ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের মহানায়ক

জোবায়ের আলী জুয়েল

প্রকাশিত: ০১:২১, ১৭ মার্চ ২০২৩

ইতিহাসের মহানায়ক

ইতিহাসের মহানায়ক

পৃথিবীর ইতিহাসে, নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনে যে ক’জন ব্যক্তির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপনিবেশ বাদ ও কায়েমি স্বার্থের শৃঙ্খল ছিন্ন করে সাধারণ মানুষের অধিকার আর মানবতা প্রতিষ্ঠায় নিঃস্বার্থ প্রাণ ছিলেন এই মহান নেতা। সমগ্র জাতিকে সুসংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু বিপর্যস্ত জাতির সামনে খুলে দিলেন এক সোনালি ঊষার স্বর্ণদ্বার। তাঁর সাহসী নেতৃত্বে আমরা আজ স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করেছি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য (১৯৪৮ খ্রিঃ), পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক  (১৯৪৯ খিঃ), আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৫৩-১৯৬৬ খ্রিঃ), সভাপতি (১৯৬৬-১৯৭৪ খ্রিঃ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি (তাঁর অনুপস্থিতিতেই ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ খ্রিঃ), বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (১৯৭২ থেকে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ খ্রিঃ) এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিঃ)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা শায়েরা খাতুন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের একজন সেরেস্তাদার। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৪০ সালে। ১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি যুগ্ম সম্পাদকের পদলাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনে ১৪৩টি আসন লাভ করে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন এবং তিনি শ্রম মন্ত্রি হিসেবে দায়িত্ব  গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৫ সালে গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৫৭ সালের ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে তিনি মন্ত্রিসভা হতে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারি হয় এবং ১১ অক্টোবর নিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করে ১৯৬৬ সালে তিনি তার সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মতো শেখ মুজিব ও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করতেন।

একজন সংগঠক হিসেবে শেখ মুজিব দলের ওপর এতটাই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, সোহ্রাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে অগ্রসর  হতে সক্ষম হয়েছিলেন। 
তৎকালীন পূর্ব বাংলার ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একদল ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমবেত হলেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের কর্ণধার মি. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানের সফরে এলেন। তাঁরা জিন্নাহ সাহেবকে প্রশ্ন করলেন- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে?

জিন্নাহ সাহেব রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ভাষণের পুনরাবৃত্তি করে বললেন- ‘Urdu shall be the state language of Pakistan’ সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্র জনতা জিন্নাহ সাহেবের মুখের ওপর প্রতিবাদ করলেন। এখান থেকে সর্বপ্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ বিরোধী সংগ্রাম শুরু হলো। বাংলার অনল বর্ষী বক্তা সিংহ পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার দাবিতে গোটা বাংলাদেশের ছাত্রদের নিয়ে একটি গণআন্দোলন শুরু করলেন।

হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী রাজপথে নামলেন। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ঐতিহাসিক এই ভাষা তৎকালীন ১৯৪৮ সালের ‘সেপ্টেম্বর আন্দোলন’ নামে খ্যাত। এই আন্দোলনের সক্রিয় নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, মিসেস আনোয়ারা খাতুন, খয়রাত হোসেন, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, ডা. এএন মালেক ও তোফাজ্জল আলী প্রমুখেরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন একজন বাস্তববাদী রাজনীতিক, পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই তাঁকে বাঙালিদের স্বার্থ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে এক অকুতোভয় সেনানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। ৫২-এর বাংলার ভাষা আন্দোলনে প্রথম কারাবন্দীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৬০-এর দশকের প্রথম ভাগে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আওয়ামী লীগকে মজবুত ভিত্তির ওপর পুনর্গঠিত করে রাজনৈতিকভাবে একে একটি দক্ষ প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত ৬ দফা কর্মসূচী উত্থাপন করেন।

৬ দফাকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বশাসন প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ধরা হয়েছিল। ৬ দফা কর্মসূচী  পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের মর্মমূলে সুনির্দিষ্ট আঘাত হানতে পারায় তা অতিদ্রুত গোটা জাতির মনোযোগ আকর্ষণ করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক অবস্থানে ভীত সন্ত্রস্ত আইয়ুব সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখার নীতি গ্রহণ করে। ১৯৬৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়। আইয়ুব শাসনের অধিকাংশ সময়ই (১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারারুদ্ধ ছিলেন।

দ্বিতীয় দফায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব জনপ্রিয়তা ও সম্মোহনী নেতৃত্ব এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ১৯৬৯ সালের প্রথম ভাগে এক প্রবল বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে এবং ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব সরকার তাঁকে বিনাশর্তে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর কারামুক্তির পরের দিন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রমনা রেসকোর্স (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে শেখ মুজিবের সম্মানে ছাত্র-জনতা এক বিশাল নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তারা এক অবিসংবাদী নেতৃত্বকে খুঁজে পান যিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলের মধ্যে প্রায় ১২ বছর সময় কাল কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন।

এ সময়কার আন্দোলনে ছাত্রনেতা ছাড়াও মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, মওলানা ভাসানী, মহিউদ্দিন আহম্মেদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাকের আন্দোলনে আইয়ুব শাহী বাহিনীর হাতে গুলিতে নিহত হয় আসাদ, আনোয়ার, মতিউর, ডক্টর জোহা প্রমুখ নেতাকর্মী।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মুখপাত্রের স্বীকৃতি লাভ করেন। তাঁর ঘোষিত ৬ দফার দাবির পক্ষে জনগণ নিরঙ্কুশ রায় দেয়। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আহবান জানান ‘আসুন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই ৬ দফা সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা করি।’

এর পরই শুরু হয় পাকিস্তানের রাজনীতিতে নাটকীয় পটপরিবর্তন ও নেপথ্যের মহড়া। ১৯৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন জনগণের নির্বাচনী বিজয় বানচাল করার প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সজাগ সতর্ক থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। ১ মার্চ ১৯৭১, ঢাকা স্টেডিয়াম দর্শকে পরিপূর্ণ ক্রিকেট খেলা চলছে। এর দু’দিন পরেই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। হঠাৎ করে ঘোষণা দুপুর ১টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেবেন, কিন্তু না প্রেসিডেন্টের ঘোষণা পাঠ করে শোনালেন অপর ব্যক্তি।

জাতীয় পরিষদের বৈঠক ৩ মার্চ ঢাকায় বসবে না। জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের সুযোগ দানের পরিবর্তে তারা জনগণের রায়কে পদদলিত করার দৃঢ় সঙ্কল্প নেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফা বাতিল করে দেন। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে ওঠে।
আওয়ামী লীগের সে সময় একক বিজয় অর্জিত হয়েছিল। ওই সময় আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা ছিল জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৮৮টি। ইয়াহিয়ার ঘোষণা বেতারে পাঠ করার পর পরই গর্জে উঠল সমগ্র ঢাকা। বন্ধ হয়ে গেল ক্রিকেট খেলা, হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢল নামে রাস্তায়। বিকেল ৪টায় এক হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘এটা গণতন্ত্র নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতামত উপেক্ষা করে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতার দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে’ হোটেলের সামনে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন ‘জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত রাখার একটি সুগভীর চক্রান্ত।’

এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। তিনি এই ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ইতিহাসের সুচিহ্নিত সাল। এই দিনে দশ লক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ জনতার সমাবেশ তিনি ঘোষণা করেন এই ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে ২৫ মার্চ রাত দেড়টায় গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২নং বাড়ি থেকে। এই ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাঙালী হত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের আগেই স্বাধীনতা ঘোষণা দেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতের অন্ধকারে জীবন রক্ষার্থে অন্য কোথাও পালিয়ে না গিয়ে তাঁর জন্মভূমি বাংলায় থেকে যান। তাঁর পলায়নী মনোবৃত্তি কখনও ছিল না। তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসতেন। মৃত্যুর ভয় তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। এমন দুঃসাহসী নেতা, এমন ক্ষণজন্মা পুরুষ যুগ যুগান্তরের ব্যবধানে কদাচিৎ পরিলক্ষিত হয়।

তাঁর জীবন নাট্যের অনেক দুর্জয় কাহিনী ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। তাঁর অনুপস্থিতিতে গঠিত হয় মুজিব নগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তাঁর অবর্তমানে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য, সংহতি এবং শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইতিহাসের সুচিহ্নিত সাল। এই দিন বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তিপান এবং ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতোত্তর  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সরকারকে অত্যন্ত প্রতিকূল এবং বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। তাঁর সরকারকে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুনর্প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন এবং তাদের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি, বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্¯’াপন, জনগণের রুদ্ররোষ থকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের জীবন রক্ষা এবং অসংখ্য অনাহারী ক্ষুধার্ত মানুষের অন্ন যোগানসহ অন্যান্য কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
যার উদাত্ত আহ্বানে একদিন জেগে উঠেছিল সমগ্র বাঙালী জাতি। ত্রিশ লাখ বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত এই বাংলাদেশে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঐক্য ও মুক্তির প্রতীক, বাঙালী জাতির সকল প্রেরণার উৎস, যোজন যোজন দূরের স্বাধীনতার স্বপ্নকে যিনি বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন, সেই মহান দেশ প্রেমিক, আপোসহীন সংগ্রামী নেতা বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী উচ্চাভিলাষী ও উশৃঙ্খল তরুণ অফিসার ও সৈনিকের হাতে ধানম-ি নিজ বাস ভবনে সপরিবারে নিহত হন। এভাবেই অবসান ঘটে একজন কীর্তিমান নেতার জীবন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তারা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ কামাল, পুত্র লে. শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সের নিয়াবত ও তাঁর কন্যা বেবি সের নিয়াবত, পুত্র আরিফ সের নিয়াবত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাতুষ্পুত্র শহীদ সের নিয়াবত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল আহম্মেদ এবং ১৪ বছরের কিশোর আব্দুল নঈম খান রিন্টুসহ ১৬ জন কে নির্মমভাবে হত্যা করে। কী  নিদারুণ হত্যাকা-।
বাঙালী জাতিকে সুসংঘটিত করে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে গৌরবান্বিত আসন দানের একক কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি সমগ্র জীবন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসের এই অধ্যায়ের মহানায়ক হচ্ছেন- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঞ্চিত, পশ্চাৎপদ, পরাধীন জাতিকে বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে তিনি ঐক্যবদ্ধ, সচেতন ও সংগঠিত করেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ত্রিশ লাখ শহীদের স্বপ্ন, মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জিত হয়নি আজও। যে শহীদেরা আমাদের হাতে দেশের স্বাধীনতা তুলে দিয়ে গেছেন তাঁদের মৃত্যু নেই। তাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীন দেশে মানুষ পেট ভরে খেতে পাবে। পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন, তখনই শুধু এই লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি খুঁজে পাবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অবহেলিত নিপীড়িত মানুষের মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার দাবির সফল বাস্তবায়ন করে গেছেন। তিনি বাঙালীর বেঁচে থাকার দাবি হিসেবে যে ছয় দফার আন্দোলন শুরু করেন তা ছিল এদেশের মানুষের মুক্তি সনদ-শোষকের হাত থেকে শোষিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তিনি বাঙালী জাতিকে মুক্তির পথনির্দেশ দেন। তিনি ছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার অনির্বাণ উৎস। তাঁর মহান নেতৃত্বে ও প্রেরণায় বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত বীর জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। সারা জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার মহান গুণ তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল। তাই তাঁর আত্মত্যাগ জাতিকে এক সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি ৭ মার্চ যে সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছিলেন তা থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা আসে। স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে তিনি জাতিকে মুক্তির পথনির্দেশ দেন। এদেশের মুক্তি সংগ্রামের পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বুকে চির অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। কবির ভাষায়-
‘যতদিন রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরী, মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

×