ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বোহেমিয়ার স্ক্যান্ডাল

মূল : আর্থার কোনান ডয়েল, অনুবাদ : খুররম মমতাজ

প্রকাশিত: ১৬:৫৮, ১২ জুন ২০২৫

বোহেমিয়ার স্ক্যান্ডাল

‘এখনো জানি না। যথেষ্ট তথ্য নেই আমার হাতে। তথ্য ছাড়া আগেভাগেই কিছু ভেবে নেয়া ঠিক হবে না- তাতে ভুল হতে পারে।  কিন্তু এই নোট থেকে তুমি কী বুঝলে বলো তো?’   
‘ধনী ব্যক্তির লেখা।’ আমার বন্ধুর অনুকরণ করে ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করলাম। ‘দামি কাগজ দেখে তাই মনে হয়। কাগজটা একটু অন্যরকম, পুরু আর শক্ত।’
‘হ্যাঁ অন্যরকম, এটাই আসল কথা।’ হোমস সায় দিল। ‘এদেশে তৈরি নয় কাগজটা। আলোর দিকে তুলে ধরো, দেখতে পাবে।’
তাই করলাম। দেখলাম কাগজের ভিতরে Eg P Gt এরকম কিছু লেখা।
‘কী দেখলে?’ প্রশ্ন করলো হোমস।
‘মনে হয় আমাদের কোনো কাগজ কোম্পানির মনোগ্রাম হবে।’
‘মোটেও না। এই কাগজ এদেশে তৈরি নয়। Gt হচ্ছে ellschaftt শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। P মানে পেপার। এবার দেখা যাক Eg…’’
বইয়ের তাক থেকে ইয়া মোটা একটা বই নামালো হোমস। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললো, ‘দেখা যাক, কন্টিনেন্টাল গেজেটিয়ার কী লিখেছে। এই যে Eglow, Eglonitz...পেয়েছি Egria...জার্মানির বোহেমিয়ার একটা জায়গা- গ্লাস ফ্যাক্টরি আর পেপার মিলের জন্য বিখ্যাত। কী বুঝলে ওয়াটসন?’ খুশিতে চকচক করে উঠলো হোমসের চোখ। জোরে পাইপ টানতে টানতে নীল রঙের ধোঁয়া উড়াতে লাগলো সে।
‘বোহেমিয়ায় তৈরি এই কাগজ।’
‘ঠিক। যে লোকটা লিখেছে সে জার্মান। নোট পড়েও কিছুটা বোঝা যায়। ফ্রেঞ্চ কিংবা রাশানরা এভাবে লেখে না। এখন দেখা যাক, বোহেমিয়ার মুখোশধারী জার্মান একটা লোক আমাদের কাছে কী চায়। ওই যে, সে এসে গেছে।’
বলতে বলতেই রাস্তায় ঘোড়ার খুরের খটাখট শব্দ আর চাকার আওয়াজ পাওয়া গেল। কোচোয়ান রাশ টেনে ধরেছে। ‘মনে হচ্ছে জোড়া ঘোড়ায় টানা ব্রুহাম,’ হোমস বললো। উঠে জানালা দিয়ে উঁকি দিল সে। ‘হ্যাঁ। দারুণ দুটো ঘোড়া। একটার দামই কমপক্ষে দেড়শ গিনি হবে। মালদার পার্টি, ওয়াটসন।’
‘আমি বরং চলি তাহলে, হোমস।’
‘চলি মানে? তোমাকে থাকতে হবে ওয়াটসন। তুমি ছাড়া আমি অচল। কেসটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে- মিস ক’রো না।’
‘কিন্তু তোমার ক্লায়েন্ট যদি...।’
‘ক্লায়েন্টকে নিয়ে ভেবো না। তোমার সাহায্য আমার দরকার। এই যে সে এসে গেছে। ইজিচেয়ারটায় আরাম করে বসো, ডাক্তার।’
সিঁড়িতে ভারি পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, ধীরে ধীরে উঠে আসছে শব্দটা উপরে- করিডোর পার হয়ে দরজার ওপাশে এসে থামলো। তারপর জোরে জোরে নক।
‘ভেতরে আসুন।’ হোমস বললো।
কমপক্ষে সাড়ে ছয় ফিট লম্বা একটা লোক ঘরে ঢুকলো। হারকিউলিসের মতো তার বুক, হাত আর দেহের গড়ন। দামি জমকালো পোশাক, এতটাই জমকালো যে ঠিক রুচিশীল বলা যায় না- দামি কোট, ক্লোক, ব্রুচ আর মূল্যবান পাথরে অর্থবিত্তের অশ্লীল প্রদর্শনী। পায়ে ফারের লাইনিং দেয়া একজোড়া বুট। মুখে মুখোস। মুখোসের আড়াল থেকে চিবুক ও মুখের যেটুকু অংশ দেখা যায়, তাতে দৃঢ়-সংকল্প গোঁয়ার টাইপ একটা মানুষ বলে মনে হয়।
‘আমার নোট পেয়েছেন?’ গম্ভীর কর্কশ লোকটার গলা। কথায় জার্মান টান। ‘আমি আসবো বলেছিলাম।’ একবার আমার দিকে একবার হোমসের দিকে তাকাচ্ছে সে। কার সঙ্গে কথা বলবে যেন ঠিক করতে পারছে না।
‘দয়া করে বসুন।’ হোমস বললো। ‘ইনি আমার বন্ধু ও কলিগ ডক্টর ওয়াটসন। আমি কার সঙ্গে কথা বলছি?’
‘বোহেমিয়ার একজন নোবলম্যান, কাউন্ট ভন ক্রামের সঙ্গে কথা বলছেন আপনি। আপনার বন্ধু এই ভদ্রলোককে কি বিশ্বাস করতে পারি? নাহলে আপনার সঙ্গে একাকী কথা বলতে চাই আমি।’
চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। হোমস আমার হাত চেপে ধরলো, বসিয়ে দিল চেয়ারে। ‘কথা দুজনের সামনে বলতে হবে, নাহলে নয়।’ বললো হোমস। ‘আমাকে যা বলতে চান, ওনার সামনে নির্দ্বিধায় তা বলতে পারেন।’
কাউন্ট কাঁধ ঝাঁকালো। ‘তাহলে শুরু করা যাক।’ বললো সে। ‘বিষয়টি অতি গোপনীয়। যদি বলি এই মুহূর্তে এর ওপর নির্ভর করছে ইউরোপের ভবিষ্যৎ- তাহলে বেশি বলা হবে না। দুই বছর পর এই ঘটনা গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। তাই আমি চাই দুটো বছর আপনারা গোপনীয়তা রক্ষা করবেন।’
‘কথা দিচ্ছি।’ হোমস বললো।
‘আমিও।’ আমি বললাম।
‘মুখোস পরেই কথা বলতে হচ্ছে আমাকে।’ রহস্যময় আগন্তুক বলতে থাকলো। ‘যিনি আমাকে এই কাজে নিয়োগ দিয়েছেন, সেই সম্মানিত ব্যক্তি চান না আমার পরিচয় প্রকাশ পাক। আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার- যে নামে আমি নিজের পরিচয় দিয়েছি, সেটা আমার আসল পরিচয় নয়।’
‘আমি জানি।’ 
‘বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর। সেজন্যই এত গোপনীয়তা। যাতে ইউরোপের বিখ্যাত একটি রাজ পরিবার স্ক্যান্ডালের শিকারে পরিণত না হয়। আরও খুলে বলি- এর সঙ্গে জড়িত বোহেমিয়ার রাজ পরিবারের মান-সম্মান।’
‘এটাও আমার জানা।’ অস্ফূট কণ্ঠে বললো হোমস। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুঁজলো সে।
আগন্তুক একটু অবাক চোখে হোমসের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বোঝাই যাচ্ছে তার প্রখর বুদ্ধিমত্তায় লোকটা বিস্মিত হয়েছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো হোমস তার বিশালদেহী ক্লায়েন্টের দিকে।
‘ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমাকে সব খুলে বলুন।’ বললো হোমস। ‘তাহলে আমার পক্ষে সহজ হবে আপনাকে সহযোগিতা করা।’
লোকটা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে উত্তেজিত ভঙ্গিতে ঘরময় পায়চারি শুরু করলো। হঠাৎ সে টান মেরে মুখোসটা খুলে ছুড়ে ফেললো মেঝেতে। ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন।’ বললো সে। ‘আমিই রাজা। সত্য গোপন করে আর কী হবে।’
‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।’ মৃদুকণ্ঠে বললো হোমস। ‘আমি আপনাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি।’
‘বুঝতেই পারছেন।’ বললো রহস্যময় আগন্তুক, আবার চেয়ারে বসেছে সে, কপালে হাত বোলাচ্ছে। ‘এরকম কাজে আমি অভ্যস্ত নই। কিন্তু বিষয়টা এতই গোপনীয় আর সংবেদনশীল যে কারও উপর ভরসা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই নিজেই এসেছি ছদ্মবেশে, প্রাগ থেকে এতদূর- শুধু আপনার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য।’ (চলবে...)

প্যানেল

×