ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শহরতলীর দোতলা বাড়িটি

রফিকুল নাজিম

প্রকাশিত: ০১:৩২, ২০ জানুয়ারি ২০২৩

শহরতলীর দোতলা বাড়িটি

শহরতলীর দোতলা বাড়িটি

-সড়কবাত্তির নিচে দাঁড়ানো পোলার কথা কইতাছেন ত, মামা? হেয় আমগো ফরহাদ। পাড়ার বেকতে তারে ‘প্রেমিক ফরহাদ’ নামেই চিনে। 
-সেই বিকেল থেকে দেখছি ছেলেটা গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দোতলা বাড়ির বারান্দার বরাবর দাঁড়িয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। কাহিনীটা কি, মামা?
শহরতলীর মোড়ের এক চায়ের দোকানদার আবুল মামা। তার দিকেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিলাম। রাত বাড়ছে। বাড়ছে দোকানে আড্ডাবাজ মানুষের ভিড়। চায়ের কাপে টুংটাং শব্দে চামচ নাড়ছেন আবুল মামা। আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
-সে এক বিরাট কাহিনী, মামা। আজকা বাদ দেন। আরেকদিন কমু নে।
- না, মামা। আপনি আজই বলেন। আমি শুনতে চাই।
- না, মামা। আজকা দোহানে অনেক কাস্টোমারের ভিড়। কাজকাম আছে। আরেকদিন কমু নে। সুময় নিয়া সব কতা কমু। আফনে কাগজে লিখতেন পারবেন।
আবুল মামার কথার ভেতর একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম। তাই আর জোরাজুরি না করে সেই রাতে চলে এলাম। সংবাদ সংগ্রহের জন্য আমাকে এখানে ওখানে ছুটতে হয়। ব্যস্ততার জন্য অনেকদিন ফরহাদের বিষয়টা আমার মনেই ছিল না।
ঠিক এক বছর পর। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের দিন। এই শহরতলীতেও জোড়ায় জোড়ায় জুটিরা ঘোরাঘুরি করছে। এই পুঁজিবাদতন্ত্র আমাদের প্রতিটা দিনকে একেকটা দিবসের মোড়কে বন্দি করে বাড়তি কামাই করছে। আমাদেরকে আফিম খাইয়ে মজা লুটছে। মানুষের আবেগ, অনুভূতিও আজ ব্যবসায়িক পণ্য বানিয়েছে তারা! আমার কাছে ভালোবাসা দিবসকেও সে রকমই মনে হয়। অনেকটা রগরগে টকটকে পণ্যের মতো। আমি মনে করি ভালোবাসা প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের। ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে আমি পাড়ার মোড়ের আবুল মামার চায়ের দোকানে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল ফরহাদের দিকে। সেই এক বছর আগের একই দৃশ্যের পুনঃপ্রচার বলে মনে হলো। ফরহাদের হাতে ফুল। একই রকম চাহনিতে তাকিয়ে আছে সেই দোতলা বাড়ির বারান্দার দিকে। তার তাকিয়ে থাকা দেখে মনে হচ্ছে কেউ একজন এখনই বারান্দায় আসবে। ফরহাদের তৃষিত প্রাণ তৃপ্ত করবে। কিন্তু যতদূর মনে পড়ে আমি এই বাড়ির বারান্দায় কখনো কাউকে দেখিনি। আজও না। তবুও ফরহাদ নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়েই আছে। তার হাতে একগুচ্ছ তাজা গোলাপ।
- আবুল মামা, কেমন আছেন? 
- কুনুরহম আছি আর কী। যেইভাবে চিনির দাম বাড়তাছে; কেমনে ভালা থাকমু- কন? বাজারের সব জিনিসপত্রের দাম হুহ্ হুহ্ কইরা বাড়তাছে। সংসার চালাইতে হিমশিম খাইতাছি, মামা।
কথাগুলো ঠিক আমার কান অবধি পৌঁছেনি। মাথার ওপর দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আমি এক মনে তাকিয়ে আছি ফরহাদের দিকে। অদ্ভুত মায়ার চেহারার ছেলেটা। লম্বা গড়নের সে। বয়স খুব বেশি হলে ২৭/২৮ হবে। কী সুঠাম শরীর! মাথায় এলোমেলো চুল। গায়ে ছাইরঙের জ্যাকেট। পরণে জিন্স। আবুল মামা এককাপ চা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন।
- কী অইলো, মামা। কত্তোক্ষণ ধইরা চা ধইরা খাড়াইয়া আছি। নেন- চা খান।
আবুল মামার কথায় আমার সম্বিৎ ফিরে আসে। মামার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করি। যতটা চেয়েছি ঠিক ততটা ঠোঁট প্রসারিত হয়নি। আমি বুঝলাম আজ আটকে গেছি।
- মামা, আপনি ত আমাকে ফরহাদ সম্পর্কে কিছু একটা বলবেন বলেছিলেন। আজ ত দোকানে ভিড় নাই। প্লিজ, আজ বলেন, মামা। আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। 
- কী অইবো শুইন্ন্যা। তয় ফরহাদ কিন্তু ইমুন আছিল না। তাগড়া একটা পোলা আছিল হেয়। বাদলা দিনে ঐ জলেশ্বরীর বুকে যিমুন জল ডাক দেয়। তেমনি ফরহাদের শরীরেও যৌবন ডাক দিছিল। প্রেমে পড়ছিল ফরহাদ। ঐ যে ফরহাদ যেই বাড়িডার দিকে তাকাইয়া আছে। ঐ বাড়িতে এক সুময় থাকতো মিয়ারা। তাও আট/দশ বছর আগের কতা। ঐ বাড়ির বড় মিয়ার একমাত্র মাইয়ার লগে ফরহাদের খুব ভাব আছিল। ‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে তারে ছাড়ে না’- ইমুন পিরিত। পোলা-মাইয়া একলগে কলেজো পড়ত। পোলাডার ব্রেন নাকি খুব ভালা আছিল। আমার এই টং দোহানের সামনে দিয়া তারা একলগে স্কুলে যাইতো। তারপরে কলেজো উডার পর তারা খুব একটা একলগে যাইতো না। আলাদা আলাদা যাইতো। তয় আমি ঠিকঐ বুঝতাম, তাগো মইধ্যে একটা কিছু আছে। চলে। রাইতবিরাতে ঐবাড়ির দেওয়ালের পাশের নারিকেল গাছ বাইয়া ছাদে উইঠ্যা দেহা করত ফরহাদ। সবই আমি দেখতাম। দেইখ্যা একলা হাসতাম।
একদিন কী অইলো জানেন, মামা? ইমুনদিনঐ। ভালাবাসা দিবস নাকি কি কয়? সেইদিন ফরহাদ নারিকেল গাছ বাইয়া মিয়াবাড়ির ছাদে উঠছে। তার পরনের প্যান্টের পেছনের পকেটে আছিল গোলাপফুল। বুঝলাম তারা ভাব ভালোবাসা করব। ঠিক তার আধাঘণ্টা পর; তখন রাইত কতো আর অইবো। দশটা/সাড়ে দশটা অইবো। মনে অইলো মিয়াবাড়ির ছাদ থেইক্যা কিছু একটা ধপাস কইরা নিচে পড়ছে। অনেকটা ভিজা মাটিতে ভাদ্দর মাসে তাল পড়ার শব্দের মতন। লগে লগে মিয়াবাড়ির ভিত্রেত্তে ‘চোর চোর’ আওয়াজ আইতে লাগলো। দৌড়াইয়া গিয়া দেহি দেওয়ালের পাশে ফরহাদ মাটিত্ পইড়া আছে। মাথা ফাইট্টা রক্ত পড়তাছে। টাটকা রক্ত। 
তারপর, তারপর কী হয়েছিল, মামা? জিগ্যেস করতেই আবুল মামা হুহু করে কাঁদতে লাগলেন। কিছুতেই তার কান্না থামছে না। ফরহাদের দিকে তাকিয়ে মামার কান্নার বেগ আরো বাড়ছে। তাকে কাঁদতে সুযোগ করে দিলাম। বাধা দিলাম না। কাঁদলে নাকি শোক দূরীভূত হয়। হয়তো আজকের এই কান্না আবুল মামাকে কিছুটা হলেও ভারমুক্ত করবে। কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে আবুল মামা আবার গল্প বলা শুরু করলেন।
‘জানেন, মামা- সেইদিন আমি পাপ করছিলাম। অনেক বড় পাপ। মেঝো মিয়া আমার হাত শক্ত কইরা ধইরা তাগো বাড়ির ভিত্রে নিয়া গেল। বড় মিয়ার সামনে যাওনের পর আমার হাত-পা কাঁপতাছিল। দুইনালা বন্দুকডা আমার বুকের বাম পাশে ধইরা কইলো, ‘আবুইল্যা, তুই কিছু দেখছোত?’ আমি চুপ কইরা রইলাম। কুনু কতা কইলাম না। বড় হুজুর আবার কইলেন, ‘আবুইল্যা, মাস্টরের পোলা ফরহাদে মিয়াবাড়িতে কেন আইছিল?’ আমি তহনো মাটির দিকে তাকাইয়া আছিলাম। কুনু কতা কই নাই। মাইঝ্যা মিয়া পাশ থেইক্যা কইলো, আবুইল্যা, গুড। এমন চুপচাপ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। কোথাও কোনো আওয়াজ যেন না হয়। হইলে তো কি হবে- বুঝতেই পারছো। ছুডু মিয়া আমারে টান দিয়া একটুখানি আড়ালে নিয়া আমার হাতে কিছু ট্যাকা দিয়া কইলো, লাগলে আরো পাবি। আমরা আছি না! এখন যা। আমি চুপচাপ আইয়া পড়লাম। কুনু কতা কইলাম না।
মিয়াবাড়ি থেইক্যা বাইর হইতেই দেখি চারদিক থেইক্যা মানুষ আইতাছে। কেউ ফরহাদ রে তুইল্যা হসপিটাল নেয়ার মত সাহস দেখায় নাই। মিয়াগো ভয়ে উপস্থিত বেকতে পোকায় খাওয়া বেগুনের মত কুঁকড়াইয়া গেছিল! ফরহাদরে চুরির অপবাদ দিলো। তারপরে পুলিশ আইলো। ফরহাদের নিথর শরীর গাড়িতে উঠাইয়া সাইরেন বাজাইতে বাজাইতে লইয়া গেল। পাড়ার বেকতে ভাবছিল ফরহাদ আর নাই। ‘রাখে আল্লা মারে কেডা’- ফরহাদ বাঁইচ্চা আছে। তয় আগের ফরহাদ নাই। তাগড়া ফরহাদ রোদে পোড়া পালংশাকের মত নেতাইয়া গেছেগা! ফরহাদের মাথাত্ এখনো কিছুডা গ-গোল আছে। প্রথম প্রথম ত তারে শিকল দিয়া বাইন্ধা রাখতে অইতো। ডাক্তার, কবিরাজ দেখাইতে দেখাইতে এহন মাথাডা কিছু ভালা অইছে। আর মিয়ারা এহন এমেরিকাত গিয়া আরামে জিন্দেগী কাটাইতাছে। আর ফরহাদ....
আমি আনমনে ফরহাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। আমাকে দেখে ফরহাদ ক্রমশঃ সরে যেতে থাকে। আমি ফরহাদের দিকে আরো এগিয়ে যাই। ফরহাদ আরো দ্রুত সরে যেতে থাকে। একসময় ফরহাদ দৌড়ে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যায়। একসময় আমি ঐ দোতলা বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ঝাপসা চোখে দেখি ফরহাদ নারিকেল গাছ বেয়ে মিয়াবাড়ির ছাদে উঠছে। তার প্যান্টের পেছনের পকেটে কয়েকটা তাজা গোলাপ। আমার চোখ আরো ঝাপসা হতে থাকে। আমি দেখি, কেউ ছাদ থেকে সেই গোলাপফুল ছুঁড়ে ফেলছে নিচে। তুঁত ফলের টসটসে রসের মত লাল লাল রঙ লেগে আছে মাটিতে। তারপর আরো ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে আমার চোখ ও মন। আমি আর এই গল্পের উপসংহার দেখতে পারিনা। কেবলই আমার চোখ থেকে জল পড়ছে।

×