ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নিষিদ্ধ লোবান ও একটি সাহসী নারী চরিত্র

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ৯ মার্চ ২০২৩

নিষিদ্ধ লোবান ও একটি সাহসী নারী চরিত্র

.

বাঙালির একটি নিজস্ব ঠিকানা, একটি পরিচয়, একটি পতাকা, ভূখন্ড এসব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক সাগর রক্তের ইতিহাস, লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি অধ্যায় যা ছড়িয়ে গেছে নতুন প্রজন্মের বুকে, তারা সেই ক্ষণ অনুধাবন করে এবং দেশের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে। বাংলা সাহিত্যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে শত শত কবিতা, ছড়া, ছোট গল্প, বড় গল্প, শিশুতোষ গল্প, উপন্যাস এবং তা থেকে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। এখনো প্রতিনিয়ত সেই চর্চা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে। সাহিত্যের একেকটি শাখা নতুন করে মুক্তিযুদ্ধ তৎকালীন পরিস্থিতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে। কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প, উপন্যাস প্রবন্ধের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছেন লেখকরা। মুক্তিযুদ্ধ হলো সাহিত্য রচনার একটি অন্যতম প্রধান এবং বৃহৎ ক্রম।

ভবিষ্যতেও আরও অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হবে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এটাই হওয়া উচিত। নতুন প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তারা এসব পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এসব রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি উপন্যাস হলো সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরও রচনা করেছেন। প্রতিটি উপন্যাসই সাহিত্যের বিবেচনায় এক অমূল্য সম্পদ। এসব উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সূচারুরূপে বর্ণনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক কাহিনী নিয়ে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। সেসব সিনেমা উপন্যাস বা গল্পের মতোই স্বার্থক এবং জনপ্রিয়। উপন্যাসে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে যা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়।নিষিদ্ধ লোবানে রয়েছে এরকম প্রধান চরিত্র।নিষিদ্ধ লোবানে কাহিনী অবলম্বনেও চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। চলচ্চিত্রটির নামগেরিলানিষিদ্ধ লোবানবইটি যেমন আমি কয়েকবার পড়েছি, গেরিলা সিনেমাটিও দেখেছি বহুবার। প্রতিবারই এই বইয়ের বা ঘটনার প্রাসঙ্গিকতার মূল চরিত্রবিলকিসকেগভীরভাবে লক্ষ্য করেছি। বইটি পড়ার সময়েও তাই।বিলকিসচরিত্রটির ভেতর আমি সেই বাঙালি নারী চরিত্র খুঁজে পাই  যে ব্রিটিশদের অত্যাচার আর বন্দুকের নলের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছে। মোটকথা, একটি সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক নারী চরিত্র ফুটে উঠেছে বিলকিসের ভেতর। আবার মমতাও ফুটে উঠেছে সমানভাবে।

সেই মমতা যেমন তার দেশপ্রেমিক ভাইয়ের জন্য তেমনি তার সঙ্গে শুরু থেকেই সঙ্গ দেওয়া একজন ভিনধর্মের তরুণের জন্য। দুই-জনই তার ভাই। উপন্যাসের গল্পের কাহিনী শুরু হয়েছে বিলকিসকে দিয়ে। সিনেমা এবং উপন্যাস দুই জায়গাতেই। ঘটনার মূল জায়গা হলো জলেশ^রী। বিলকিসের জন্মভিটে। গল্পের শুরুতে বিলকিস সেখানেই যাওয়ার চেষ্টা করে। বিলকিস গ্রামেই আসতে থাকে। কিন্তু ততদিনে গ্রামের পরিস্থিতিও খারাপ হয়ে গেছে। রাজাকার আর মিলিটারী গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, লুটপাট হয়েছে। এসবই কাহিনীতে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। যাত্রার বাহন ছিল ট্রেন। এখান থেকেই বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে বিলকিসের সাহসিকতা এবং দৃঢ় মনোবলের পরিচয় পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। ট্রেন থেকে নামার পর তার সঙ্গে সিরাজ নামে একটি ছেলের পরিচয় হয়। ছেলেটি আদতে হিন্দু। প্রথমে পরিচয় না দিলেও একসময় তার পরিচয় খোলাসা করে বিলকিসের কাছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। খবরাখবর পৌঁছে দেয়।

সেই সিরাজ আগের স্টেশনে ট্রেন বিলকিসকে নামিয়ে দিলে তার সঙ্গে সঙ্গে আসে। বিলকিসকে সাহায্য করে। যেখানে বিলকিসকে সাহায্য করা সিরাজের জন্য ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। এবং সত্যি সত্যি তাকে শেষ পর্যন্ত বিলকিসের জন্য মিলিটারির হাতে ধরা পড়তে হয়। মিলিটারির কাছে সিরাজকে তার ভাই বলে পরিচয় দেয়। যেহেতু সিরাজ হিন্দু এবং নির্যাতনের এক পর্যায়ে উলঙ্গ করে তার পরিচয় পায় তখন বিলকিসকেও হিন্দু ঘরের মেয়ে বলে নিশ্চিত হয় এবং পাকিস্তানি হানাদারদের স্বভাবজাত নোংরামি শুরু করে। ঠিক এই জায়গাতে উপন্যাসে বিলকিসের প্রচন্ড সাহসিকতা এবং মানসিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বিলকিসের ভাই খোকা। গেরিলা সিনেমায় সে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।

পাকিস্তানিদের হাতে সে ধরা পড়ে এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সিরাজ সে খবর জানতো কিন্তু বিলকিসকে তা জানতে দিতে চাচ্ছিল না। একসময় বিলকিস তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পায়। এটাও জানতে পারে যে তাকে খোলা রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। তাকে দেখতে গিয়ে এবং খোলা জায়গায় ফেলে রাখা লাশগুলো কবর দিতে গিয়েই তারা পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা যে ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি করে রেখেছিল তার বিপরীতে যুগিয়েছিল অসীম সাহস। যুদ্ধ জয়ের সাহস, বন্দুকের নলের সামনে দাড়ানোর সাহস। বিলকিসের কথায় তার প্রমাণ মেলে। বিলকিস সিরাজকে বলে, সিরাজ, মার্চ মাসের চব্বিশ তারিখেও যদি কেউ আমাকে বলতো, বেশি কিছু না, মাঝরাতে নির্জন একটা রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে যেতে পারবে? বিশ্বা কর, আমি কল্পনা করেও ভয়ে মরে যেতাম। কিন্তু তার স্বামী আলতাফের নিখোঁজ হওয়া, তার ভাই খোকার মৃত্যু এবং আরও মৃত্যুর ঘটনা সেই সময় বিলকিসদের মনে, সিরাজদের মতো উঠতি যুবকদের মনে ভয়ের পরিবর্তে দিয়েছিল প্রতিরোধের সাহস। বিলকিস এবং সিরাজ বা প্রদীপ (সিরাজের প্রকৃত নাম) এই দুজনের যাত্রাপথে অর্থাৎ খোকার লাশের কাছাকাছি পৌঁছাতে গিয়ে আরও বহু লাশের মুখোমুখি হয় ওরা। মানুষ তখন কতটা অসহায় তার বর্ণনাও উঠে এসেছে।

খলপাড়ে যখন দুটো বাচ্চাকে কবর দিতে আসে তখন হঠাৎ অন্ধকারে শিয়ালের চোখ ¦লজ¦ করে ওঠে। যেখানে মানুষের উপস্থিতি থাকায় তাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে তারা নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে লেখকের মন্তব্য হলো, মৃতের সংখ্যা যেখানে বেশি সেখানে জীবিত দুজনকে সে অতটা ভয় করেনি। অথবা পশু তার রক্তের ভেতরে অনুভব করতে পেরেছে, এরা প্রায় মৃত কিংবা অবসন্ন। উপন্যাসের গল্পের পুরো অংশেই বিলকিস এবং সিরাজের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকার বর্ণনা। এই উপন্যাসের ভিন্নতা অন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পের থেকে ভিন্ন হলো এই গল্পের বর্ণনায় অধিকাংশটাজুড়ে দুজন মানুষের ঘটনাক্রমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকারদের নির্যাতন, নৃশংসতার কথা বর্ণিত হয়েছে। গল্পের ধারাবাহিকতায় একেবারে শেষে একজন মেজরের চরিত্র আসে। বিলকিস এবং সিরাজকে আটক করে তার কাছে আনা হয়। ঠিক সেই সময় পাকিস্তানি মেজর তাদের তীব্র শারীরিক মানসিক নির্যাতন শুরু করে। হিংস্রতা, নোংরামি এবং নৃশংসতার সবটুকুই করে কথা বের করতে। বিলকিসের সঙ্গে মেজরের কথাবার্তার নমুনা হলো-

আমাকে একটা কথা বল, হিন্দু কি প্রতিদিন গোসল করে?’

নীরবতা।

হিন্দু মেয়েদের গায়ে নাকি কটু গন্ধ?’

নীরবতা।

শুনেছি মাদী কুকুরের মতো। সত্যি?’

নীরবতা।

শুনেছি, হয়ে যাবার পর সহজে বের করে নেওয়া যায় না?’

নীরবতা।

আমাকে কতক্ষণ ওভাবে ধরে রাখতে পারবে?

বাঙালি মেয়েদের মেজর হয়তো ভালোভাবে চিনতা না বা জানতো না। বাংলার ঘরে ঘরে তখন প্রীতিলতা তৈরি হয়েছে যে দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। হয়তো পরিকল্পনা করেই মেজরকে সিরাজের দেহ দাহ হওয়ার পর পর্যন্ত সময় চায়। শেষ পর্যন্ত সিরাজের অর্থাৎ প্রদীপের চিতাতেই মেজরকে ঠেসে ধরে। নিজে আত্মাহুতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজরকেও আগুনে দগ্ধ করে হত্যা করে।

×