ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার নবাব তনয়ার করুণ কাহিনী

জোবায়ের আলী জুয়েল

প্রকাশিত: ০১:২৩, ৩ মার্চ ২০২৩

বাংলার নবাব তনয়ার করুণ কাহিনী

বাংলার নবাব তনয়ার করুণ কাহিনী

পলাশীর যুদ্ধের প্রায় ১০০ বছর আগেকার ঘটনা। তখন সুলতান মুহম্মদ সুজা বাংলার শাসন কর্তা। ১৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে শাহ সুজা খবর পেলেন যে, সম্রাট শাহ জাহান গুরুতর পীড়ায় শয্যাগত। জ্যেষ্ঠ শাহজাদা দারা শেকোহ আগ্রায় সম্রাটের কাছে আছেন। খবরটা এমন ভাবে পৌঁছাল যে, সুজা সহজেই ভাবলেন সম্রাট জীবিত নেই এবং সম্রাটের মৃত্যু সংবাদ গোপন রেখে দারা সহস্তে সাম্রাজ্যের শাসন ভার গ্রহণ করেছেন। 
তখন রাজমহল ছিল বাংলার রাজধানী। সুজা রাজমহলে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করলেন এবং এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে আগ্রা অভিমুখে অভিযান করলেন। বারানসী পৌঁছতেই দারা শেকোহর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলায়মান শেকোহর পরিচালিত শাহী সৈন্য দলের সঙ্গে তাঁর মুকাবিলা হলো এবং তিনি পরাস্ত হয়ে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করলেন। 
সে সময় দারার বয়স ৪৩ বছর। সুজা তাঁর অপেক্ষা দু’বছর ছোট ছিলেন। সুজার দু’বছরের ছোট আওরঙ্গজেব তখন দাক্ষিণাত্যের ভাইসরর। সম্রাটের চতুর্থ ও সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র ৩৩ বছর বয়স্ক মুরাদ বখশ্ গুজরাটের শাসন কর্তা। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর মুরাদ রাজধানী আহমদাবাদে নিজেকে বাদশাহ বলে প্রচার করলেন। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে আগ্রা দুর্গ থেকে ৮ মাইল পূর্বে সামুগড় ময়দানে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের সম্মিলিত বাহিনী দারা শেকোহর ৫০ হাজার সৈন্যর সম্মুখীন হলো। দারার হস্তী আহত হওয়ায় যুদ্ধের গতি গেলো ফিরে।

আওরঙ্গজেব ৮ জুন আগ্রা দূর্গ দখল করেন। তিনি ১৩ জুন আগ্রা থেকে দিল্লী যাত্রা করেন। পথিমধ্যে মুরাদ সলিমগড় দুর্গে বন্দী হন। আওরঙ্গজেব দিল্লী উপনীত হয়ে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। 
সামুগড়ে দারার বিপর্যয়ে সুজা নতুন উৎসাহে ক্ষমতা দখলের জন্য আবার দিল্লী অভিমুখে অগ্রসর হলেন। কিন্তু এলাহাবাদের কাছে খাজোয়া প্রান্তরে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি আওরঙ্গজেবের হাতে তাঁর শোচনীয় পরাজয় ঘটলো। সুজা বাংলা অভিমুখে পশ্চাদপরণ করলেন।
সুজার পশ্চাদনুসরণ করলেন আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র মুহম্মদ সুলতান ও সুদক্ষ সেনাপতি মীর জুমলা। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল সুজা রাজমহল ছেড়ে গৌড়ের ৪ মাইল পূর্বে তোন্ডা নামক স্থানে এসে ঘাটি করলেন। তাঁর নৌবল ও পর্তুগীজ গোলন্দাজ বাহিনীর সামনে মীরজুমলা টিকতে পারলেন না। ৮ জুন ঘটল এক অভাবনীয় কা- শাহজাদা মুহম্মদ সুলতান চলে এলেন সুজার শিবিরে- বাগদত্তা সুজার তনয়ার প্রণয়ের আকর্ষণে। কিন্তু এ বির্পযয়েও মীরজুমলা হত্যোদাম হলেন না।

তিনি নতুনভাবে প্রস্তুত হতে লাগলেন। পরের বছর ১১ জানুয়ারি তিনি রাজমহল পুনরায় অধিকার করলেন। তখন সুজার পক্ষ ছেড়ে মুহম্মদ সুলতান সস্ত্রীক ফিরে গেলেন মীর জুমলার শিবিরে। সুজা বেগতিক দেখে ৬ মে ঢাকা ছেড়ে চাটগাঁ অভিমুখে পলায়ন করলেন। 
সে’সময় চাটগাঁ আরাকান রাজ্যের শাসনাধীন ছিল এবং চাটগাঁ বন্দরে পর্তুগীজ, আরব ও মালাবারের জাহাজ যাতায়াত করতো। সুজা সংকল্প করলেন চাটগাঁ থেকে জাহাজে মক্কা শরীফ যাবেন। তিনি হাতিতে চড়ে ত্রিপুরার বনাকীর্ণ দুর্গম পাবর্ত্য পথে চট্টগ্রাম পৌঁছলেন। কিন্তু তখন ঝড়ের মৌসুম। বাইরে যাওয়ার কোন জাহাজই বন্দরে পাওয়া গেল না। অগত্যা সুজা আশ্রয় লাভের আশায় নাফ নদী পার হয়ে আরাকানের রাজধানী মেয়ং নগরে উপস্থিত হলেন।

তখন তাঁর সঙ্গে ছিল প্রায় দুইশত অনুচর, তাঁর বেগম পরী বানু, তাঁর ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা, একজন বাদী ও একজন খোঁজা। সে সময় ত্রিপুরায় মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য তাঁর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ছত্র মাণিক্য কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে আরাকান রাজ সন্দ-সু-ধর্মের আশ্রয়ে অবস্থিতি করছিলেন। গোবিন্দ মাণিক্যের মুখে সুজার উচ্চ মর্যাদার কথা শুনে বৌদ্ধ রাজ সন্দ-সু-ধর্ম সুজা পরিবারকে সাদরে গ্রহণ করলেন। 
নদীর তীরে এক পাহাড়ের পাদ দেশে তাঁদের বাসের স্থান নির্দিষ্ট হলো। তখনও সুজার সঙ্গে প্রচুর স্বর্ণ-মাণিক্য ও হীরা-জহরত ছিল; সেই অর্থে সুজার পরিবার ও সহচরদের জন্য পৃথক প্রাসাদ নির্মিত হলো। (অদ্যাবধি মেয়ং শহরে সুজার মসজিদ ও সুজার দীঘি বিদ্যমান রয়েছে) কিন্তু সুজার আরাকান অবস্থানে মীরজুমলা নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তিনি সুজার অনুসরণে আরাকানে একটি রণতরী পাঠাবার জন্য ওলন্দাজ দিগকে চাপ দিলেন। তিনি গুপ্তচর পাঠিয়ে আরাকান রাজাকেও হাত করতে চাইলেন।

হুমকি বা উৎকোচ, যে কোন কারণেই হোক, কিছু কাল পরেই সুজা পরিবারের প্রতি আরাকান রাজ বিরূপ হয়ে উঠলেন। তিনি সুজাকে তাড়াবার মতলবে এই মিথ্যা অভিযোগ আনলেন যে, সুজা তাঁকে হত্যা করে রাজা দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। রাজার হুকুমে মগ সৈন্যরা ঢাল-তলোয়ার নিয়ে সুজাকে উৎখাত করতে অগ্রসর হলো। মোগলেরা আততায়ীর বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রাম করলো। সুজা তাঁর দু’জন পার্শ্বচরসহ আহত অবস্থায় বন্দী হলেন। তাঁদের নদীতে নিয়ে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হলো।

সুজার বেগম শাহপরী ও কন্যাগণ নিরুপায় হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু তাঁদের সহজে মরতে দেয়া হলো না- কয়েদ করে রাজ প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হলো। রাজা তাঁর প্রাসাদ কক্ষে শাহ পরীবানুর জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। রাজার এই ধৃষ্টতা দেখে শাহ পরী বানু নিষ্কাশিত করলেন তীক্ষè ছুরিকা। কিন্তু দুর্বৃত্তকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে শেষে সেই ছুরি দিয়ে নিজেরই প্রাণ বিসর্জন দিলেন। তাঁর দুই কন্যা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করল। তৃতীয় কন্যাটিকে রাজা বলপূর্বক বিয়ে করলেন। কিন্তু এই হতভাগিনীও অপমানের বোঝা বয়ে বেশিদিন বেঁচে রইলেন না। 
সুজার জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলতান বাকি যুদ্ধে আহত অবস্থায় ধৃত হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। তাঁর কনিষ্ঠ দুই ভ্রাতার ও একই গতি লাভ হলো। কিছুদিন পরে রাজ দ্রোহিতার মিথ্যা অভিযোগে পানির কুয়ায় তাঁদের ৩ জনের কবর রচিত হলো। এভাবেই আরাকানে শাহ সুজার বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। 
ইতিহাসে এই করুণ কাহিনী বাংলাগাঁথায় এক অপূর্ব শিল্পরূপ লাভ করেছিল। কিন্তু কালের আঘাতে সেই কথার মালা গেছে ছিন্ন হয়ে। যে দুটি টুকরো সংগৃহীত হয়েছে, তাতে মূল ঘটনার সূত্র কল্পনা করা চলে। প্রথম টুকরাটির শিরোনাম: পরীবানুর হাইলা- তার ধুঁয়া 
    সাগরে ডুবাইলি পরী রে।
    হায়! হায়! দুঃখে মরি রে॥
এই ক্ষুদ্র গীতিকাটিতে আছে সুজা ও সুজার মহিষীর ভাগ্য বিপর্যয় ও মৃত্যুবরণের মর্মান্তিক বিবরণ। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে-
    কি ভাবে গাহিব এই দুক্ষের বিবরণ
     যে হালে হইল সেই পরীর মরণ।
গ্রাম্য বয়াতি অশ্রু সিক্ত কণ্ঠে গেয়েছেন সেই শোক বিজড়িত গীত কাহিনী। 
    বার-বাঙলার বাদশা সুজা, রাজ্য ওর নাই,
    বাপের দিন্যা তখতের লাগি করিল লড়াই।
    মা’র পেটের ভাই যেহৈল কাল পরাণ বৈরীরে
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
    পিতৃ সিংহাসনের জন্য সহোদর ভাই চাইল ভাইয়ের বুকের রক্ত। বাধলো ভাতৃদ্বন্দ্ব। বয়াতি বলেছেন- তার চাইতে অনেক ভালো সেই গরিব- যে খায় ভিক্ষা মেগে। ভাগ্য দোষে এই হানাহানিতে সুজার ঘটল বিষম বিপর্যয়।
    লড়াইতে হাটিয়া সুজা হইল পেরোশানি
    পরিবারে লৈয়া সঙ্গে করিল মেলানি।
    ধন-দৌলত কিছু কিছু নিলা সঙ্গে করিরে।
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
    পলাতক সুজা তাঁর পরিবার-পরিজনসহ চট্টগ্রামে শাহ বদরের দরগায় এসে উপনীত হলেন। 
    সুজা বাদশার আওরত পরীবানু নাম,
    চাটিগাঁতে আসি তারা বদরের মোকাম
    বহুত খয়রাত দিলা সোনা ভরী ভরী রে।
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
    কিন্তু সেখানে এসেও সুজা অন্তরে স্বস্তি পেলেন না। তিনি স্পষ্ট ঠাহর করলেন তাঁর ‘পদে পদে শত্রু’- তাঁর পেছনে লেগেছে গুপ্তচর। অগত্যা তিনি চট্টগ্রাম ত্যাগের সিদ্ধান্ত করলেন-
    নসীবের লেখা কভু না যায় খ-ন
    চাডিগা ছাড়িতে বাদশা করিলা মনন,
    দখিন মুখ্যা আইল তারা হাতির উপর চড়িরে
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
    মধ্যে বইস্যে সুজা বাদশা বামে পরিজান,
    ডাইনে বইস্যে দোন কন্যা পূন্ন মাসির চান,
    ধীরে ধীরে যায় তারা মুড়ার পন্থ ধরি রে।
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
পার্বত্য পথ ধরে তাঁরা চললেন দক্ষিণ দিকে। হাতির উপর সোনার হাওদা। তাতে উপবিষ্ট বেহেস্তের হুরীর ন্যায় রুপসী পরীবানু। তাঁর রুপের চমক দেখে পল্লী রমণীদের চোখে লাগলো ধাঁ ধা। কেউ দেখালো পথ, কেউ দক্ষিণে যেতে করলো মানা। সবাই অনুনয় করে বলল- “থাকো তোমরা আমাদের দেশে, রাখবো তোমাদের সবাইকে মাথায় করে, খেতে দেবো বাটা ভরা ‘সাচি’ পান। ভুলে আরও দক্ষিণে যেয়ো না, সেখানে গেলে হিং¯্র বাঘের কবলে পড়বে মারা। তা’ছাড়াও দক্ষিণে আছে দরিয়া তাতে রয়েছে অনেক কুমির ও হাঙ্গর। কে তোমাদের সেই ভয়াল খর¯্রােতা নদী পার করে দেবে? তা’ ছাড়াও নদী তীরে জঙ্গল সেখানে রয়েছে বিস্তর সাপের বাসা। সেই কাল সাপের দংশনে হবে তোমাদের নিশ্চিত মরণ তাই যেয়োনা তোমরা রোসাঙ্গ দেশে”-
    না যাইও না যাইও পরী রোসাঙ্গের দেশে,
    ধন, দৌলত হারাইয়া জান দিবা শেষে,
    সেই মুখ্যা না যাইও পরী মুড়ার পন্থ ধরি রে।
    হায়!হায়!দুক্ষে মরি রে॥
    না যাইও না যাই ও পরী মুরঙ্গ্যার ঠাঁই
    মানুষের গোস্ত খায় তা’রা হিজাই হিজাই।
    এক পাও যাইতে আর আমি মানা করি রে।
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
    দক্ষিণ মুখ্যা না যাইও সাগরের পারেড়,
    আমার কথা মনে রাইখ, কহি বারে বারে,
    হামার্দ্যারা লৈয়া যাইব গলাত বাঁধি দড়িরে।
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
    কিন্তু সুজা কোনো কথা কানে তুললেন না, মানলেন না কারো মানা, অদৃষ্টের হাতের ক্রীড়নক, অজানার টানে চললেন দুর্গম মুড়ার পন্থধরে- দক্ষিণ মুখে। 
    তেরো দিন তেরো রাত ভ্রমণ করিয়া।
    সামনে পাইল সুজা বেমান দরিয়া॥
সম্মুখে উত্তাল তরঙ্গ-সংকুল নাফ নদী। অপর পারে আরাকান রাজ্য-চলতি নাম ‘রোসাঙ্গ’। কিন্তু ভরা বরষায় নদী পার হওয়ার কোন উপায় নাই। তাঁরা সবাই তিন দিন নদী তীরে অপেক্ষা করলেন। চতুর্থ দিনে রোসাঙ্গ এক অধিবাসী সুজার অসহায়ের সব কথা শুনে তাঁকে সহায়তা করতে এগিয়ে এলো। তারই সাহায্যে সুজা রোসাঙ্গ শহরে এসে হাজির হলো। সুজার আগমন সংবাদে আরকান রাজ বিচলিত হয়ে উঠলেন। 
    “বারো-বাঙলার, বাদশাহ সুজা আইল আমার ঠাই,
    তার সঙ্গে হইব এখন বিষম লড়াই
    চটকরি সাজি লও রোসাঙ্গ নগরী রে। 
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
    পরেতে জাানিল রাজা সুজা বাদশার হাল-
    দেশ ছাড়ি রাজ্য ছাড়ি পথের কাঙাল,
    নসীবের দোষে তান ভাই হৈছৈ বৈরী রে।
    হায়! হায়! দুক্ষে মরি রে॥
তারপরের কাহিনী বাস্তাবিকই হৃদয় বিদারক। পরবর্তী কালে আরকান রাজ ইন্দ্রিয় লাল সায় হয়ে ওঠেন পশুর ন্যায় বর্বর।
    একদিন পরীবানু দো-মহলার ঘরে।
    খসমের কাছে বসি রং-তামাসা করে॥
সে সময় মহলের পাশ দিয়ে আরাকান-রাজ হাতীতে চড়ে বায়ু-সেবণে যাচ্ছিলেন, তিনি অকস্মাৎ লক্ষ করে দেখলেন-
    সুন্দরী পরীর তখন দোলে নাকের নথ।
    মন-ময়ুরা দিল ওড়া দেখিয়া সুরত॥ 
পরীবানুর অপূর্ব রূপ-লাবণ্য নিরীক্ষণ করে রাজা উম্মাদ প্রায় হয়ে ওঠলেন। তিনি কুৎসিৎ লালসার বিষ দাহে বিহ্বল হয়ে “বান্থা পূর্ণ” করবার উপায় ভাবতে লাগলেন। রাজার দুরাকাঙ্খার কথা সুজাও পরীবানু শুনে তাঁদের চোখ পানিতে ভিজে উভয়ে মন্ত্রণা করলেন- রাজার দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করতেই হবে। রাত্রি প্রভাত না হতেই তাঁরা সত্বর প্রাসাদ ত্যাগ করে সমুদ্র তীরে উপনীত হলেন। পূর্ণ চন্দ্র তুল্য দুই কন্যার ভবিতব্যের কথা স্মরণে আসতেই তাঁদের নয়নে ঝরলো তপ্ত অশ্রু।
সমুদ্র-তীরে এক রোসাঙ্গী একখানি ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরছিল। সুজা তার কাছে নৌকা খানি চাইলেন। রোসাঙ্গীকে পরী বানু দিলেন তাঁর ‘সোনার হার’। তিনি ওঠলেন নৌকায়। সুজা মাঝি হয়ে নৌকা বাইতেই হু হু করে এসে পড়লো প্রথম জোয়ারের পানি। ঢেউয়ের গর্জন যেনো তাঁদের প্রতি আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। পরীবানু স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন পতির মুখের পানে। সুজা মাঝ-দরিয়ায় তরী বেয়ে চলেছেন কোন নিরুদ্দেশ যাত্রায়। রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। তাঁরা মনে মনে ফজরের নামাজ পড়ে নিলেন। অতঃপর-
সুজা বলে, শুন পরী, শেষ দেখা আজ। আকাশে উদিত হলো রাঙাসূর্য, পরী বানুর মুখ পানে চেয়ে সুজা পানিতে দিলেন এক লম্ফ। সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুদ্র তরী গেল উত্তাল তরঙ্গ তলে অদৃশ্য হয়ে। অনেক কষ্টে পরীবানু দুই কন্যাসহ পানি থেকে জীবিত উঠতে সমর্থ হলেন।
    
    ডুপিল ডুপিল নৌকা, সুজার জান
    দরিয়ার মাঝে হায় দিল রে পরাণ।
    সুজার পতœীর সঙ্গে রোসাঙ্গে আসেন তাঁর দুই কন্যা। মগরাজা বন্ধুতের ছল করে সুজার এক কন্যাকে তার অন্তপুরে নিমন্ত্রণ করে নাইয়র নিয়ে বলপূর্বক আটক করেন এবং সুজার অপরিমেয় হীরা-জহরত ও ধন-ভান্ডার লুণ্ঠন করেন। সুজা সাগরে সলিল সমাধি প্রাপ্ত হন এবং সুজার এক কন্যা সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়ে নিহত হন। বন্দিনী সুজার প্রিয়তমা পতœী পরীবানু নিষ্ঠার নিয়তিকে দারুণ ধিককার দিয়ে হৃদয় বিদারক ও মর্ম বিদারী কণ্ঠে করেছে সকরুণ বিলাপ। এই গীতিটির একটানা বিলাপ অত্যন্ত করুন, মর্মস্পর্শী ও হৃদয় বিদারক। 
সুজার পতœী পরীবানুর রূপ ও গুণ গাঁথা এক সময় পূর্ব বঙ্গের পল্লীতে পল্লীতে গীত হতো। সেই সকল গ্রাম্য গীতি এখন বিস্মৃতি সাগরে বিলীন হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শাহ সুজার পতœী পরীবানু সন্মন্ধে চট্টগ্রাম শহরে অনেক পালাগান এখনো বিদ্যমান আছে। পালা দুটির নাম হলো- সুজা তনয়ার বিলাপ ও পরীবানুর হাইলা। 
শাহপরী দ্বীপ চট্টগ্রামের দক্ষিণে প্রায় দেড়শত মাইল দূরে অবস্থিত আরকান সুধর্ম নরপতির রাজধানী ছিল মেয়ং। সেখানে এখনো সুজার মসজিদ এবং সুজার দিঘি আছে। আমরা এই আরাকান রাজার কথা পাই ‘সুজা তনয়ার বিলাপ’ পালাতে। যাকে বলা হয়েছে মগ রাজা।

×