ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জিবরাইলের ডানা ॥ চিত্র এবং চিত্রপট

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

প্রকাশিত: ২০:০৮, ৯ মে ২০২৪

জিবরাইলের ডানা ॥ চিত্র এবং চিত্রপট

.

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অধ্যাপক শাহেদ আলী বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সংস্কৃতিসেবী। যিনি সারাজীবন অনেকটা নীরবে-নিভৃতে সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। তিনি ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম ভাষাসৈনিক। তিনি একাধারে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক। তিনি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে সাবেক সিলেট তথা বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলবী ইসমাইল আলী এবং মাতা আয়েশা খাতুন।

শাহেদ আলীর বাল্য এবং কৈশোরকালও গৌরবময়। তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা, সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্যাচেলার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। অতঃপর তিনি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

এরপর থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত মিরপুর বাংলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে খেলাফতে রব্বানী পার্টির নমিনেশনে সুনামগঞ্জ থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। অধ্যাপক শাহেদ আলী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (সাবেক ইসলামিক একাডেমি) প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন। এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ সংকলন বিভাগের পরিচালকের হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। চল্লিশের দশক থেকেই শাহেদ আলী সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৪-৪৬ খ্রিস্টাব্দে মাসিক প্রভাতি এবং ১৯৪৮-৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকাদ্বয় সুনামের সঙ্গে সম্পাদনা করেন। ১৯৫৫ সালে দৈনিক বুনিয়াদ সম্পাদনা করেন। ইসলামী ফাউন্ডেশনের বিখ্যাত শিশু মাসিক সবুজ পাতার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক মিল্লাতের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি পত্রিকার সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ইসলামী বিশ্বকোষের সম্পাদনা বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক শাহেদ আলী বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া ১৯৪৮-৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সার্বিক কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি তমুদ্দন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক পরে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

এবার আসা যাক, প্রিয় কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলীর সাহিত্যকর্মের নানাবিধ বৈচিত্র্যময় দিক প্রসঙ্গে। ১৯৪০ খ্রি: সওগাত পত্রিকায় শাহেদ আলীর প্রথম গল্পঅশ্রুপ্রকাশিত হয়। এরপর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ক্রমান্বয়ে গল্প প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। শাহেদ আলী ছিলেন একজন জীবনধর্মী লেখক। মানব জীবনের গভীর আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, দর্শন তিনি নিঁখুতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখা গল্পগ্রন্থ : জিবরাইলের ডানা (১৯৫৩), একই সমতলে (১৯৬৩), শানযর, (১৯৮৫) অতীত রাতের কাহিনী (১৯৮৬), অমর কাহিনী (১৯৮৭), নতুন জমিদার (১৯৯২), শাহেদ আলীর শ্রেষ্ঠ গল্প, শাহেদ আলীর নির্বাচিত গল্প ইত্যাদি। উপন্যাস : হৃদয় নদী (১৯৬৫),

প্রবন্ধ-গবেষণা : একমাত্র পথ, তরুণ মুসলিমের ভূমিকা, ফিলিস্তিনে রুশ ভূমিকা, সাম্রাজ্যবাদ রাশিয়া, তরুণের সমস্যা, বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান, তাওহীদ, বুদ্ধির ফসল আত্মার আশিষ, ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা, Economics Order Of Islam, জীবন নিরবচ্ছিন্ন, Islam in Bangladesh, জীবনদৃষ্টি বিপর্যয়ের হেতু, অন্যরকম আমেরিকা ইত্যাদি।

শিশুতোষ : রুহীর প্রথম পাঠ, ছোটদের ইমাম আবু হানিফা, সোনার গাঁয়ের সোনার মানুষ, নাটিকা : বিচার আত্মজীবনী : জীবনকথা অনুবাদ গ্রন্থ : মক্কার পথ, মূল : মুহাম্মাদ আসাদ, ইসলামে রাষ্ট্র সরকার পরিচালনার মূলনীতি, মূল : আল্লামা আসাদ আধুনিক বিজ্ঞান আধুনিক মানুষ

মূল : কেবিএইচ কোনান্ট ইতিবৃত্ত,

মূল : হিরোডাটাস ককেশাসের মহানায়ক

মূল : ইমাম শামেলি।

তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এই যেমন- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪) ভাষা আন্দোলন পদক (১৯৮১), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫), লায়ন ক্লাব পদক (১৯৯২), ইসলামিক ফাউ-েশন পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৯) দুবাই সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২), ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭) রাগিব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮) কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার, জাসাস স্বর্ণপদক (২০০০) তমুদ্দন মজলিস মাতৃভাষা পদক (২০০০) কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর, ২০০৩) এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পুরস্কার ইত্যাদি। বহুধা প্রতিভার অধিকার শাহেদ আলী ২০০১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

এবার তাঁর সবচেয়ে আলোচিত এবং আলোড়িত গ্রন্থজিবরাইলের ডানা চিত্র এবং চিত্রপট প্রসঙ্গে। পঞ্চাশের দশকের জিবরাইলের ডানা গল্পের মাধ্যমে যে নামটি সবার মনে আলোড়ন তুলেছিল, তিনি আর কেহ নন, সুনামগঞ্জের হাওরের গর্ব, কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলী। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে জিবরাইলের ডানা গল্প পড়তে গিয়ে নামটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আলোকিত আলোচিত ছোটগল্প জিব্রাইলের ডানা, যেটা সবার মনে সাড়া জাগিয়েছিল, যারা পড়েছেন তাদের মনে রেখাপাত করে আছে এখনও, সেই গল্পের লেখক এবং সুনামগঞ্জের আলোচিত ভাষাসংগ্রামীদের একজন অধ্যাপক শাহেদ আলী, যিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথাশিল্পীই নন, তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল অনুবাদ-সাহিত্যিক এবং আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক।

তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ জিবরাইলের ডানা যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি প্রচুর প্রশান্তি পান আর সেখানে ফুটিয়ে তোলেন দরিদ্র ঘরের একটি সন্তানের আশা আশ্বাসের। তাঁর মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না, ছিল সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক কোমল মন। জিব্রাইলের ডানা গল্প দিয়ে তিনি সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেয়েছেন। এই জিবরাইলের ডানা নিয়ে বিশ্বখ্যাত অনেক পরিচালক ছবি করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোথাও কোনো সমস্যা ছিল বিধায় তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ ছিল না।

গল্পটি আমি ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি কতবার যে পাঠ করেছি; তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গল্পের নামকরণের ভেতর যেমন একটি ঘোরলাগা ভাব ব্যঞ্জনা আছে, তেমনি ভেতরেও অনন্ত রহস্যের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। নবী চরিত্রের নিখুঁত বিনির্মাণের মাধ্যমে লেখক গল্পটিকে নিয়ে গেছেন অনন্য এবং অতুলনীয় এক উচ্চতায়। হালিমা এবং নবী মা এবং পুত্র। ক্রমাগত দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে মহান স্রষ্টার প্রতি মা হালিমার মন যখন অভিমানী; তখনই পুত্র নবী একদিন দুই ডানা বিশিষ্ট নুরানি চেহারার কাউকে দেখেন। তার ডানাগুলো ছিল ময়ুরের পেখমের চেয়েও সুন্দর। আসল ঘটনা হল, হালিমা এবং নবী একই সঙ্গে বসেছিল। কিন্তু সেই নুরানি ডানা বিশিষ্ট কাউকে কেবল নবী দেখেছে; কিন্তু হালিমা দেখেনি। আর তাই হালিমার ক্ষত বিক্ষত মন সেটা মানতে রাজি হতে চায়নি। কিন্তু হালিমা মানুক কিংবা না মানুক নবীর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি নিশ্চয়ই ফেরেশতা জিবরাইল।

অসংখ্যবার গল্পটি পাঠের পর আমার কাছে মনে হয়েছেজিবরাইলের ডানামূলত একটি ছায়া গল্প। লেখক এখানে প্রতীকীভাবে শিশুনবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) এবং তাঁর দুধমাতা মা হালিমার চরিত্র মাধুর্যের সরাসরি না হলেও প্রতীকী রূপায়নের চেষ্টা করেছেন। যদিও গল্পের ঘটনার সঙ্গে শিশুনবী মুহাম্মদ (সা:) এবং মা হালিমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বাস্তবিক অর্থে কোনো মিল নেই। তবুও এর রেশ আছে বলেই আমার বিশ্বাস। আর সম্ভবত: এখানেই প্রিয় গল্পকার শাহেদ আলীর সার্থকতা। লেখকের প্রিয় রং ছিল নীল। তাই গল্পের নায়িকাকেও তিনি নীল রঙে রঙিন করে তুলেছেন বিভিন্ন গল্পে। তাঁর জিবরাইলের ডানা উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি রাশিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। গল্পটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং নিগূঢ় রহস্য, নবী তার মা হালিমার কথোপকথনের মাধ্যমে সরল, সহজ এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

আগামী ২৬ মে প্রয়াত কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলীর জন্মদিন। দেখা যায় দেশের অধিকাংশ পত্র পত্রিকা তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে কোনো লেখা প্রকাশ করে না। যা অত্যন্ত বেদনার এবং হতাশার। এই উপেক্ষা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাছাড়া আমি মনে করি, শাহেদ আলীর লেখা নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হওয়া উচিত। তাতে করে আমরাই লাভবান হবো। বাংলা সাহিত্য আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে।

 

×