ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনানন্দকে ডেকেছিল হেমন্তের প্রকৃতি

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ০১:১৫, ২৪ মার্চ ২০২৩

জীবনানন্দকে ডেকেছিল হেমন্তের প্রকৃতি

ঋতুচক্রে বাংলায় এখন হেমন্তকাল এসেছে

ঋতুচক্রে বাংলায় এখন হেমন্তকাল এসেছে। ঋতুর রাজা বসন্ত এবং ঋতুর রানী শরৎ স্বীকৃত হলেও আরও একটি ঋতু মায়াময় রূপের যা শরৎ এবং বসন্ত ঋতুর মাঝামাঝি প্রকৃতিতে বিরাজ করে। প্রকৃতিতে যে বড় একটি পরিবর্তন অর্থাৎ শীত আসতে চলেছে তার সূচনা হয় হেমন্তে। তাই স্বাভাবিকভাবেই হেমন্ত ঋতু নিয়ে কবিতা, গান ও গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে। হেমন্ত ঋতুর গুণগান উঠে এসেছে বারবার। কার্তিকের অসাধারণ রূপ আর অগ্রহায়ণের নবান্ন সব মিলিয়ে অসাধারণ রূপ বিরাজ করে প্রকৃতিতে।

এই রূপের টানেই কি না তিমির হননের কবি বা রূপসী বাংলার কবি নামে পরিচিত কবি জীবনানন্দ দাশ একবার নয় বারবার তার কবিতায় হেমন্তকাল এনেছেন। কখনো কার্তিকের নবান্নের দেশে তার ফিরে আসার যে আকুতি তা তো আর এমনি এমনি হয়নি। এ রূপের মায়া এমনি। কবির ’একটি নক্ষত্র আসে’ কবিতায় লিখেছেনÑ ’একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চলে/ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে/সে আসবে মনে হয়;- আমার দুয়ার অন্ধকারে। হেমন্তে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের বহু ব্যবহার দেখা যায় নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতায়। বারবার হেমন্ত এসেছে তার কবিতায়।

হেমন্তের মাঠ-ঘাট, সন্ধ্যা, কুয়াশা, শিশির ভেজা ভোর সব তাকে দারুণভাবে টেনেছে। তার বিখ্যাত কবিতা- ’আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় লিখেছেন, ’আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে/এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়-/হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়। এই কবিতাংশে কবি যেভাবেই ফিরে আসতে চান তা কিন্তু আসতে চেয়েছেন হেমন্তের নবান্নে।

অর্থাৎ এই সময়টা বাংলার বিশেষ একটি সময়। বিশেষত প্রাচীন বাংলায় এই ঋতুর গুরুত্ব ছিল আরও বেশি। অর্থাৎ এদেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষক ও কৃষিনির্ভর জীবিকা সেই প্রাচীনকাল থেকেই। পাকা ধান ঘরে তোলার সময় এই কার্তিক-অগ্রহায়ণ। মহাজনের ঋণ শোধ করে ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েসের আয়োজনের উপলক্ষ এই হেমন্তেই। 
কালের বিবর্তনে সেই গুরুত্ব কমলেও হেমন্ত আজও কৃষকের ঘরে আনন্দের উৎস হিসেবে কাজ করে। বাংলার প্রতিটি ঋতুর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সব মিলিয়েই এই বাংলা। হেমন্তের মাঠ-ঘাট, শিশির ভেজা সকাল, মাঠের পাকা সোনালি ধান, কৃষকের ধান ঘরে তোলার দৃশ্য, ঘরে ঘরে ডোলা ভর্তি ধান, কৃষক-কৃষাণির আনন্দ সবই হেমন্তের রূপের অনুষঙ্গ।

এই যে শীতে আমরা জড়োসরো হয়ে যাই তার আগমনী বার্তা শোনায় হেমন্ত। জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্তকালের উপস্থিতিতে মনে হয় এই ঋতুই তাকে বেশি টেনেছে। যেখানে ঋতুরাজ বসন্ত ও শরতের বর্ণনাও এতবার এতভাবে আসেনি। জীবনানন্দ দাশের ‘একদিন এই কুয়াশার মাঠে’ কবিতায় শীতের বর্ণনা থাকলেও এর কয়েকটি লাইনে হেমন্তের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি সেখানে লিখেছেন’ আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রব কিছু কাল/অন্ধকার বিছানার কোলে/আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে/আজও কি মাঠের কুয়াশায় ভেসে আসে?/ সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে/আজও চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে/ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ/নক্ষত্রের দিকে আজও চায়?’ এখানে ’সন্ধ্যা সোনার মতো হলে এবং ধানের নরম শিষে শব্দগুলো হেমন্তের বর্ণনার ইঙ্গিত করে।

শীতে সন্ধ্যা ঢাকা থাকে কুয়াশায় আর ধান তখন কাটা শেষ হয়ে যায়। ফলে এগুলো হেমন্তের বর্ণনাই। হেমন্ত ঋতুতে চলে শীত-গরমের খেলা। হেমন্তের শুরুতে এক অনুভূতি আর শেষ হেমন্তে অন্য অনুভূতি। আর যা  দেখা যায় তা হলো ধানের হলদে রং যা মিশে যায় সন্ধ্যার সঙ্গে। উঠান ভর্তি থাকে ধানের ছড়া। এই কার্তিক মাসেই সে দৃশ্যের দেখা মেলে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও উল্লেখ আছে ধানের ছড়ার। তিনি তার ’কুড়ি বছর পরে’ কবিতায় লিখেছেন- ‘আবার বছর কুড়ি পরে তার সঙ্গে দেখা যদি হয়/আবার বছর কুড়ি পরে-/হয়তো ধানের ছড়ার পাশে/কার্তিকের মাসে/তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে/তখন হলুদ নদী/নরম নরম শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভেতর।’

আমাদের ফসল উৎপাদন এবং ঋতু নির্ভর ফল ঋতু বদলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ভিন্ন বৈচিত্র্যে হাজির হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের মনেও বৈচিত্র্য আসে।  
শরতের সাদা মেঘের ভেলা এখনও ভাসতে দেখা যায়। বিশেষ করে কার্তিকের আকাশে। প্রকৃতির এই নতুন সাজ বাংলার মানুষের কাছে খুব চেনা। শত বছরের পরিচিত দৃশ্য। বাংলার রূপের নাম হেমন্ত। আশি^ন পেরিয়ে কার্তিক এলেই নবান্নের ধূম পরে যায়। এর পরেই যেহেতু শীতকাল। তাই এ মাস থেকে শীতের আগমনী বার্তা জোরে- সোরেই বোঝা যেতে থাকে। হেমন্তের রাতে নক্ষত্ররা ঝরে পরে। অসংখ্যা তারায় ভরে থাকে আকাশ।

জীবনানন্দ দাশ তাই সেই হেমন্তেই ঝরে যেতে চেয়েছেন। এক অদ্ভুত মায়া ভরা রাত এই হেমন্তে নামে। তিনি তার ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতায় লিখেছেন- ‘তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে/আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!/যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে/পথের পাতার মতো তুমিও তখন/আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?। কবি এখানে হেমন্তের ঝড় বলতে প্রকৃতির রুদ্র রূপকে বুঝিয়েছেন না বুকের ভেতর ভেঙে যাওয়ার ঝড়কে বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। কারণ এ সময় মাঝে মাঝে প্রকৃতিতে ঝড়ও হয়।

আবার তিনি ‘যদি আমি ঝরে যাই একদিন’ কবিতায় বলেছেন, যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়/যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে ক্ষেতে স্থান চোখ বুজে/ যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপার নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে। এখানে কার্তিকের সন্ধ্যা ভেদ করে নীল আকাশজুড়ে কুয়াশায় কবি ঝরে যাওয়ার কথা বলেছেন। আর ধান ভরা ক্ষেত তো আছেই। খেজুর রস, হালকা শীতের মেজাজ, ঘাসের ডগায় শিশিরের অস্তিত্ব, সকালের মিষ্টি রোদ সবকিছুই যেন প্রকৃতির আশীর্বাদ হয়ে আসে আমাদের মাঝে। উল্লেখ্য, এই কবিতায় কবি অনেক প্রকারে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও ঋতু হিসেবে কার্তিক অর্থাৎ হেমন্তের প্রাধান্য দিয়েছেন। হেমন্ত এক অপরূপ রূপের ঋতু। যে ঋতুর সঙ্গে মানুষের আনন্দের যোগসূত্র রয়েছে। 
সারা বছরের মুখের অন্নের যোগানও আসে এ সময়। হেমন্ত তাই সুখ-সমৃদ্ধির কাল। হেমন্তের দুই মাস কার্তিক ও অগ্রহায়ণ রূপে আলাদা। শরৎ ও শীত দুইয়েরই দেখা মেলে হেমন্তে। তাই সম্ভবত হেমন্তকে খুব একটা আলাদা করার প্রয়োজন হয় না! সম্ভবত সেই পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখেই কবি তার ‘এই জল ভালোলাগে’ কবিতায় অঘ্রাণের স্তুতি করেছেন। তিনি লিখেছেন- আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে/ঝরে পড়ে;- যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ।

অঘ্রাণ বা অগ্রহায়ণ মাস এলেই শীতের তীব্রতা শুরু হতে থাকে। পাতা ঝরা দিনের শুরু হয় তখনই। এই পাতার সঙ্গেই কি জীবনানন্দ দাশ ঝরে পরতে চেয়েছেন? কবি তার ’লোকেন বোসের জার্নাল’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে/হৃদয় কেন যে কাঁপে/ভালোবাসতাম-স্মৃতি-অঙ্গার-পাপে/তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান। কবির একটি কবিতায় যেন অঘ্রাণকে ঘিরে। হেমন্ত এলে পাল্টে যায় প্রকৃতি ও মানুষ। গ্রামের পরিবেশে আনন্দ বিরাজ করে। তবে কবি জীবনানন্দ দাশ কিন্তু সেই আনন্দ পেয়েছেন অন্যভাবে।

অঘ্রাণ প্রান্তরে তিনি খুঁজেছেন অন্যকিছু। তিনি ‘অঘ্রাণ প্রান্তরে কবিতায় লিখেছেন,’ শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রাণ এসেছে/আজ পৃথিবীর বনে/সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ঘাসের ওপরে/সব বিছানো পাতার। আবার তিনি ‘অবসরের গান-১’ এ লিখেছেন, ‘যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায/তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে/আহ্লাদেও অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর/চারিদিকে ছায়া-রোদ-ক্ষুদ-কুঁড়া-কার্তিকের ভিড়। কার্তিক-অঘ্রাণের প্রতি কবির যে আলাদা মায়া ছিল সে কথা বলার প্রয়োজন নেই।

হেমন্তে এই ধরণীর অপরূপ রূপের যে ছটা ছিল তা এখন নেই। কবির ‘সেদিন এ ধরণীর’- ডেকেছিল ভিজে ঘাস,- হেমন্তের হিম মাস/জোনাকির ঝাড়/আমারে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল/মাঠ-শ্মশানের খেয়াঘাট আসি! কবিকে ডেকেছিল হেমন্তের হিম করা মাস। জীবনানন্দের বুকে যেভাবে হেমন্ত বাসা বেঁধেছিল আর কারও বুকেক হয়তো সেভাবে বাঁধেনি।

×