপরে হঠাৎ যেন আবিষ্কার করলো হেনা নতুন কিছু করে ফেলেছে এবার। তখনি সে ধরে বসলো
‘হেনা ব্যাপার কি বলতো, গতবার ঈদে সব পদ নিজের হাতে তৈরি করেছিলে, যারাই খেয়েছে কত সুনাম করেছে তোমার। এবার সব কিনে এনেছ মনে হচ্ছে’
মুখ ব্যাজার করে হেনা বললো
‘ঠিক ধরেছ, একটাও নিজের হাতে বানাইনি। রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে সব বানিয়ে এনেছি’
তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বললো
‘নিন্দুকরা আর বলার সুযোগ পাবে না যে আমি কঞ্জুস, কিপ্টা টাকা বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে খাবার বানাই সবসময়’
দম ফেলে প্রায় ভেজা গলায় আবার বললো হেনা
‘আমার রান্না মজা মজা বলে তারা খেয়েছে চেটেপুটে ঠিকই কিন্তু আমার আন্তরিক খাটনির জন্য কোথাও এতটুক ুপ্রশংসার বাক্য উচ্চারণ করেনি কেউ’
এই ফাঁকে রওনক রাফিয়াকে ফিস ফিসিয়ে জানালো যে চারপাশে হেনার নামে কিপ্টামীর বদনাম ডলিও ছড়িয়েছে। ডলিই ব্যথিত হেনাকে আলিঙ্গন আর আদর করে ওদের নিয়ে ঐ বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি সটকে পড়লো। 
গাড়িতে যেতে যেতে ডলিকে আশাহত মনে হলো। হয়তো বাকিপ্টা দর্নিামটা হেনার গা থেকে খসে পড়ার দুঃখে। এক সময়ে সে নিজেই যেন প্রাণ ফিরে পেল। এবার শুরু করলো খাদ্য নিয়ে আলোচনা।
‘দেশে কিন্তু ঘরে তৈরি নানা পদের খাবারের মাঝে বাড়ির কর্ত্রীর গুণপনা আর পরিবারের খান্দানিয়ানা দেখা যেতো, এখনো কি এমন হয় রাফি?’
রাফিয়া একটু সময় নিয়ে কথা শুরু করলো
‘হয়, আবার হয়ওনা’
‘কি রকম বলতো?’
রওনকের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা।
‘যেমন মেহমান ডাকলে মানুষ ঘরেও নিজের হাতে কিছু কিছু পদ তৈরি করে আবার বাইরে থেকেও দু’এক পদ কিনে আনে’
‘বাইরে থেকে কি মিষ্টি টিষ্টি কিনে আনে?’
আবার ভাবলো রাফিয়া
‘এখন দাওয়াতে দেখি ঢাকা ক্লাবের আচার গোস্ত আর কস্তুরীর চিতল মাছের কাটলেট খুব আনিয়ে নেয়, মাছের ফিলেট রানèাও রেস্তোরা থেকে আনায় অনেকে’
‘সবচেয়ে ভাল লেগেছে কোনটা?’
ডলির গোলগাল স্বাস্থ্যবতী সুখী চেহারাবলে দেয় তার খাদ্যাসক্তির কথা। প্রশ্নটাও তাই তার
‘শেষ দাওয়াতে সব খাইনি তো আর হরেকরকম পদ রাক্ষসও পারবে না সব খেতে, তাই কোনটার চেয়ে কোনটা ভালো বলতে পারবো না তবে ঘরে নিজের হাতে তৈরি ডিমের হালুয়া ছিল খুব ভাল; শক্ত দানা দানা নয় আবার জাফরান দেওয়াতে ডিমের গন্ধ ছিলনা একটুও’
ডলিবলে
‘একেই বলে খান্দানি ঘরোয়া রান্না! হেনার হাতের রান্না বেশ মজা।’
তারপর উষ্মা উগরে বললো ‘কম পদ করতি নিজের হাতে করতি মানুষ তৃপ্তি করে খেতো তা নয় পয়সার প্রদর্শনীর জন্য টেবিলের এ মাথা থেকে ও মাথা রেস্টুরেন্টের কেনা খাবারে বোঝাই; দেখেছ কিরকম অর্থের বড়াই!’
রাফিয়া অবাক হয়ে ভাবলো গত বছর নাকি এই ডলিই হেনাকে কিপ্টা বলে ওর যত্ন করে তৈরি শখের রান্নাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, এবার করছে হেনার ধনদৌলত দেখানেপনার মুন্ডুপাত। রাফিয়া ভাবলো মানুষ বড় আজব জীব। রওনক বললো
‘এবার যে বাড়িতে যাবে সেখানে দেখবে খাবারের মাঝে শুধু দোকানের কেনা খাবার, সব দেশের খাবার পাবে ইন্ডিয়ান, গ্রিক, ইতালিয়ান, লেবানিজ, টার্কিশ সব রয়েছে...
‘কি করে জানলে?’
‘গত ঈদে দেখলা মতো, জানমেয়েটা দুনিয়ার অলস আর আমড়াকাঠের ঢেকি; ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে চাকরি করে এইটুকুই সার, হাতের কাজের বেলায় লবডঙ্কা’।
যাকে রওনক আমড়াকাঠের ঢেকি আর কাজের বেলায় লবডঙ্কা বলেছে তার বাড়িতে আরেক চমক অপেক্ষা করছিল।
বিরাট বিশাল বাড়ি নয়। তবে খুব ছিমছাম করে সাজানো। আসবাবপত্রে জৌলুস নাই তবে রুচির বিকিরণ আছে। ছোট্ট কয়েকটি মাত্র পর্সিলিনের টবে ছোট ছোট নানা ধরনের অর্কিড। বোঝাই যায় এ ধরনের জিনিস অনেক যত্ন আর ভালোবাসায় তৈরি।
বাড়ির কর্ত্রী নওশাবা ছিপছিপে গড়নের নারী। মিষ্টিভাষী চটপটে স্বভাবের। তার খাবার টেবিলে একগাদা খাবারের সমারোহ নাই। তবে যাই আছে সব মনোলোভা। ঝালমিষ্টি-নোনতা সবই আছে তবে পরিমিত। উপচেপড়া খাবার দিনের শেষে বিনে যাবার দুর্ভাগ্যের কবলে পড়বে না। মিষ্টি খাবার জর্দা সেমাই, কাষ্টার্ড, কেক। নুনতা খাবার কাবাব, চিজ অন পটেটো, লুচি, আবার লাল আটার তৈরি লুচির আকৃতির হাতে গড়া রুটি। মোরগ পোলাও, ফ্রাইড রাইস ছিল। পাশেই কালো চোকৌ বাটিতে ইয়োগার্ত-মিন্ট (টকদই, পুদিনাপাতা, কাঁচামরিচ, চিনি, লবণ দিয়ে) সস। ঘি-মিষ্টির সাথে প্রশান্তি দেবে এই সস।
নওশাবার ঈদ আয়োজন দেখে ডলি আর রওনক বিস্মিত। নওশাবা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করার মানুষ না। অতিথিদের রুচি ও পছন্দকে সম¥ান দেখিয়ে তাদের যার যা ভাল লাগে দেখে শুনে তুলে নেওয়ার অনুরোধ করলো।
কাবাব, চিজ অন পটেটো আর ইয়োগার্ত-মিণ্টসস খুব চললো। রওনক ও ডলি বললো
‘দারুণ হয়েছে, রেসিপি দিও প্লিজ’
‘রেসিপি দেব অবশ্যই তবে একটা জিনিসের মাপ বলতে পারবো না, যার উপরেই আসলে নির্ভর করে মজা সেটা আপনারা আন্দাজ মতো দেবেন’
রওনক জানার জন্য মরিয়া হয়ে বললো
‘সেটি কি বলতো ভাই?’
রহস্যের হাসি হেসেনও শাবা বললো
‘বলছি নামটা পরে তবে পরিমাপ পার্সন টু পার্সন ভেরি করবে কিন্তু’
ডলি এরই মাঝে নিচু গলায় রাফিয়াকে বললো যে নওশাবার সব সময় বাহাদুরী ফলানো চাই। গতবার একগাদা খাবার কিনে এনে করেছে পয়সার প্রদর্শনী এবার গাধার খাটুনী খেটে গুণের গরিমা দেখাচ্ছে। 
রাফিয়া অবাক হলো দেখে যে ঈশপের চরিত্ররা আজও চারপাশে কেমন সুন্দর বেঁচেবর্তে আছে। এদের খুশি করতে গেলে জীবন বরবাদ হয়ে যাবে তবু এরা খুশি হবে না। ঈশপের গল্পের বুড়ো তার ছেলে আর গাঁধা তিনজন কি বিপদেই নাপড়েছিল চলার পথে সবার মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে।
“বুড়ো আর তার ছেলে যাচ্ছে সঙ্গে তাদের গাধাটিও রয়েছে। কিছু লোক বললো ‘বোকা কোথাকার! গাধার কাজ বোঝা টানা ওকে শুধু শুধু আরাম করিয়ে হাঁটাচ্ছে’। বুড়ো ছেলেকে গাধার পিঠে বসিয়ে চললো এবার। পথিকরা তখন বললো ‘বুড়ো মানুষটা কষ্ট করে হেঁটে যাচ্ছে জোয়ান ছোকরা কিনা আয়েস করে গাধার পিঠে বসে’। ছেলেকে নামিয়ে বুড়ো চড়ে বসলো। তখন আরেক দল বুড়োকেও টিটকারী দিল। তারপর ছেলেকেও টেনে তুলে পাশে বসালো লোকটি। এবার অন্য ক’জন বললো ‘দেখ কি নিষ্ঠুর ওরা! দুদুটো মানুষ গাধার পিঠে কেমন করে চড়তে পারলো’। মানুষকে খুশি করার জন্য বাপ-ছেলে এবার গাধাকে বেঁধে ছেদে কাঁধে নিয়ে চললো। সেতু পার হওয়ার সময়ে ভয়ে ছট্ফট্ করতে থাকা গাধা ছিট্কে পানিতে পড়ে তলিয়ে গেল।”
গল্প থেকে বাস্তবে ফিরলো রাফিয়া রওনকের তাড়াতে।
চলে আসার সময়ে দরজার বাইরে পা ফেলতে ফেলতে রওনক বললো
‘নওশাবা এবার তাইলে বল রেসিপির ঐ আইটেমের কিনাম?’
‘এর নাম আন্তরিকতা।’

প্যানেল

×