ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

ধা রা বা হি ক

মর্গ স্ট্রিটের হত্যা রহস্য পর্ব-২

মূল: এডগার অ্যালান পো, অনুবাদ: খুররম মমতাজ

প্রকাশিত: ২২:২৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মর্গ স্ট্রিটের হত্যা রহস্য পর্ব-২

মর্গ স্ট্রিটের হত্যা রহস্য পর্ব-২

(পূর্ব প্রকাশের পর)
কাজেই ‘স্টেরেওটোমি’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে এটমের কথাও তোমার মনে আসা স্বাভাবিক। সেই থেকে এপিকিউরিয়াস- কেননা এই দার্শনিক সম্পর্কে সেদিনই আমরা আলাপ করছিলাম- এটম নিয়ে তাঁর চিন্তা, ভাবনা আর কসমোলোজি নিয়েও আলোচনা হয়েছে সেদিন। মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর তত্ত্ব যে বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে সত্যি প্রমাণ হচ্ছে- এসবও ছিল আামদের আলোচনার বিষয়। 
তাই আমি আশা করছিলাম- যদি আমার থট রিডিং ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে মহাকাশ বিজ্ঞানের কথা ভেবে তুমি হয়তো আকাশের দিকে তাকাবে একবার। সত্যিই তুমি আকাশের দিকে তাকালে এই সময়Ñ তাতে আমি নিশ্চিত হলামÑ তোমার চিন্তাধারাকে আমি ঠিকঠিক অনুসরণ করতে পেরেছি এই পর্যন্ত। আকাশে এখন জ্বলজ্বল করছে সপ্তর্ষিÑ যে কারও নজরে পড়বেÑ তোমারও চোখ এড়ায়নি সপ্তর্ষি।

এবার সপ্তর্ষি থেকে চ্যানটিলির চিন্তা কীভাবে এলো তোমার মাথায়Ñ সে কথায় আসছি। তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি গতকাল এই অভিনেতাকে নিয়ে একটা ব্যঙ্গাত্মক লেখা বেরিয়েছে পত্রিকায়। লেখাটা আমরা দুজনেই পড়েছি এবং আলোচনাও করেছি। সেই প্রবন্ধে বেচারা অভিনেতাকে সপ্তর্ষির সঙ্গে তুলনা করে উপহাস করা হয়েছিল। 

কাজেই সপ্তর্ষি থেকে বেঁটে-খাটো ফ্লপ অভিনেতা চ্যানটিলির চিন্তা তোমার মাথায় চলে আসা খুবই স্বাভাবিক। 
মজা হচ্ছে তখন পর্যন্ত বেঁটে-খাটো চ্যানটিলির ভাবনায় ডুবে থেকে নিজের অজান্তেই তুমি একটু কুঁজো হয়ে হাঁটছিলে। হঠাৎ দেখলাম সিনা টান করে মাথা উঁচুতে তুলে পুরোপুরি সোজা হলে তুমি। আমার বুঝতে বাকি থাকলো না তোমার মনে চ্যানটিলির ভাবনাই খেলা করছে। তখনই আমি বলেছিলামÑ ‘লোকটা বেঁটে হলেও কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ভালো করবে।’ 
দুপঁর কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। এর কিছুদিন পর ‘কোর্ট নিউজ’ পত্রিকায় একটা খুনের ঘটনা পড়লাম আমরা। 

ভয়াবহ হত্যাকা- 
গতকাল রাতে মর্গ স্ট্রিটে রোমহর্ষক খুনের ঘটনা ঘটেছে। গভীর রাতে এলাকার বাসিন্দারা তীক্ষè চিৎকার শুনে জেগে ওঠেন। চিৎকার আসছিল একটি বাড়ির চারতলা থেকে। সেখানে বাস করেন মাদাম এসপানায়া আর তার মেয়ে মাদমোঁয়াজেল কামিলা। চিৎকার শুনে অত রাতেও প্রতিবেশীরা জড়ো হয়ে যায়Ñ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তারা শুনতে পায় উপর থেকে ভেসে আসছে কণ্ঠস্বর। একটু পরে সব চুপচাপ হয়ে যায়। ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। দরজা ভেঙে দুজন পুলিশ আর কয়েকজন প্রতিবেশী ভেতরে প্রবেশ করে। বেডরুমে ঢুকে বিস্ময় আর আতংকে স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। 
ঘরের আসবাবপত্র এলোমেলো, ভাঙা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিছানা থেকে তোশক-বালিশ টেনে নিচে নামানো হয়েছে। চেয়ারে পড়ে আছে রক্তমাথা ছুরি। মেঝেতে একগোছা চুল, চুলের গোড়ায় রক্তÑ দেখে মনে হয় মাথা থেকে টেনে উপড়ে তোলা হয়েছে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে দামি কানের দুল, রূপোর চামচ, দুটো ব্যাগ, তাতে প্রায় চার হাজার ফ্রাঁ সোনার মুদ্রা।

কোনায় একটা চেস্ট অফ ড্রয়ারÑড্রয়ারগুলো খোলা, ভেতরের জিনিস সব এলোমেলো। তোষকের নিচে একটা ছোট লোহার বাক্স পাওয়া গেছে। দরজায় চাবির রিং ঝুলছিল, রিংয়ের চাবি দিয়ে বাক্সটা খোলা হয়Ñ ভেতরে এক থোক চিঠি পাওয়া গেছে। 
ঘরের ভেতর কোথাও মাদাম এসপানায়াকে দেখা যায়নি। ফায়ারপ্লেসের চিমনির নিচে একগাদা কালিঝুলি পড়ে ছিল। চিমনির ভেতরটা চেক করতে গিয়ে দেখা গেল ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য। সেখানে ঝুলছে মেয়ে কামিলার মৃতদেহ, তার মাথাটা নিচের দিকে। কেউ তাকে মেরে চিমনির সরু জায়গাটায় ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনেক কষ্টে শরীরটা নামিয়ে পরীক্ষা করেছে পুলিশ।

তখনো উষ্ণ ছিল দেহটা, সারা দেহে আঁচড়ের দাগ, ক্ষতবিক্ষত দেহ। গলায় কালো গাঢ় ছাপÑ দেখে মনে হয় গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে মেয়েটিকে। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আর কাউকে পাওয়া যায়নি। নিচে নেমে বাড়ির পেছন দিকের উঠোনে পাওয়া গেছে বৃদ্ধ এসপানায়ার মৃতদেহ। তার গলা এমনভাবে কাটা হয়েছেÑ দেহটা সরাতে গেলে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বৃদ্ধার শরীরটা দেখে একতাল মাংসপি- ছাড়া আর কিছুই মনে হয় নাÑ গলা কেটে নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। 
পরের দিনের পত্রিকাতে এই খুন সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জানা গেল। পত্রিকায় লিখেছে- 

মর্গ স্ট্রিটের ট্র্যাজেডি 
এই ভয়াবহ হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে বহু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তদন্তে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাদের নাম, পরিচয় ও বক্তব্য নিচে দেওয়া হলো। 
পলিন দুবো : মহিলা গত তিন বছর ধরে মা-মেয়ের লন্ড্রির কাজ করছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী মা-মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল। বাড়িতে তেমন কারও যাতায়াত ছিল না। তারা নিরিবিলি জীবন কাটাতেন, নিয়মিত লন্ড্রির বিল পে করতেনÑ কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি। তবে তাদের ইনকাম সোর্স সম্বন্ধে পলিন কিছু জানে না। শুনেছে মাদাম জ্যোতিষী ছিলেনÑ মানুষের হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলতে পারতেনÑ শোনা যায় এটাই ছিল তার ইনকাম সোর্স। তাদের বাড়িতে কোনো কাজের লোক ছিল না। ওই বাড়ির চারতলা ছাড়া অন্য কোনো তলায় কেউ বাস করত না। 
পিয়ের মরিউ : স্থানীয় বাসিন্দা। সিগারেট ও নস্যি বিল্ডেতা। মাদাম এসপানায়া তার কাছ থেকে মাঝে মাঝে সিগারেট ও নস্যি কিনতেন। ছয় বছর ধরে মা-মেয়েকে এই বাড়িতে বসবাস করতে দেখছে পিয়ের। বাড়িটা মাদাম এসপানায়ার সম্পত্তিÑ আগে একজন জুয়েলারকে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। জুয়েলার উপরের তলাগুলো সাবলেট দিয়েছিল।

তাতে বিরক্ত হয়ে মাদাম ভাড়াটেদের তুলে দেন, তারপর নিজেই এসে চারতলায় থাকতে শুরু করেন মেয়ের সঙ্গে। অন্য তলাগুলো আর ভাড়া দেননি। সবাই বলে তিনি নাকি হাত দেখতেন। পিয়ের কথাটা বিশ্বাস করে না। মা-মেয়ে ছাড়া এই বাড়িতে তেমন কাউকে সে আসা-যাওয়া করতে দেখেনি কখনো। গত ছয় বছরে মেয়েকেও দেখেছে বড় জোর বার ছয়েক। একজন ডাক্তারকে আসতে-যেতে দেখেছে মাঝে মধ্যে। 
পিয়ের ছাড়াও আরও কয়েকজন প্রতিবেশী একই কথা বলেছে। তারা কাউকে আসা-যাওয়া করতে দেখেনি এই বাড়িতে। মাদাম এসপানায়ার কোনো আত্মীয়-স্বজন (চলবে...) 
 

×