ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

অহ নওরোজ

প্রকাশিত: ২২:২১, ৩১ আগস্ট ২০২৩

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

ভ্রমণ ॥ কাতালোনিয়ার রৌদ্রের ভেতর

(পূর্ব প্রকাশের পর)
সব মিলিয়ে এই পথেই আমরা তুলনামূলক আগে পৌঁছাবো।
ঠিক ভোরের দিকে সূর্যের আলো চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙে যায়, চলমান বাসের জানালা দিয়ে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি অভূতপূর্ব দৃশ্য। অসীম জলরাশির ভেতর দিয়ে লাল টকটকে সূর্য উঠছে। নড়ে বসি-আমরা কোথায়? মুঠোফোনের মানচিত্র বলে আমরা স্পেনের কাতালোনিয়া অঞ্চলের কোস্টা ব্রাভার বা ব্রাভা উপকূল সংলগ্ন মহাসড়ক ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। বিস্ময় আর থামে না। অর্থাৎ, বামে যে বিপুল তরঙ্গায়িত জলরাশি, তা ভূমধ্যসাগরের। ছবিতে, সিনেমায় তাকে দেখে কতবার যে কল্পনায় ভূমধ্যসাগরের মগ্নতা এসেছে তা গুণে শেষ করা যাবে না। সেই ভূমধ্যসাগর এখন চোখের সামনে। কাঁপি যেন কাহারবায়। সমস্ত শরীর জুড়ে চলা ওই সময়কার বিসর্পিণী উচ্ছলতার কোনো বর্ণনা এই লেখায় দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন মনে পড়ে, কিংবা মনে করি—‘পশ্চিমপ্রেরিত আমি, তুমি এলে পূর্বের প্রহরী/ দুই প্রান্ত থেকে ফিরে আমাদের দেখা হলো ভূমধ্যসাগরে।’ 
কিছুক্ষণ পর আমাদের বাস মহাসড়ক থেকে বেরিয়ে পাহাড়ি ছোটো রাস্তা ধরে বলে সমুদ্রকে বলতে হয়, ‘আবার দেখা হবে’।
এতক্ষণে আমার ধ্যান ভাঙে। রাস্তার পাশে তাকিয়েই বুকের ভেতর ছলাৎ করে ওঠে। একি! সেই ওক কিংবা ম্যাপল গাছেরা, তারা কোথায়? তাদের পরিবর্তে রাস্তার পাশ জুড়ে ঝোপওয়ালা গোল গোল আকৃতির গুল্ম। দূরের দৃশ্যের ভেতর ঢুকে পড়ে ঝাউবন আর পোড়ামাটি রঙের বাকলযুক্ত ভূমধ্যসাগরীয় স্টোন পাইন গাছেরা। প্রায়ই দেখি রাস্তার দু’পাশে মাইলকে মাইল এলাকা জুড়ে অলিভের বাগান। মাটিগুলো আগুনরঙা, একই রঙ দেখি গ্রামের শুকনো বাড়ির ছাদের টালিতে। অধিকাংশ বাড়িই অনুচ্চ- দুই তলার বেশি নয়- পরে লা’ স্কালা শহরেও বাড়িগুলোর একই আদল দেখেছি- অনুচ্চ, ছাদের টালি আগুনরঙা। প্রায় বাড়িতেই কাতালোনিয়ার পতাকা ঝুলছে। পুরো দৃশ্য যেন একটাই কথা জানান দিচ্ছে- তুমি গরমের দেশে এসে গেছো। দৃশ্যের এই অভিব্যক্তি আমাদের সকলকেই সম্মোহিত করে। 
দেখতে দেখতে আমরা এসে পড়ি কাতালোনিয়ার জিরোনা প্রদেশের আলবানইয়ায়। পাহাড়ের উপত্যাকার মধ্যে তাকে ছোট্ট গ্রাম বললে একটুমাত্রও বেশি বলা হবে না। কিন্তু স্পেনীয় সরকার এই এলাকাকে পৌরসভার মর্যাদা দিয়েছে। এখানেই আমাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। নেমেই দেখতে পাই আমাদের নেওয়ার জন্য লোক এসেছে। তারা একজনকে পথ দেখানোর জন্য রেখে, আমাদের যাবতীয় মালামাল এক ক্ষুদ্রাকার পাহাড়ি জীপে তুলে কোথায় হারিয়ে যায়।
রেখে যাওয়া লোকটির নির্দেশমতো আমরা হাঁটতে শুরু করি। পাহাড়ের গা বেয়ে সরু পথ, যতই হাঁটি ততই উপরে উঠি, যেন মেঘের দিকে যাত্রা।

দুই পাশে অফুরন্ত সবুজ আর অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক-গাছের ভেতর দিয়ে ভ্যাপসা গরমের আভাস গায়ে লাগে। স্পেনীয় গ্রীষ্ম ভারতীয় উপ-মহাদেশের গ্রীষ্মের কথা মনে করায়। হাঁটতে হাঁটতে কখনো হঠাৎ চারপাশ এতো নীরব হয়ে যায় যে, নিজের জুতোর শব্দ শুনতে পাই। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বিদেশী বুনো ফুলের সৌরভ আমাদের ইন্দ্রিয়গত করে। কতদিন পর যে বুনো ফুলের ঘ্রাণ পেলাম তার ইয়ত্তা নেই। ইউরোপের ফুলেরা কেবল চোখের দেখার, সুরভী মেলে শুধু কারখানায় বানানো সুগন্ধি-জলে।
কিলোমিটার পাঁচেক হাঁটতে হয় ক্যাম্পিং-স্থলে পৌঁছাতে। ইউরোপে ইচ্ছেনুযায়ী যেখানে সেখানে ক্যাম্পিং-এর সুযোগ নেই। আগে থেকে অনুমতি নিয়ে কিংবা অথবা সরকার নির্ধারিত স্থানেই শুধু তা সম্ভব। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য মাথার ওপরে চলে আসে। সকলেই ঘেমে নেয়ে একাকার। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, পরিশান্ত একইসঙ্গে। তবুও যেন সেদিকে কারও খেয়াল নেই। পৌঁছেই আমাদের তাবু দেখিয়ে দেওয়া হয়। তাঁবুর ভেতরে যাওয়ার আগে চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া চাই। 
তিন পাহাড়ের মাঝখানে ক্ষুদ্র উপত্যাকার ওপর গাছাপালা কেটে ক্যাম্পিং-এর জায়গা করা। চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা- পাহাড়ের গায়ে গায়ে স্টোন পাইন আর নানা রকম অচেনা গাছের সারি, তাদের ভেতর দিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকা আর পাখিদের অনবরত কোলাহল। রকমারি ফুলের সৌরভে পুরো এলাকা মাতোয়ারা। ওপরে সুনীল আকাশে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে মেঘেরা। তাঁবুর মাত্র কয়েকশ গজ দূরে পাহাড় নেমে গেছে ৮০-৯০ মিটারের মতো খাদ হয়ে। দুই পাহাড়ের ভাঁজের ভেতরে বয়ে গেছে খরস্রোতা নদী। পরে জানতে পারি নদীর নাম মুগা। 
আমরা যেখানে তাঁবু করেছি সেখানে বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডের লোকেরাও তাঁবু গেড়েছে। পুরো ক্যাম্পিং এলাকার জন্য পাহাড়ের গা ঘেঁষে এককোণে কিছুটা আধুনিক কায়দায় কতগুলো সারিবদ্ধ শৌচাগার আর স্নানঘর নির্মাণ করা। তার অদূরে রসুইঘর বা পাকশালার চিহ্ন সংবলিত বড়ো খোলা এক তাঁবু। আমাদের বলা হলো সেখান থেকেই সারি ধরে দাঁড়িয়ে খাবার ও পানি সংগ্রহ করতে হবে। দিনের ভেতর সকালে এবং সন্ধ্যায় দুই বার খাবার পরিবেশন করা হবে। দুপুরে যেহেতু খাবারের সুযোগ নেই, তাই সকালের খাবার থেকে কিছুটা দুপুরের জন্য তুলে রাখতে হবে। আশে-পাশের পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যের কোনো খাবারের দোকান নেই যে সেখান থেকে খাবার কেনা যাবে।

রসুই ঘরের কাছে গিয়ে রান্নাবান্নাসহ পুরো ক্যাম্পের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন রঙের একদল চৌকস বিদেশী লোকের দেখা পেলাম। যে কোনো প্রশ্ন করলেই তারা মুচকি হাসি দিয়ে উত্তর দেন। সদ্য পৌঁছেছি বলে আমরা সে বেলা বিভিন্ন শাক-সবজির সংমিশ্রণে রান্না সালুন এবং স্যুপের মধ্যবর্তী একটি খাবার পেলাম। তাতে না হয়েছে লবণ, না আছে উষ্ণতা। আর হলুদ-মরিচের কথা ইউরোপের খাবারে মনে করাই তো বাহুল্য। চোঁ- চোঁ পেট তবু অল্পক্ষণেই হেসে ওঠে। পাহাড়ি ঝর্ণা-জলের তুলনা নেই। বুক ভরে পান করা যায়।
খাওয়া শেষে আর কিছু করার শক্তি থাকে না বলে আমরা তরুণ চেরি গাছদের ছায়ায় গোল হয়ে বসে তাস খেলি।
পরদিন থেকে শুরু হয় পাহাড়ের গায়ে আমাদের নতুন নতুন আবিষ্কার। আমরা যে এলাকায় রয়েছি তাকে ডাকা হয় বাসেগোডা চলবে...)