ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বীকৃতি 

সন্তোষ কুমার শীল

প্রকাশিত: ০১:২৪, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩

স্বীকৃতি 

সেলাই মেশিনের সুঁচের মাথায় সুতাটা গলাতে বার বার ব্যর্থ হয়ে নিজের ওপর বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠেছিল বিভারাণীর

সেলাই মেশিনের সুঁচের মাথায় সুতাটা গলাতে বার বার ব্যর্থ হয়ে নিজের ওপর বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠেছিল বিভারাণীর। এমন সময় একরাশ কালো ধোঁয়া আর ধুলোবালি উড়িয়ে বিশাল ট্রাকটা হাত-পাঁচেক দূর থেকে মহাসড়কের ওপর দিয়ে হুশ্ করে চলে যায়। বিভারাণীর ছানি পড়া নাকের ওপর ঝুলে থাকা মান্ধাতা আমলের অকার্যকর চশমার লেন্স দুটো আরও ঝাপ্সা হয়ে ওঠে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘লায়ন্স ক্লাব’-এর উদ্যোগে বিনামূল্যে চক্ষু অপারেশন শিবিরে ডানচোখ অপারেশনের পর এই চশমাটা তারা দিয়েছিল। তার হাত দুটো ভেঙে গেছে আরও এক যুগ আগে।

তার পরিবর্তে এসেছে মোটা দড়ি। কখনো নাকে, অবসরে গলায় তেল চিটচিটে ময়লা দড়িটার মাথায় চশমাটা ঝুলে থাকে, বিভারাণীর অবাঞ্ছিত জীবনের মতই। শ্রান্তি-ক্লান্তিতে বিমর্ষ বিভারাণী মনে মনে কষে কয়েকটা গালাগাল দেয় ট্রাকটাকে। তার ফলে মুহূর্তের জন্য পরিশ্রমের ক্লান্তিটা ভুলতে পারে। এটা গালাগালের অব্যর্থ ফল।  
মাথার ঠিক ছয় ইঞ্চি উপরে ঝুলে থাকা ইলেক্ট্রিক পাখার রেগুলেটর ঘুরাতে গিয়ে তার মনে পড়ে- সন্ধ্যার মধ্যে কমপক্ষে পঞ্চাশটা নাইট গাউন যে করেই হোক সেলাই শেষ  করতে হবে। যথাসময়ে সাপ্লাই দিতে না পারলে মালিকের অনর্গল খিস্তি-খেউড়ে কান বধির হয়ে যাবে। শাড়ির জীর্ণ আঁচলটায় চশমার কাঁচ দুটো মুছে আবার সূতাটা হাতে নেয়। কিন্তু আগের মতোই ব্যর্থ হয়ে সেলাই মেশিনটার দিকে অর্থহীন চোখে চেয়ে থাকে। কী হলো আজ! ক্ষুধার জ্বালায় দৃষ্টিশক্তি কি আজ একেবারেই লোপ পেয়েছে! দুপুর হতে চলল, সকাল থেকে জল ছাড়া কিছুই পেটে পড়েনি আজ।

ঘরে যা খাবার ছিল প্রতিবন্ধী একমাত্র ছেলেটা সব নিঃশেষে সাবাড় করেছে। ওই অভিশাপটাকে বুকে আঁকড়ে ধরেই বিভারাণীর জীবন কাটে। মাঝে মাঝে রাগে-ক্ষোভে আত্মজের মৃত্যু কামনা করে, কদর্য গালাগাল দেয়। কিন্তু কোনো ভাবান্তর হয় না তার। জড় পদার্থের মত একটা প্রাণী। অথচ তার পশুর মতো ক্ষুধা যা পূরণের সাধ্য বিভারাণীর নেই। পরক্ষণেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদে। হাজার হোক পেটে ধরেছে তো! ভাইয়ের সংসারে সহ¯্র লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্যে ছেলেটাই একমাত্র সান্ত¡না। তাকে নিয়ে যে মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু পেয়েছে এটাই বা কম কথা কী! বিভার কোটরাগত ছানিপড়া চোখ দুটো ভিজে ওঠে।
এমন সময় মহাসড়কের ওপারে বসা পানের দোকানি ইসমাইল হোসেন অপরিচিত এক যুবককে নিয়ে এসে বলে- মাসী, এই ভদ্রলোক তোমার নাম জিজ্ঞেস করছিল।
যুবকের দিকে ঝাপসা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিভারাণী অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে। আবছা মুখখানা আরেকটা মুখের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় আর বিভার অভুক্ত, দুর্বল শরীরটা তিরতিরিয়ে কাঁপতে থাকে। ধাতস্থ হলে জিজ্ঞেস করে- তুমি আমার খোঁজ করছিলে? 
-আপনি কি বিভারানি ম-ল?
-হ্যাঁ, তুমি জানলে কিভাবে?
যুবকটি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে- আমি তোমার আর এক ছেলে। ঘরে চল, সব বলছি।
বিভারাণী দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। কি করবে সে ভেবে পায়না। কে এই অপরিচিত যুবক, তাকে মা বলে সম্বোধন করছে! বাড়িতে নিয়ে তাকে বসাবেই বা কোথায়? তাদের বাড়িতে কখনো কোনো ভদ্রলোক তো দূরের কথা, প্রতিবেশীরাও দায় না ঠেকলে যায় না। তাছাড়া ঘরে এমন কিচ্ছু নেই যা দিয়ে ক্ষুধা ঠেকানো যায়। একমাত্র ভরসা, সন্ধ্যাবেলা মালিকের দেওয়া একশ’ টাকা। এখন যদি ঘরে ফেরে তবে টাকা দেওয়া তো দূরের কথা কাল থেকে তাকে আর কাজে নেবে কিনা সন্দেহ! তাহলে নির্ঘাত না খেয়ে মরতে হবে।

এই বয়সে ছানি পড়া চোখ নিয়ে আর কী-ই বা সে করতে পারবে! অপরিচিত যুবককে ঘরে নেবার আরেকটা সমস্যা হলো তার প্রতিবন্ধী ছেলেটা। তাকে দেখে কী ভাববে! বিভা এড়িয়ে যেতে বলে- এখানেই বোসো না! হাতের কাজটা শেষ করি!
মানবেন্দ্র মুহূর্তেই সবকিছু অনুমান করে নেয়। ‘তুমি কাজ শেষ করো, আমি আধ ঘণ্টা পরে আসছি’- বলে সে  বেড়িয়ে যায়।
কাজে বিভারাণীর আর মন বসে না। অচেনা যুবকের মুখখানা তার বুকের মধ্যে বড্ড তোলপাড় করে। যে মুখখানার সঙ্গে তার দীর্ঘ একটা জীবনের অপমান, লাঞ্ছনা, অস্বীকৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। যে কথাটা একটা দগ্দগে ঘা হয়ে সারাটা জীবন তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। সহায়-সম্বলহীন, অমানবিক একটা জীবন সে অসহায় যন্ত্রণায় কাটিয়েছে। হাজার মানুষের কৌতূহলী, ঘৃণা-মিশ্রিত দৃষ্টির তীর তাকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আজ ভাবতেও সে শিউরে ওঠে- এ কেমন অভিশপ্ত জীবন সে পাড়ি দিয়ে এলো!
তখন সে নবম শ্রেণির ছাত্রী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই স্কুল বন্ধ। ভোর রাতে দুটো সেদ্ধ ভাত ফুটিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে সবাই বেড়িয়ে পড়ত পালিয়ে বাঁচার জন্য। তখন সবেমাত্র পদ্মার শাখা নদী আড়িয়ালখাঁর বিস্তীর্ণ দুই তীরে আখগুলো বড় হয়ে উঠেছে। যতদূর চোখ যায় শুধু আখ আর আখ। ওই আখ ক্ষেতের মধ্যেই বিভাদের গাঁয়ের সহস্রাধিক মানুষ যারা দেশ ছেড়ে যাবে না বলে ঠিক করছিল তারা প্রতিদিন পালাতে যেত। রাজাকাররা কিভাবে যেন সে খবর পেয়ে যায়। আর গ্রীষ্মের এক দুপুরে হানাদার বাহিনী নিয়ে আড়িয়ালখাঁর বুকে গানবোট এসে থামে। ভয়ে-ত্রাসে-উৎকণ্ঠায় সকলে বিবর্ণ, শঙ্কিত হয়ে আখক্ষেত ছেড়ে বের হয়ে আড়িয়ালখাঁর দিকে ছুটতে শুরু করে।

সেটাই বিভাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। অধিকাংশ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে ওপারে উঠে ছুটতে থাকে। কেউ একজন বলেÑ ‘চল কালকিনি যাই। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আছে। নিরাপত্তা পাওয়া যাবে।’ পরিবারের কে কোথায় আছে সে ভাবনার অবকাশ নেই। প্রাণ বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে সবাই চোখ যেদিক যায় ছুটতে থাকে।
বিভার পরিবারে মহিলারা নদী থেকে অনেকটা ভিতরে লুকিয়েছিল। রাজাকাররা সহজে তাদের খোঁজ পেত না। কিন্তু ক্ষুধায় একটা শিশু চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর সেই কান্নাই কতগুলো নারীর জীবনে অভিশাপ ডেকে আনে। দশ-বারোজন নারীর মধ্যে বিভা আর তার এক সহপাঠী রাবেয়া এই দুজন ছিল কিশোরী। তাই চূড়ান্ত আক্রমণটা আসে তাদের উপরই। দুজনেই আতঙ্কে, নির্যাতনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। সন্ধ্যার দিকে পুরুষরা ফিরে এসে মশাল জ্বালিয়ে খোঁজ করতে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, মৃতপ্রায় দুটো নগ্ন দেহ পাশাপাশি পায়।

তাদের নিয়ে বাড়িতে এসে দেখে টরকীর ছোট বন্দরটিতে একটা ঘরও অক্ষত নেই। সবই ভস্মীভূত হয়ে গেছে। ছাইয়ে, ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে বন্দরটা। আর সব হারানো ব্যবসায়ীদের আহাজারীতে ভারি হয়ে উঠেছে রাতের আঁধার। নিজের দুঃখ-কষ্ট পাথর চাপা দিয়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার মহিলাদের নিয়ে গ্রাম্য ডাক্তার মহানন্দ সুতারের বাড়িতে ছোটে সবাই। বিভার জ্ঞান ফিরলে তার বাবা বুকে পাথর বেঁধে পালরদী নদীতে আরেকটা পরিবার মিলে ভারতের উদ্দেশ্যে নৌকা ভাসায়।
অবর্ণনীয় পরিশ্রম আর মাতভূমি ত্যাগের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দশ দিন পর তারা ভারতে পৌঁছায়। বিভারাণী তখন বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু নুন আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছে- একা যখনই থাকে অথবা ঘুমের ঘোরে সে আর্ত চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে ফেলে। তারপর অর্থহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। আশ্রয় শিবিরের মানুষ সহানুভূতির সাথেই বিভার পরিবারকে সঙ্গ দেয়, সান্ত¡না দেয়। কেউ কেউ পরামর্শ দেয়- মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিন। দেখবেন সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। একদিন পালরদী বন্দরের পাশেই গৌরনদী থেকে এক যুবক তাকে দেখতে আসে। দেশে তার ছোটখাটো ব্যবসা আছে। পাশের আশ্রয় শিবিরে তাদের পরিবার থাকে।
বৃষ্টিকাল শেষ হয়ে আকাশে-বাতাসে শরতের আভাস। এক এক খ- সাদা মেঘ ভেসে আসে বিভার মনে স্বপ্ন-শিহরণ তুলে। সে তন্ময় হয়ে ভাবতে বসে নতুন জীবনের কথা। আশ্রয় শিবিরে জোর গুঞ্জন উঠেছে- মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। পাক হানাদার বাহিনী যৌথ বাহিনীর আক্রমণে কোণঠাসা, বিধ্বস্ত, দিশেহারা। দেশ স্বাধীন হলো বলে। আবার সবাই মাতৃভূমিতে ফিরে যাবে, সেখানে সুখে শান্তিতে দিন কাটাবে। এমনি আশা- আশঙ্কা, স্বপ্ন-উচ্ছ্বাসের মধ্যে শারদোৎসবের কয়েকদিন পরে অনুকূল মাঝির সঙ্গে বিভারাণীর বিয়ে হয়ে যায়। আশ্রয় শিবিরে দুঃখ-কষ্টে দিন যাপন করা শরণার্থীরা সব ভুলে দুই দিনের জন্য আনন্দে মেতে ওঠে।
কিছুদিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হয়। অনুকূলের হাত ধরে বিভা মুক্ত, স্বাধীন দেশে ফিরে আসে। নুন করে বাঁচার শপথ নেয়। কয়েকটা মাস তাদের সুখের নৌকায় পাল তুলে কেটে যায়। কিন্তু সে সুখের ভার বিভারাণীর কপালে সয় না। অনুকূল একদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসে বিভাকে আচমকা জিজ্ঞেস করে- তোমরা আমাকে এমনি করে সবাই মিলে ঠকালে কেন? বিভার বুকখানা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে- কী বলছ তুমি? তোমাকে ঠকাব কেন? 
-তোমাদের গাঁয়ের সবাই বলে, পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে তোমাকে ওরা সবাই মিলে ভোগ করেছে। আমাকে এ পর্যন্ত তুমি বলোনি তো ? এটা ঠকানো নয়তো কি? 
-দেখ আমার অসহায়ত্বের সুযোগে যদি কেউ আমায় নির্যাতন করে আমি কি করতে পারি? দেশে এমনি লাখ লাখ মা-বোন রয়েছে যারা সম্মান-সম্ভ্রম হারাতে বাধ্য হয়েছে। তাদের কি দোষ বল? আর আমাকে তো ওরা ক্যাম্পে নেয়নি! তুমি শান্ত হও। সব তোমাকে বলব।
কিন্তু অনুকূলের মনের শান্তি চলে গেছে। সে আর শান্ত হতে পারে না। বিভার ওপর, সংসারের ওপর, ভাগ্যের ওপর বিরক্ত হয়ে বিভাকে কিছু না বলে একদিন সে পালিয়ে ভারতে যায়। আর কিছুদিনের মধ্যেই বিভারাণী বুঝতে পারে অনুকূল তার শরীর ক্ষেত্রে জীবনের বীজ বুনে দিয়ে গেছে। সে আশা-নিরাশার দোলাচলে স্বামীর আগমনের পথ চেয়ে দিন-মাস-বছর গুনতে থাকে। তার মধ্যে একটা পুত্র সন্তান আসে কোল জুড়ে। স্বামী যাবার পর থেকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা তার নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠে। নবাগত সন্তান বুকে চেপে ধরে একটু স্বস্তি মেলে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির আশ্রয়টুকু তার চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। মানুষের জীবনে এমনি করে দুর্দৈব আসে তা বিভার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।

স্বামীর আসার পথ চেয়ে যখন সে ব্যর্থ হয় তখন এও তার মনে জাগে- অন্য দশজন শিশুর মতো তার শিশুপুত্রটি স্বাভাবিক নয়। সে ডাকলে শুনতে পায় না, চোখে চোখ রেখে হাসে না অথবা কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এমনকি শরীরের বৃদ্ধিও অস্বাভাবিক। প্রচ- দুঃখ-শোকে সে একখ- জড় পাথরের মতো দিন কাটাতে থাকে। কিন্তু সে পাথরের চোখে জল আর পেটের ক্ষুধাই তার একমাত্র সম্বল। তাই নিরুপায় হয়ে একদিন কাজের  খোঁজে টরকী বন্দরে বের হয়।
জীবনের এমনই বিড়ম্বনা, তাকে কেউ কাজ দিয়ে অসম্মানিত হতে চায় না। ছোট-বড় সবাই তাকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বুঝিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভ্রম হারানো, স্বামীর সংসার ত্যাগ সবকিছুর জন্য সে-ই দায়ী। এজন্য সবার কাছে হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। তাকে নিয়ে ভদ্রলোকেরা রসালো মন্তব্য করে। সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে রাষ্ট্র অথবা সহৃদয় কেউ এগিয়ে আসে না। দুঃখ-কষ্ট-হতাশা, স্বামী-শোক, সন্তানের অস্বাভাবিকতা তার জীবনের স্বাদ পান্সে করে দেয়। জ্বালা জুড়াতে তাই একদিন আড়িয়ালখাঁর বুকে ঝাঁপ দেয়। তবে সফল হতে পারে না।

এক বৃদ্ধ জেলে তাকে উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলে। তারপর এক একটা দিন কী নির্মম অবস্থার মধ্য দিয়ে পার করেছে তা বিভারাণী ছাড়া আর কেউ জানে না। এই দীর্ঘ জীবনে দুঃখ-যন্ত্রণার প্রচ- ঢেউ এসে বারে বারে আঘাত করেছে। কিন্তু মানবিকতার হাত বাড়িয়ে পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়নি। বীরাঙ্গনা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটুকুও মেলেনি। কয়েকবার সংবাদকর্মীরা এসেছে। তার ভয়াবহ দিনটি সম্পর্কে নানা কথা জিজ্ঞেস করেছে। দূরদর্শন চ্যানেলের সম্প্রচার বেড়েছে। কিন্তু বিভারাণী অপমানের যে তিমিরে ছিল সেখানে একবিন্দু আলোও জ্বলেনি। আজ তবে কে এলো তার খোঁজে! আর মুখখানাই বা প্রথম যৌবনে দেখা অনুকূলের মতো লাগছে কেন! বিভারাণী সেলাই মেশিনটার পাশে বসে রাজ্যের এলোমেলো প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। 
হঠাৎ একটা গাড়ি এসে তার টং ঘরের সামনে থামে। বিভারাণীকে চমকে দিয়ে সেই যুবক গাড়ি থেকে নেমে বলে- তুমি এখনো সেলাই মেশিন নিয়ে পড়ে আছো! আমার যে ক্ষুধা লেগেছে! খাওয়া-দাওয়া হবে কখন?
প্রশ্নটা বিভারাণীর বুভূক্ষু অন্তরে তরঙ্গ তুলে আছড়ে পড়ে। তার প্রতিবন্ধী সন্তানটি জীবনে এমন দাবি করতে পারেনি কোনোদিন, এমনই ভাগ্যবিড়ম্বিতা সে! মুখ ফস্কে বেড়িয়ে যায়- ঘরে চল্। আমারও তো ক্ষুধা লেগেছে, বলে নিজেই লজ্জায় জড়সড় হয়ে যায়। আর মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে মানবেন্দ্র। তারপর গাড়িতে তুলে নিজের পাশে বসায়।
বন্দরের লোকজন অবাক বিস্ময়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে- বুড়ির আবার কোন্ আত্মীয় এলো এমন ঝক্ঝকে গাড়ি চড়ে! কোথাও কেউ আছে বলে তো শুনিনি কোনোদিন!
মাকে দেখে আজ আর প্রতিবন্ধী ছেলেটা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্ট করে না। মায়ের সঙ্গে অপরিচিত লোক দেখে বিস্ময়ে চুপ্সে যায় সে। অন্য দিনের বিরক্তি, ক্লান্তির পরিবর্তে আজ বিভারাণীই হাসিমুখে এগিয়ে এসে মানবেন্দ্রর আনা বিচিত্রসব খাবার তার মুখে তুলে দেয়। মানবেন্দ্র বাবার কথা ভাবতে থাকে- মৃত্যুর আগে বাবা তো তাকে কোনদিন বলেনি যে এদেশে তার আর একজন ভাই আছে! তবে কি তিনি এর জন্মের কথা জানতেন না!
ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব রং মিলিয়ে গিয়ে গোধূলি নামে। দিনের আলোয় অনেক কথা আছে যা মুখে উচ্চারণ করতে সঙ্কোচ হয়। কিন্তু অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে তা সহজে বলা যায়। ভাঙ্গা কুুটিরের দাওয়ায় বসে বিভারাণী নির্ণিমেষে চেয়ে থাকে মানবেন্দ্রের মুখের দিকে আর সারা জীবনের তৃষ্ণার্ত বক্ষে যেন অধরা স্বপ্ন সুধা ছড়িয়ে দেয়। বিভা অবাক হয়ে দেখে সান্ধ্য আকাশে মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে আর তার আলোর স্রোত গড়িয়ে পড়েছে তার গায়ে, জীর্ণ ঘরখানিতে, উঠোনে। সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে একদিন আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়াতে যাওয়া জীবনটাকে পুনর্বার দেখে। মানবেন্দ্র ধীরে ধীরে বলে চলেছেÑ
আরেকটা বিয়ে করেছিল জানতে পেরে মা বাবাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি তখন খুব ছোট। বাবাকে দেখতাম সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকত। মাঝে মাঝে কাঁদত। সমস্যা হলো আমাকে নিয়ে। আমাকে ঘরে একলা রেখে বাবা কোথাও যেতে পারত না। মামারা তখন এগিয়ে এসে আমাকে রামকৃষ্ণ মিশনের আবাসিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। এতে বাবা আরো নিঃসঙ্গ হয়ে যান। স্কুলের নিয়ম ভেঙে তিনি প্রায়ই আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন। আমাদের দারোয়ান লোকটা খুব ভালো ছিল।

বাবার অবস্থাটা বুঝতে পেরে সে গোপনে আমার সঙ্গে বাবার দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে দেয়। এমনি করে একদিন স্কুল-কলেজ শেষ করে একটা সরকারি চাকরি জুটে যায়। বাবা ততদিনে অনিয়ম, অনিদ্রায় রোগশয্যায় পড়ে গেছে। এক ছুটির দিনে আমাকে পাশে বসিয়ে বলেন- তুই এখন বড় হয়েছিস। তোর কাছে আমার পাপের কথাগুলো বলে অন্ততঃ একটু প্রায়শ্চিত্ত করে নিই।
সেদিন আমি প্রথমবারের মতো তোমার কথা জানতে পারি। বাবার যন্ত্রণা আমাকেও স্পর্শ করেছিল আর মৃত্যুর আগে বাবা বলেছিল যেন তোমাকে খুঁজে পেলে আমার কাছে নিয়ে যাই। তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করার সুযোগ দেবে আমায় মা?
বিভারাণী নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না। বুকের মধ্যে একটা কষ্ট দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে একটা শান্তিও জেগে ওঠে মনে- তার স্বামী অপরাধবোধে ভুগে ভুগে তাকে মেনে নিয়েছিল তাহলে? আর যে এই সুদর্শন যুবক তাকে মা বলে সম্বোধন করছে এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কি চাই জীবনে? রাষ্ট্র, সমাজ, স্বজনরা তাকে বীরাঙ্গনা বলে স্বীকার না করুক তাতে কি আসে যায়? এই সন্তান তাকে মা বলে তো মেনে নিয়েছে! নইলে ভিনদেশ থেকে তাকে এত বছর পর কেন খুঁজতে আসবে! একটা বোবা কান্না প্রবল বেগে উঠে তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়। বুকটা হাহাকার করে- আজ যদি অনুকূল বেঁচে থাকত, একবার সামনে এসে দাঁড়াত!
বিভারাণীকে চুপ থাকতে দেখে মানবেন্দ্র আবার জিজ্ঞেস করে- তুমি আমার সঙ্গে যাবে মা? বড় নিঃসঙ্গ থাকি। তুমি দাদাকে নিয়ে গেলে আবার আমার ঘর সুখে ভরে উঠবে! আমি সব ব্যবস্থা করে নেব।
বিভা শীর্ণ, কম্পিত হাতে মানবেন্দ্রর হাত দুটো ধরে কপালে ¯েœহ-চুম্বন করে বলে- তুই আমায় মা বলে স্বীকার করেছিস। তোর আহ্বান আমি অস্বীকার করি কী করে! সূর্যের মতো আমার জীবনে উদিত হয়েছিস বলে আজ আর আমার কোনো অসম্মান, লাঞ্ছনা নেই। কিন্তু এই জন্মভূমির জন্য জীবনের সব সুখ-আহ্লাদ খুইয়েছি। একে ছেড়ে যাই কি করে বল? তুই বরং মাঝে মাঝে মাকে দেখতে আসবি। যে দেশের জন্য সম্মান, সম্ভ্রম সব বিসর্জন দিয়েছি তার বুকেই যেন আমার শেষ আশ্রয়টুকু হয়- আমার এই শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে দে বাবা! 
বিভারাণী চাঁদের আলোয় ডুবে যাওয়া কুটিরখানির উঠোনে এসে আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। দীর্ঘ জীবনটায় যে দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছে এক মুহূর্তে যেন সব ধুয়েমুছে গেছে। সে অনুকূলের সহধর্মিণী আর মানবেন্দ্রর মা হয়ে গেছে। এর চেয়ে আর কোনো স্বীকৃতি তার চাই? এইটুকুর জন্যই তো সে তীর্থের কাকের মতো বেঁচেছিল। এই মুহূর্তে মরে গেলেও তার আর কোনো চাওয়া নেই। মানবেন্দ্রর মা ডাক তার জীবনের সমস্ত অতৃপ্তি, অস্বস্তি, যন্ত্রণা থেকে নারী জীবনের সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে বসিয়েছে।
অসহ্য সুখের আবেশে তার দুর্বল হৃদপিন্ড ঢিপ্ ঢিপ্ করতে থাকে। একটা কান্নার প্লাবন তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়। মানবেন্দ্রর মুখের দিক সে ব্যাকুল চোখে যেন অনন্তকাল চেয়ে থাকে।

×