ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজকাহিনীর রঙ ও কবি প্রশস্তি

প্রদীপ দত্ত 

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৩০ মার্চ ২০২৩

রাজকাহিনীর রঙ ও কবি প্রশস্তি

আমাদের রাজকাহিনীতে অনেক রঙ আছে, আর এই রঙের আড়ালেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত ইতিহাস

আমাদের রাজকাহিনীতে অনেক রঙ আছে, আর এই রঙের আড়ালেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত ইতিহাস। কবির কাব্যের ভণিতায় রাজপ্রশস্তিতে প্রজাপীড়ক রাজা কিংবা সামন্ত জমিদার হয়ে উঠেন প্রজাহিতৈষী। দুর্বিনীত নৃশংস যিনি তিনিও হয়ে যান ধর্মপুত্র। রাজপ্রশস্তির কবিকাহিনী কিংবদন্তি হয়ে কাল থেকে কালান্তরে মানুষের মুখে মুখে ফেরে, যা ক্রমেই হয়ে উঠে আসল ইতিহাস। রাজ অনুগ্রহপ্রাপ্ত কবিদের সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম অনেকটাই ইতিহাসের উপাদান।

এ কথা নিশ্চিত বলা যায় যে, এই বাংলায় সম্রাট সুলতান রাজা কিংবা সামন্ত নৃপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্য, নাটক, শিল্পকলা আর নন্দনতত্ত্বের সব শাখাই সমৃদ্ধ হয়েছে। মধ্যযুগের যে অমর সাহিত্যকীর্তি যা আমাদের গৌরবের ধন, তার অধিকাংশই রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্টি হয়েছে।তাই কবিরা তাদের রচনাসম্ভারে নিজের নাম কিংবা বংশপরিচয়ের শুরুতে রাজস্তুতি করতে ভোলেননি। 
মৌর্যযুগে রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। তাঁর রচিত ‘হর্ষচরিতে’ হর্ষবর্ধনের পিতা প্রভাকর বর্ধনের প্রশস্তিতে লেখা হয়েছে ‘তৈব চৈরমুৎপদ্যমানেষু ক্রোমলোদপাদি হুনহরিণকেসরী, সিন্ধুরাজেশ^র গুর্জ্জরপ্রজাগর গান্ধারধিপ গন্ধদ্বিপ কুটপাকল’ তিনি হুন হরিণের কেশরী, সিন্ধুরাজগণের জ¦রস্বরূপ, গুর্জ্জরগণের ঘুম হরণকারী, গান্ধার রাজরূপী গন্ধহস্তির জন্য কুটপাকল নামক সংক্রামক ব্যাধিস্বরূপ, লাটদেশীয় দস্যুগণের দস্যু ইত্যাদি ইত্যাদি। কুষান সম্রাট কনিষ্ক এর সভাকবি ছিলেন নাগার্জ্জ্ুন, অশ^ঘোষ প্রমুখ। বিখ্যাত কবি কালিদাস ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা বিক্রমাদিত্যের সভাকবি। তিনি রচনা করেছিলেন রঘুবংশ, কুমারসম্ভব ইত্যাদি।

রঘুবংশ গুপ্ত রাজবংশের প্রশংসা আর স্তুতিতে ভরা, আর কুমারসম্ভবে তিনি বিক্রমাদিত্যের পুত্র কুমারগুপ্তকে দেবতা কার্ত্তিকেয়র সঙ্গে তুলনা করে গেছেন। গুপ্তযুগে স¤্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজকবি সান্ধিবিগ্রহিক কুমারমাত্য হরিষেণ সমুদ্রগুপ্তের দিগি¦জয় কাহিনী নিয়ে অসংখ্য শ্লোক রচনা করেছিলেন যা অশোকের শিলালিপিতে উৎকীর্ণ আছে।মধ্যযুগের সাহিত্যে রাজমহিমা কীর্তন আর প্রশস্তির ছড়াছড়ি। ঘনারামের ধর্মমঙ্গল কাব্যের ভণিতায় আছে, ‘ধার্মিক ধরণীতলে ধর্মপাল রাজা/প্রিয়পুত্র প্রায় পালে পৃথিবীর প্রজা।’

ধর্মপাল ওরফে বিরুদ বিক্রমশীল ৭৮১ খ্রি. থেকে আনুমানিক ৮২১ খ্রি. পর্যন্ত বরেন্দ্রীতে রাজত্ব পরিচালনা করেন।দ্বিতীয় বিগ্রহপালের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম মহীপালদেব ৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করে পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। ‘গৌড়লেখমালা’য় রাজপ্রশস্তি করা হয়েছে ‘হতসকল বিপক্ষ: সঙ্গরে রাহুদর্পাদনধিকৃত বিলুপ্তং রাজ্যমাসাদ্য পিতাং নিহিত চরণপদ্ম ভূভৃত্বাং মুর্দ্ধ তস্মাদভবনীপাল শ্রী মহীপালদেব’। অর্থাৎ শ্রী মহীপাল রণক্ষেত্রে বিপুল বিক্রম ও দর্প প্রকাশ করে বিপক্ষদলকে হারিয়ে বিলুপ্ত পিতৃরাজ্য উদ্ধার করে পরাজিত রাজাদের মাথায় নিজের পা’দুটি স্থাপন করে অবনীপাল হয়েছিলেন।

গৌড়লেখমালা’য় আর একটি রাজপ্রশস্তিতে দুটো শ্লোক পাওয়া যায়। ড. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ গ্রন্থ অনুযায়ী এর অর্থ হচ্ছে ‘সূর্যদেব হইতে যেমন কিরণকোটিবর্ষী চন্দ্রদেব উৎপন্ন হইয়াছেন, তাহা হইতেও সেইরুপ রত্নকোটিবর্ষী বিগ্রহপালদেব জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।  নয়নান্দদায়ক সুবিমল কলাময় সেই রাজকুমারের উদয়ে ত্রি-ভূবনের সন্তাপ বিদুরিত হইয়া গিয়াছিল।

তদীয় অভ্রতুল্য সেনা-গজেন্দ্রগণ প্রথমে জলপ্রচুর পূর্বাঞ্চলে স্বচ্ছ সলিল পান করিয়া তাহার পর মলয়োপত্যকার চন্দন-বনে যথেচ্ছ বিচরণ করিয়া ঘনীভূত শীতল-শীকরোৎক্ষেত্রে তরুসমূহের জড়তা সম্পাদন করিয়া হিমালয়ের কটকদেশ উপভোগ করিয়াছিল।’পালবংশের সর্বাধিক আলোচিত রাজা রামপাল ১০৮২ খ্রি. থেকে ১১২৪ খ্রি. পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। ড. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একই গ্রন্থে আরও লিখছেন ‘খ্রিস্ট্রীয় একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে রামপালকে রামের সহিত তুলনা করা কবিগনের মধ্যে সংক্রামক হইয়া উঠিয়াছিল।

বৈদ্যদেবের প্রশস্তি রচয়িতা মনোরথও এই উপমা ব্যবহার করিয়াছিলেন। ‘সেই প্রবল পরাক্রমশালী নরপালের রামপাল নামক এক পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি পাল কুল-সমুদ্রত্থিত শীতকিরণ চন্দ্ররূপে প্রতিভাত এবং সা¤্রাজ্যলাভে খ্যাতিভাজন হইয়াছিলেন। রামচন্দ্র যেমন অণর্ব লঙ্ঘন করিয়া রাবণ বধান্তে জনকনন্দিনী লাভ করিয়াছিলেন রামপালদেবও যুদ্ধার্ণব সমুত্তীর্ন হইয়া ভীম নামক ক্ষৌনীনায়কের বধসাধন করিয়া জনকভূমি বরেন্দ্রীলাভে ত্রিজগতে আত্মযশ বিস্তৃত করিয়াছিলেন।’

এটি কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিতের’ কবিপ্রশস্তি। তিনি পাল রাজবংশের সভাকবি ছিলেন। বরেন্দ্রীকে ‘বসুধা শিরোবরেন্দ্রী চুড়ামণি’ উল্লেখ করে এগারো শতকের শেষভাগে পালরাজা দ্বিতীয় মহীপালের সময়ে দিব্যক আর রুদ্রকের নেতৃত্বে কৈবর্ত বিদ্রোহের ঘটনাকে ‘অলীক ধর্মবিপ্লব’ (অন্যায় বা অপবিত্র) আর দিব্যককে ‘কুৎসিত কৈবর্তনৃপ’ ‘ভবস্য আপদম’ ইত্যাদি বলে তিনি অভিহিত করেছেন। প্রায় ৩৭ বছর কৈবর্ত নেতৃত্ব বরেন্দ্রী শাসন করে, পরে রুদ্রকের পুত্র ভীম রামপালের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও সপরিবারে নিহত হলে বরেন্দ্রীতে কৈবর্ত শাসনের অবসান হয়।

সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত একাধারে কাব্য ও ইতিহাস। এখানে রঘুপতি রামচন্দ্র ও পালরাজা রামপালের কীর্তিমহত্ব একই কাব্যে অদ্ভুতভাবে উপস্থাপন করেছেন কবি সন্ধ্যাকর নন্দী। এখানে কবিপ্রশস্তি অংশে বিশটি শ্লোক রয়েছে। লক্ষণসেনের আমলে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি কবি শ্রীধর দাস সংকলিত ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ নামে একটি কাব্যসংকলন পাওয়া যায়। শ্রীধর দাস সেন রাজসভায় মহামান্ডলিক ছিলেন বলে জানা যায়। সদুক্তিকর্ণামৃত সংকলনটিতে একটি প্রবাহ বা অধ্যায়ের নাম ‘চাটুপ্রবাহ’ । এতে বিভিন্ন কবির মোট ২৭০টি শ্লোক সংকলন করা হয়েছে।

চাটুপ্রবাহে আছে রাজাদের প্রশস্তিকীর্তন, যুদ্ধবিষয়ক বিবরণ, ক্ষাত্রবীর্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন, আর দান ক্ষমা ইত্যাদি মহৎ বৃত্তির প্রতি শ্রদ্ধার্পণ। বল্লাল সেন ও লক্ষণ সেনের সভায় সভাকবি ছিলেন শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন, জয়দেব, উমাপতি ধর প্রমুখ। সদুক্তিকর্ণামৃতে উমাপতি ধরের একটি শ্লোকে পাওয়া যায় ‘সাধুম্লেচ্ছ নরেন্দ্র সাধুভবতো মাতৈব বীরপ্রসূনীচে না পি/ভবদ্বিধেন বসুধা সূক্ষ্মত্রিয়া বর্ততে। (সাধু! হে ম্লেচ্ছরাজ সাধু! আপনার বীর প্রসবিনী মাতা নীচ কুলোদ্ভব হলেও আপনার মতো লোক দিয়েই পৃথিবী সূক্ষ্মত্রিয় পরিপূর্ণ হয়েছে)।

কবি জয়দেব লক্ষণ সেনের উদ্দেশ্যে প্রশস্তি গাথায় লিখছেন ‘গৌড়েন্দ্র প্রতিরাজা রাজকরভালস্কর দৃষ্টতো সি তুষ্টাবয়ম! (রাজা ও রাজপ্রতিনিধি পরিবেষ্টিত সভার অলঙ্কারস্বরূপ হে গৌড়পতি আপনাকে দেখে তুষ্ট হলাম) বিজয়কাব্য বা চরিতকাব্যের প্রধান কবি মালাধর বসু, তাঁর কাব্যরচনা রুকনউদ্দিন বারবাক শাহ্ (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রি.) এর পৃষ্ঠপোষকতায়। কবি এভাবে তাঁর আত্মপরিচয় দিচ্ছেন ‘গুণ নাহি অধম নাহি কোনো জ্ঞান, গৌড়েশ^র দিলা নাম গুণরাজ খান’।

প্রাচীনতম বাঙলা কাব্যের কবি শাহ মুহম্মদ সগীর কর্তৃক গৌড়েশ^র গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ্ (১৩৮৯-১৪১০ খ্রি.) এর শাসনামলে রচিত একটি পদের ভণিতায় পাওয়া যায় ‘তিরতি এ পরনাম কর রাজ্যখ ঈশ^র/বাঘে ছাগে পানি খায় নির্ভয় নির্ভর/রাজরাজেশ^র মধ্যে ধার্মিক প-িত/দেব অবতার নিপ জগত বিদিত’। বিজয় কাব্য ধারার মুসলিম কবি জৈনুদ্দিন, তিনি ছিলেন গৌড়ের সুলতান ইউসুফ শাহ্ (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রি.) এর সভাকবি। তার রচিত কাব্যের নাম ‘রসুল বিজয়’। কাব্যের ভূমিকায় যথারীতি রাজবন্দনায় রয়েছে ‘শ্রীযুত ইছুপ খান জ্ঞানে গুণবন্ত/রসুল বিজয়বাণী কৌতুকে সুনন্ত/সুধীর সুজ্ঞানবন্ত অতি সুনায়ক/শুনি পরিতোষ ভেল ইছুপ নায়ক।’

এভাবে এই কাব্যগ্রন্থে মোট পাঁচবার তিনি ইউসুফ শাহ্ এর প্রশস্তি করেছেন। ভণিতায় ইউসুফ শাহ্ কে তিনি রাজরতœ, রাজেশ^র, নায়ক, সুনায়ক ইত্যাদি অভিধায় ভুষিত করেছেন। বিজয়গুপ্ত হোসেন শাহ্ ওরফে জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ ্(১৪৮৪-৮৭ খ্রি.) এর নাম উল্লেখ করে প্রশস্তি লিখেছেন ‘ঋতুশশী বেদশশী পরিমিত শক/সুলতান হুসেন রাজা পৃথিবী পালক/সমরে দুর্জয় রাজা বিপক্ষের যম/দানে কল্পতরু রাজা রূপেকামে সম।’ বিপ্রদাস পিপলাই লিখছেন ‘সিন্ধু ইন্দু বেদ শক পরিমাণ/ নৃপতি হুসেন শাহ্ গৌড়ে সুলতান’। শ্রীধর দাস বিদ্যাসুন্দর কাব্যে যুবরাজকে রাজা এবং শাহ্ বলেও স্তুতি করেছেন ‘শ্রীযুত নায়ক সে যে নসরত খান/রচাইল পাঞ্চালি যে গুণের বিধান/রাজা ছিরি পেরোজ সাহা বিনোদ সুজান।’

হুসেন শাহ্ এর রাজসভায় কবিগণ তাঁর প্রশংসায় মুক্তকণ্ঠ ছিলেন। তাঁকে অবতার পুরুষ হিসেবে ঘোষণা করতেও কুণ্ঠিত হননি। কবি পরাগল খাঁ রচিত পরাগলী ভারতে কবি লিখছেন ‘নৃপতি হুসেন শাহ্ এ মহামিতি/পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি/অস্ত্রশস্ত্রে সুপ-িত মহিমা অপার/কলিকালে হৈব যেন কৃষ্ণ অবতার। কবিচন্দ্র মিশ্র রচিত গৌড়ীমঙ্গলের কবিতার উপক্রমে বন্দনা ও ভণিতা অংশে রাজ প্রশংসা পাওয়া যায়। ‘পৃথিবীর সার রাজ্যে পঞ্চগৌড় নাম/নৃপতি হুসেন শাহ্ কলিযুগে রাম/খান্ডায়ে প্রচ- রাজা প্রতাপে তপন/যার ভয়ে কম্পিত সকল নৃপগণ।

পঞ্চগৌড় বলতে তৎকালীন সারস্বত, কান্যকুজ, গৌড়, মৈথিল ও উৎকল ভূমি বোঝানো হয়েছে। বাংলায় রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝা নিজেও রাজশ্মশানের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। তিনিও রাজ কৃপাধন্য পুরুষ। তিনি এক ভণিতায় লিখছেন ‘পঞ্চগৌড় চাপিয়া গৌড়েশ^র রাজা/গৌড়েশ^র পূজা কৈলে গুণের হয় পূজা’। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ‘ব্যাড়িভক্তিতরঙ্গিনীর’ ভণিতায় লিখছেন ‘ইতি সমস্ত প্রক্রিয়ালঙ্কৃত ভূপতিবর বীর শ্রী দর্পনারায়ণ দেবেন সমরবিজয়িনাজ্ঞাপ্ত শ্রী বিদ্যাপতি কৃত শ্রী ব্যাড়িভক্তিতরঙ্গিন্যাস প্রমাণ তরঙ্গ প্রথম- শ্রী ব্যাড়িচরণে মদ্ভক্তিরস্থ’।

অর্থাৎ ভূপতিবর সমরবিজয়ী বীর শ্রী দর্পনারায়ণের আগ্রহে তিনি ব্যাড়িভক্তিতরঙ্গিনী রচনা করেছেন। মিথিলার এই দরবারি কবি ১৪৫৫ খ্রি. অবধি অসংখ্য পদ রচনা করে কামেশ^র বংশের প্রথম রাজা ভোগীশ্বর থেকে রাজা কংশনারায়ণ বীরসিংহ পর্যন্ত সব রাজা রাজকুমার ও রানীদের প্রশংসাসূচক ভণিতা করেছেন। এমনকি তুঘলুক বংশের নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহ্, গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ, হুসেন শাহ শকী, মালিক বাহার উদ্দিন প্রমুখের প্রশস্তি যোগ করেছেন তাঁর কাব্যে। যেমন ‘কবি শেখর ভনে অপরূপ রূপ দেখি/রাত্র নসরদ শাহ ভজলি কমলমুখী। কিংবা নাসির শাহ ভনে/মুজে হানল নয়ন বানে/চিরঞ্জীব বহু পঞ্চ গৌড়েশ^র’।

আওরঙ্গজেব কর্তৃক বিতাড়িত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সুবে বাঙলায় ১৬৩৯-১৬৫৯ খ্রি. পর্যন্ত সুবেদার ছিলেন তাঁর ভাই সুজা। ধর্মমঙ্গলের কবি রূপরাম চক্রবর্তী লিখছেন ‘রাজমহলের মধ্যে যবে ছিল সুজা/পরমকল্যাণে যত আছিলেক প্রজা’। ষোলো শতকে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চন্ডীমঙ্গল রচনা করেন, সেখানে প্রশস্তি আছে ‘ধন্যরাজা মানসিংহ/বিষ্ণুপদাম্বুজ-ভৃঙ্গ/গৌড়-বঙ্গ-উৎকল অধিপ’।

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীসহ দিল্লি সালতানাতের একাধিক সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে সভাকবি ছিলেন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ আমির খসরু, যাকে ‘তুতি-ই-হিন্দ’ বা ভারতের তোতাপাখি বলা হতো। স¤্রাট আকবরের সভাকবি আবুল ফজল, মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ কবি মীর্জা গালিব সবাই রাজ অনুগ্রহে ধন্য। এভাবেই যুগে যুগে কবির ভণিতা আর প্রশস্তিগাথায় রাজমাহাত্ম্য আরও উজ্জ্বল হয়েছে। কবি ও কাব্যের এই রাজন্যবর্গ সবাই বীরত্বে প্রজাপালনে আর রাজধর্মে অনন্য। তবে এই বিপুলায়তন মহৎ কাব্যসম্ভার সৃষ্টির পেছনে যে রাজ পৃষ্ঠপোষকতা অনিবার্য ছিল তার ঐতিহাসিক প্রয়োজন আর অবদানকে কখনো উপেক্ষা করা যাবে না।

×