ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ বছর বুকার জয়ী জর্জি গস্পোনিদভের

টাইম শেল্টার

শিল্পী নাজনীন

প্রকাশিত: ২১:১৬, ১ জুন ২০২৩

টাইম শেল্টার

আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ২০২৩ পেলেন বুলগেরীয় লেখক জর্জি গস্পোনিদভ

আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ২০২৩ পেলেন বুলগেরীয় লেখক জর্জি গস্পোনিদভ এবং বইটির অনুবাদক অ্যাঞ্জেলা রোডেল। এই প্রথম বুলগেরীয় ভাষায় রচিত কোনো উপন্যাস বুকার পুরস্কার জেতার সৌভাগ্য অর্জন করল। অত্যন্ত সম্মানজনক এই বুকার পুরস্কারটি সারা বিশ্বের কথাসাহিত্যকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। 
বুলগেরীয় লেখক জর্জি গস্পোনিদভ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত কবি। গস্পোনিদভের লেখক জীবন শুরু“হয় কবিতার মধ্য দিয়ে। তার প্রথম উপন্যাস ‘ন্যাচারাল নভেল’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ২৫টি ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়। তার দ্বিতীয় উপন্যাসের নাম ‘দ্য ফিজিক্স অব সরো’। যুক্তরাজ্য থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এবারের বুকারজয়ী ‘টাইম শেল্টার’ তার তৃতীয় উপন্যাস। ‘অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ নামে একটি ছোটগল্প সংকলনও আছে গস্পোনিদভের। বুকার জয়ের আগে তার ঝুলিতে জমা হয়েছে আরও সতেরোটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বর্তমানে ইউরোপের মেধাবী ও অগ্রসর লেখকদের একজন হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার। 
তিনশ’ চার পৃষ্ঠার ‘টাইম শেল্টার’ উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন অ্যাঞ্জেলা রোডেল। তার চমৎকার, ঝরঝরে ও গতিময় অনুবাদ উপন্যাসটিতে পাঠককে চুম্বকের মতো আটকে রাখে। পুরস্কারের ৫০ হাজার পাউন্ড লেখক এবং অনুবাদক সমানভাবে পাবেন। অ্যাঞ্জেলা রোডেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা। তবে কাজের প্রয়োজনে তিনি বুলগেরিয়াতেই বসবাস করেন। তার কবিতা এবং গদ্য বিভিন্ন অনুবাদ সাহিত্য পত্রিকা এবং সংকলনজুড়ে প্রকাশিত হয়েছে। বুলগেরীয় সংস্কৃতিতে অবদানের পুরস্কারস্বরূপ তিনি ২০১৪ সালে বুলগেরিয়ার নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন।
‘টাইম শেল্টার’ উপন্যাস সম্পর্কে নোবেলজয়ী লেখক ওলগা তোকারজুক বলেন, ‘আমাদের সময়-নিরীক্ষণ ও যাপনপন্থা নিয়ে লেখা গভীরতম সাহিত্য-সৌন্দর্য’র একটি নিদর্শন এটি। অচিন্ত্যনীয় নিখুঁত শিল্পনৈপুণ্যে গ্রন্থটি রচিত হয়েছে’।
সাহিত্য সমালোচক ডেভ এগার্স এটিকে ‘ইউরোপের সবচেয়ে মনোহর ও অতুলনীয় উপন্যাসগুলোর একটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
‘টাইম শেল্টার’ উপন্যাসটি লেখক জর্জি গস্পোনিদভ আদতে লিখেছেন ঘটনাচক্রে। আমাদের জীবনের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা যন্ত্রণা, জীবনের প্রতি বাঁকে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য সব চোরাকাঁটা, যাকে খালি চোখে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়, সেইসব কষ্ট ও যন্ত্রণাকে শৈল্পিক মোড়কে উপস্থাপনার তাগিদ থেকেই উপন্যাসটি  রচিত হয়েছে। স্মৃতি হারিয়ে গেলে কী ঘটে মানুষের জীবনে? হারিয়ে যাওয়া সেইসব স্মৃতি কি ফিরে আসে আবার? যদি না ফেরে, তাহলে কেমন হয় সেসব স্মৃতিশূন্য জীবন? কতটা যন্ত্রণা আর বিষাদ এসে ভর করে তখন স্মৃতিশূন্য সেই মানুষগুলোর মনে? ‘টাইম শেল্টার’ নামক উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে এসব প্রশ্ন আর তার উত্তর।

পরীক্ষামূলক আলঝেইমারের চিকিৎসা প্রদান করে এমন একটি ক্লিনিককে কেন্দ্র করে লিখিত হয়েছে উপন্যাসটি। রোগীদের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার এবং বিগত কয়েক দশকের স্মৃতির জগতকে ক্ষুদ্রতম বিবরণে পুনর্নির্মাণ করার প্রক্রিয়া ঘিরেই মূলত ‘টাইম শেল্টার’ উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অগাস্টিন গ্যারিবল্ডি, যার ডাকনাম গস্টিন, একজন মনোচিকিৎসক। সমসাময়িক জীবন ও জগৎ থেকে যে আলাদা থাকতে চায়, চায় অতীতে অবগাহন করতে। সেসব সময় পুরনো পোশাক পরে থাকে, খুঁজে খুঁজে পাঠ করে পুরনো সব খবর। বিংশ শতাব্দীর হারিয়ে যাওয়া রাস্তাগুলো সে খুঁজে বেড়ায়, ঘোরগ্রস্ত হয়ে সে ঘুরে বেড়ায় পথ থেকে পথে।

জুরিখ শহরে সে একটি ক্লিনিক খুলেছে, যেখানে স্মৃতিশূন্য মানুষদের চিকিৎসা করা হয়। এই ক্লিনিকের প্রতিটি ফ্লোর পুরনো একেকটি দশকের বস্তু ও দৃশ্যমালা দিয়ে সাজানো, যেন সেই পুরনো দশকগুলো তার বাস্তব চিত্র নিয়ে দৃশ্যমান হয় দর্শকের চোখে। যেন সেখানে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে এমন একটা বিভ্রম তৈরি হয়, যাতে সে মনে করতে পারে যে সে নির্দিষ্ট সেই দশকটিতেই আটকে আছে, বর্তমান লুপ্ত হয়ে গেছে তার জীবন থেকে, অতীতই যেন জীবন্ত তথা বর্তমান হয়ে ধরা দেয় তার চোখে।
উপন্যাসটি এগিয়েছে অত্যন্ত সাবলীল গতিতে, এর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে গস্টিনের এক সহকারীর বয়ানে, যে পুরো কাহিনীটি বর্ণনা করেছে উত্তম পুরুষে। ক্লিনিকে এই সহকারীর দায়িত্ব থাকে অতীতের সব নিদর্শন আর স্মারকচিহ্ন এনে প্রতিটি তলায় জড়ো করা। সেটা হতে পারে ত্রিশের দশকের নানান ছবি ও সরঞ্জাম, চল্লিশের দশকের শিল্পকর্ম, ব্যবহৃত নানা তৈজসপত্র, ষাটের দশকের আসবাবপত্র, জামার বোতাম, পারফিউম কিংবা হারানো এমন আরও বহুবিধ উপকরণ। গস্টিনের মনোচিকিৎসার এই অভিনব রীতিটি সেখানে শিগগিরই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বর্তমানে বীতশ্রদ্ধ আর হাঁপিয়ে ওঠা মানুষগুলো অতীতে আশ্রয় খুঁজতে চায়, অতীতের মোহন হাতছানিতে তারা খুঁজে পেতে চায় মানসিক প্রশান্তি, মুছে ফেলতে চায় বর্তমানের সব জরা ও যন্ত্রণা। ক্রমশ সুস্থ মানুষগুলোও ভিড় করতে শুরু“করে গস্টিনের এই ক্লিনিকে। ইউরোপজুড়ে সাড়া পড়ে যায় এই ‘আদর্শ’ ক্লিনিক নির্মাণের। সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহকে রুদ্ধ করে তারা একটি কাল্পনিক নিরাপত্তা-বেষ্টনী তৈরি করতে চায়, আর এরই আশ্রয়ে তারা মানসিক সুখ সন্ধানের চেষ্টা করে।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বিভ্রমের শিকার হয়। অদ্ভুত এক মোহাচ্ছন্নতা তাদের গ্রাস করতে থাকে। তাদের বর্তমান জীবনে এসে মোহবিস্তার করতে থাকে হারিয়ে যাওয়া অতীত। ভবিষ্যৎকে থামিয়ে দেওয়ার এই কিম্ভূত আকাক্সক্ষা ক্রমশ আরও বিস্তৃত হলে বর্তমান ও অতীতের সীমারেখা এক সময় মুছে যেতে থাকে। তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করতে থাকে অতীতের গর্ভে, বর্তমান তাদের সামনে থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে ইউরোপের সব জাতি এক সময় ‘গৌরবময় অতীত’এর জন্য ভোট দেয়ার প্রস্তুতি নেয়।

অতীতকে তারা ভবিষ্যতের গর্ভে স্থাপন করতে অধীর হয়ে ওঠে। এভাবেই লেখক তার উপন্যাসে পূর্ব ইউরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অতীত ও বর্তমান রাজনীতির ধারাকে উপন্যাসের ফর্মে, শিল্পের মোড়কে উপস্থাপন করেছেন।  উপন্যাসে তিনি কৌতুক আর আত্মবিদ্রƒপের সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে এনেছেন মানবমনের গভীরতম উপলব্ধি, কবিতার অন্তর্গত অনুভব, যা উপন্যাসটিকে অনন্য করে তুলেছে, এটি হয়ে উঠেছে মর্মস্পর্শী এক আখ্যান এবং মানুষের গভীরতর অনুভূতিকে উস্কে দেওয়ার মতো একটি উপন্যাস। 
উপন্যাসটিতে ব্রেক্সিট এবং পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। বর্তমান সময়ের রাজনীতি, চলমান ঘটনাবলী উপন্যাসটিতে তুলে ধরে লেখক এঁকেছেন সাম্প্রতিক সময়ের নিখুঁত এক চালচিত্র, যেখানে একটি কাল মিশে যেতে চায় আরেকটি কালরেখার সঙ্গে। কিন্তু সেটি কি আদৌ সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর মেলে এই উপন্যাসে।
উপন্যাসে শেষপর্যন্ত দেখা যায়, গস্টিন উধাও হয়ে যায় আর তার সহকারী, যে শেষপর্যন্ত কাহিনী বয়ান করে, তার নিজেরই স্মৃতি-বিভ্রম ঘটে। সে একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনাকে গুলিয়ে ফেলে এবং এক সময় বলে ওঠে, ‘গস্টিন, যাকে আমি কল্পনা করেছিলাম, তারপর যার সশরীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, অথবা হতে পারে উল্টোটাই ঘটেছিল, আমার ঠিক মনে নেই।’
কাহিনীর এ পর্যায়ে এসে পাঠক হোঁচট খায়। তার মনে এই প্রশ্ন উদিত হয় যে, তাহলে কি গস্টিন নামে আদৌ সেখানে কেউ ছিল? না কি সে পুরোটাই স্মৃতিভ্রমে আক্রান্ত এই বর্ণনাকারীর কল্পনার ফসল?
কৌতুক ও আত্মবিদ্রুপাত্মক আবহের ভেতর দিয়ে এবং স্মৃতিকাতরকার আশ্রয়ে উপন্যাসের শুরু“হলেও উপন্যাসের শেষে দেখা মেলে সীমাহীন অরাজকতা আর দুঃসহ দুর্ভোগের। ‘টাইম শেল্টার’ মূলত একটি জটিল ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। মাঝে মধ্যে এটি রীতিমতো ভীতি-উদ্রেককরও।  সব মিলিয়ে উপন্যাসটি পাঠককে শেষ পর্যন্ত নিবিষ্ট রাখে কাহিনী ও চরিত্রগুলোর সঙ্গে। উপন্যাসটি পাঁচটি আখ্যানভাগে বিন্যস্ত। স্মৃতিশূন্যতা, পলায়ন, কালের গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, এই গতিকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এবং ভবিষ্যতের অবশ্যম্ভাবিতাকে অস্বীকার করে অতীতমুখিতার পরিণতি, এই পাঁচটি ভাগে উপন্যাসের কাহিনী বিধৃত। 
অতীতকে কখনোই ফেরানো যায় না, ভবিষ্যৎকেও কখনোই নির্মাণ করা যায় না অতীতের সংস্করণরূপে, উপন্যাসটি পাঠ শেষে আবারও এই সত্যটিই ভাস্বর হয়ে ওঠে পাঠকের মনে। 
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর লেখা এক নিবন্ধে জর্জি গস্পোনিদভ বলেন, ‘আমার সাম্প্রতিকতম উপন্যাসে আমি অতীতের ভূতগুলোর কথা বলেছি। বলেছি ১৯৩৯ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর একটা ঘটনাদৃশ্য দিয়ে আমি শেষ করেছি উপন্যাসটি। আমরা কি চিরকাল ১৯৩৯ সালের প্রাক্কালেই দাঁড়িয়ে থাকব? এতকিছুর পরেও আমরা কি ফিরে যাব ইতিহাসের সেই বিপজ্জনক সময়টিতে? কেন?’
মূলত কবি জর্জি গস্পোনিদভ আর সব কবির মতোই যুদ্ধবিরোধী। বিচ্ছিন্নতা ও সংঘাত নয় বরং মানবতার জয়গানই তার ধ্যানজ্ঞান। ‘টাইম শেল্টার’ উপন্যাসটি লেখকের এই ধ্যানেরই ফলশ্রুতি। আপাত দৃষ্টিতে এটিকে  ইউরোপের ইতিহাসাশ্রিত একটি উপন্যাস মনে হলেও গভীরতর বিশ্লেষণে এ ধারণার অবসান ঘটে। উপন্যাসে যে অতীত চারিতার বর্ণনা আছে, তা কেবল ইউরোপেই দৃশ্যমান নয়, বরং বর্তমান পৃথিবীজুড়েই সেটি দৃশ্যমান। আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সবমিলিয়ে উপন্যাসটির বুকার পুরস্কার জয়ে তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকে না আর।

×