ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

পরাজিত হয় না কবিরা 

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ২২:২১, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

পরাজিত হয় না কবিরা 

আল মাহমুদ

আল মাহমুদ নিজেই স্বীকার করেন, তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো প্রেম এবং নারী। তবে নারী ও সৌন্দর্যকে তিনি আলাদা করে দেখেছেন। আল মাহমুদ নারীকে সৌন্দর্য না বলে আকর্ষণীয় বলতে চান। নারীর যৌনতা, আকাক্সক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখতে পছন্দ করতেন

‘বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল/ পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না/ তুমি যদি খাও তবে আমাকে দিও সেই ফল/ জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা/ পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা/ দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা -উপশিরা।’ (সোনালী কাবিন- আল মাহমুদ) 
 ছোটবেলায় মোল্লা বাড়ির পিয়ারু নামে পরিচিত ছিলেন কবি আল মাহমুদ। তিনি  ১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম মীর আবদুস শাকুর আল মাহমুদ। স্কুলজীবন থেকেই তার লেখালেখির শুরু। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে সাহিত্য রচনায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন।

দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে তার পেশা জীবন শুরু করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি চালাতে থাকেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) তাকে প্রথমসারির আধুনিক বাংলা কবিদের কাতারে নিয়ে আসে। কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থগুলো বাংলা কবিতায় তার আসনকে  পাকাপোক্ত করে দেয়। লিখেছেন আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া ইত্যাদি কাব্য।

তার গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বনিক, ময়ূরীর মুখ ইত্যাদি। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে কবি ও কোলাহল, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, ত্রিশিরা প্রভৃতি। 
অন্য অনেক কবির মতোই নারীর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছেন কবি। নারীকে তুলনা করেছেন কাজ করা জামদানির সঙ্গে। তাই তো কবির কলমে ফুটে উঠেছে-
‘নারী হলো একটা ভাঁজ করা জামদানি।
আমি আড়চোখে দেখি এর গোপন চুমকির কাজ।
কিছু নারী আছে শুধু ভালোবাসতেই জন্মায়
অবসন্ন সৌন্দর্যের ভেতর সুন্দর হয়ে মরে যায়।’
 জন্ম-মৃত্যু আর প্রেম-ভালোবাসার এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে মৃত্যুই শেষ পরিণতি। তারপরেও প্রতিটি মানুষের জীবনেই নারীর অবদান থাকে। নারীকে কেন্দ্র গড়ে ওঠে বিশাল সেই স্মৃতির মিনার।

‘জন্ম মৃত্যু প্রেম ভালোবাসা সবই
এড়াতে পারে না ভাগ্যের মহামারি
প্রতি পৃষ্ঠায় ফিরে আসে সেই নারী
যার নৌকায় উঠেছিল যৌবনে
মনের ভেতর লুকিয়ে সংগোপনে। (হাতছানি)’

আল মাহমুদ নিজেই স্বীকার করেন, তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো প্রেম এবং নারী। তবে নারী ও সৌন্দর্যকে তিনি আলাদা করে দেখেছেন। আল মাহমুদ নারীকে সৌন্দর্য না বলে আকর্ষণীয় বলতে চান। নারীর যৌনতা, আকাক্সক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখতে পছন্দ করতেন।

আবার তিনি লিখেছেন ‘আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে/ ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল/ লোক লোকান্তর-এর সিম্ফনি কবিতায় কবি লিখেছেন- শঙ্খমাজা স্তন দুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি/লজ্জায় বিবর্ণ মন ঢেকে যাবে ক্রিসেনথিমামেদ। 

শুধু নারীর শরীরকে আরাধ্য করেননি কবি।
কবির নূহের প্রার্থনা কবিতায়ও নারী-পুরুষ সম্পর্কই মুখ্য স্থান গ্রহণ করেছে। লিখেছেন আবার করবো পান বুকের এ উৎস ধারা হতে/জারিত অমৃত রস/এতোদিন যৌবনের নামে/যা ছিল সঞ্চিত এই সঞ্চারিত শরীরের কোষে/হে নূহ সন্তান দেবো, আপনাকে পুত্র দেবো। 
 শোকের লোবান কবিতায় লিখেছেন তামসিক কামকলা শিখে এলে/যেন এক অক্ষয় যুবতী/তখন কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল/যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর/নি¤œনাভিমূল।
কালের কলস গ্রন্থের শূন্য হাওয়া কবিতায় কামবিন্দুকে ঘিরে নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্কের চরণবৃত্ত গড়ে উঠেছে- ঘুমের ছল কামের জল/এখনো নাভিমূলে/মোছেনি তবু আবার এলো/আগের শয্যায়।
প্রকৃতি ও নারীর উপমার আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ আমরা খুঁজে পাই ‘আত্মার কুহুধ্বনি’ কবিতায়।

‘কত নারী কত ঘাটে কত বাটে মাঠে তেপান্তরে
আমাকে তাদের বশীকরণের ফুঁৎকারে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে।
আমি কেঁপেছি ঠিকই,
কিন্তু এক দৈব নির্দেশের মতো আমার ভেতরের কোকিল
আমাকে ডাকতে ডাকতে পার করে নিয়েছে তেপান্তরের মাঠ থেকে।’
 প্রেম, প্রকৃতি আর নারী সম্মিলনে এক চমৎকার উপমার বুনন আমরা লক্ষ্য করি কবি আল মাহমুদের ‘মাপজোক’ কবিতায়-
আমাকে কতোটা উঁচু দেখায়, তা মাপতে গিয়েছিলাম,
কিন্তু যা কিছু সামনে ধরে দাঁড়াবার ছিল- পাহাড় পর্বত গাছ
 কোনো কিছুই আমার ভর সইতে পারল না;

 হেসে বললে- এই তো আমি তোমার ভর সইবার মতো নগ্ন কাঁধ
 তোমার টান সইবার মতো উন্মুক্ত বাহু
আমি নারী, মাপো আমাকে; (মাপজোক)

×