ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

শিল্পী নাজনীন

প্রকাশিত: ২১:৩২, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

টেড হিউজ

এডওয়ার্ড জেমস টেড হিউজের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৭ আগস্ট, যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট রাইডিং অব ইয়র্কশায়ারের মিথমরয়েড এলাকার ১নং অ্যাস্পিনল স্ট্রিটে। পরবর্তীকালে টেড হিউজ নামে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করা এই কবি একই সঙ্গে কবি, নাট্যকার ও শিশুতোষ লেখক হিসেবে সমাদৃত হন। সমালোচকরা তাকে সময়ের সেরা কবি এবং বিংশ শতাব্দীর সেরা লেখক হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। হিউজের বাবা ছিলেন উইলিয়াম হেনরি এবং মা এডিথ হিউজ। বাবা হেনরি ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত একজন কাঠমিস্ত্রি এবং মা এডিথ ছিলেন উইলিয়াম ডি ফেরিয়ার্সের উত্তরসূরি। টেড হিউজের শৈশব কাটে কেলভার নদীর তীরে, কন্ডরভ্যালি ও পেনিন মুরল্যান্ডের দারুণ শান্ত এক গ্রামীণ পরিবেশে।

তার বাবা উইলিয়াম হেনরি ল্যাঙ্কাশায়ার ফ্যাসিলিয়ার্সে তালিকাভুক্ত ছিলেন এবং ওয়াইপ্রেসে যুদ্ধ করেছিলেন। বাবার যুদ্ধের বিরত্বগাথা টেড হিউজের শৈশব স্মৃতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল, যা পরবর্তীকালে তার ‘আউট’ নামক কবিতায় বর্ণিত হতে দেখা যায়। শৈশবে শিকার করা, মাছ ধরা, সাঁতার কাটা এবং পরিবারের সঙ্গে বনভোজন অত্যন্ত প্রিয় ছিল হিউজের। সাত বছর পর্যন্ত হিউজ বার্নলি রোড স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে তার পরিবার ম্যাক্সবোরায় চলে যান এবং সেখানকার শোফিল্ড জুনিয়র স্কুলে হিউজকে ভর্তি করান। 
ম্যাক্সবোরা স্কুলে পড়াকালেই হিউজের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সেখানকার বেশ কজন শিক্ষক হিউজকে লেখায় উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে শৈশবেই কবিতার প্রতি আগ্রহ জন্মায় হিউজের। বড়বোন অলউইনও কবিতার সমঝদার ছিলেন এবং হিউজের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিলেন তখন। এলিয়টের কবিতার সঙ্গে এভাবেই ছোট্ট হিউজের পরিচয় ঘটে যায়, যা পরবর্তী সময়ে তার ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। স্কুলে পড়াকালে, ১৯৪৬ সালে স্কুলের সাময়িকী ‘দ্য ডন’ ও ‘ডিয়ার্ন’-এ হিউজের কবিতা ‘ওয়াইল্ড ওয়েজ’ ও একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮ সালে এখানে আরও কিছু কবিতা প্রকাশিত হলে হিউজের কাব্য প্রতিভা সকলকে চমকিত করে।

একই বছরে ক্যামব্রিজের পেমব্রোক কলেজে তিনি উন্মুক্ত প্রদর্শনীর সুযোগ পান। উচ্চ বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি পূর্ব ইয়র্কশায়ারে আরএএফের গ্রাউন্ড ওয়ারলেস মেকানিক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু মাত্র দুই বছর পরেই তিনি এই কাজে ইস্তফা দিয়ে প্রায় অলস সময় কাটাতে থাকেন এবং পুরোপুরি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। শেক্সপিয়ার, ইয়েটসসহ অনেকের লেখা তিনি তখন বারবার পড়তে থাকেন এবং অনেক কবিতা মুখস্থ করতে থাকেন।
১৯৫১ সালে এম.জে.সি হগার্টের তত্ত্বাবধানে পেমব্রোক কলেজে হিউজ ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং হগার্ট তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেন। হিউজ সেই সময়ে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেননি কিংবা কবিতা লেখেননি। তৃতীয় বর্ষে পা দিয়ে বিষয় পরিবর্তন করে হিউজ নৃতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ে আসেন এবং তখন তিনি কবিতা লেখায় মনোযোগী হন। একই সময়ে হিউজ কল্পপুরাণের দিকেও প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েন। এ সময়ে তিনি ‘ড্যানিয়েল হিয়ারিং’ ছদ্মনামে গ্রান্টায় ‘দ্য লিটল বয়েজ এন্ড দ্য সিজন্স’ শিরোনামে কবিতা লেখেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে হিউজ লন্ডন ও ক্যামব্রিজে বসবাস শুরু করেন। এই সময়ে হিউজের বেছে নেওয়া বহুবিচিত্র সব পেশা তার অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করে, যা বিভিন্ন সময়ে তার লেখায় দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়।
১৯৫৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বন্ধুদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য আড্ডায় ক্যামব্রিজের ফুলব্রাইট বৃত্তিধারী মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে টেড হিউজের সাক্ষাৎ হয়। সিলভিয়া প্লাথ তখন তুমুল জনপ্রিয় ও অগণিত পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি। মূলত টেউ হিউজ ও তার সতীর্থ কবি লুকাস মেয়ার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেই সিলভিয়া এই আড্ডায় এসেছিলেন। এই আড্ডায়ই হিউজ ও সিলভিয়া তুমুলভাবে একে অন্যের প্রেমে পড়েন এবং অল্প কিছুদিন পরেই ১৯৫৬ সালের ১৬ জুন তারা বিয়ে করেন। 
বিয়ের পর এই দম্পতি ক্যামব্রিজে ফিরে এসে সংসার শুরু করেন। এই বছরে তাদের লেখা কবিতাগুলো ‘দ্য নেশন’, ‘পোয়েট্রি’ ও ‘আটলান্টিকে’ প্রকাশিত হয়। হিউজের লেখা ‘দ্য হাওক ইন দ্য রেইন’ নামের কবিতা সমগ্রের পা-ুলিপি সিলভিয়া সম্পাদনা করেন যেটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এক কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার অর্জন করে। এর ফলে হিউজ কবি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ১৯৫৭ সালে হিউজ সমারসেট মম পুরস্কার জয় করেন।
পরবর্তী সময়ে এই দম্পতি জীবিকার প্রয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান, সেখানে সিলভিয়া তার প্রাক্তন প্রতিষ্ঠান স্মিথ কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। হিউজও ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিছুদিন পরেই তারা আবার ইংল্যান্ডে ফিরে এসে হেপস্টনস্টলে কিছুদিন অবস্থানের পর প্রাইমরোজ হিলের একটি ছোট ফ্ল্যাটে ওঠেন এবং উভয়েই কবিতায় ডুব দেন। দুজনের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো এই সময়ে প্রকাশ হতে থাকে। এই সময়ে হিউজের লেখা কবিতাগুলো ‘উডো’ (১৯৬৭), এবং ‘রেকলিংস’ (১৯৬৬) নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয় বলে ধারণা করা হয়। ১৯৬০ সালের মার্চে প্রকাশিত হয় ‘ল্যাপারকাল’ যা হথর্নডেন পুরস্কারে ভূষিত হয়।
বিয়ের প্রথম বছরগুলোতে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক মধুর থাকলেও পরবর্তী সময়ে সেখানে তিক্ততার সূচনা হয় যার চূড়ান্ত পরিণতিতে সিলভিয়া আত্মহত্যা করে নিজ জীবনের করুণ সমাপ্তি টানেন। হিউজ ও প্লাথ দম্পতি দুটি সন্তানের জন্ম দেন। ১৯৬২ সালের গ্রীষ্মে আসিয়া ওয়েভিল নামের এক নারীর প্রেমে পড়েন টেড হিউজ। এই সম্পর্কের জের ধরে হিউজ ও সিলভিয়ার সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং তারা আলাদা থাকতে শুরু করেন। সিলভিয়া সন্তানদের নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে চলে যান। হিউজ এর আগে সিলভিয়াকে শারীরিকভাবেও আঘাত করতেন বলে বিভিন্ন চিঠিপত্রে সিলভিয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব কারণে সৃষ্ট হওয়া মানসিক অবসাদ থেকে সিলভিয়া বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালান এবং এক সময় সে চেষ্টা সফল হয়। মৃত্যুর আগে সিলভিয়া হিউজকে একটি চিঠি লেখেন, যাতে লেখা ছিল, ‘আমি লন্ডন ছেড়ে যাচ্ছি। আর কোনোদিন তোমার মুখ দেখতে চাই না।’
আত্মহত্যার আগে চিঠিটি ডাকযোগে সিলভিয়া নিজেই হিউজকে পাঠিয়েছিলেন এবং একদিন পরই চিঠিটি হিউজের হাতে পৌঁছে যায়। পরদিনই হিউজ চিঠিটি নিয়ে সিলভিয়ার কাছে ছুটে আসেন। সিলভিয়া চিঠিটি হিউজের হাত থেকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ পুড়িয়ে ফেলেন এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে হিউজ তার ‘লাস্ট লেটার’ কবিতাটি রচনা করেন। সেখানে লেখা হয়,
‘Over everything, Late afternoon, Friday,
¸ last sight of you alive.
Burning your letter to me, in the ashtray,
With that strange smile.
Had I bungled your plan?’
যদিও হিউজ কবিতাটি লিখেছিলেন সিলভিয়ার মৃত্যুর পরপরই, ১৯৬৩ সালেই, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, হিউজ এটি তার জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। কবিতাটি প্রকাশিত হয় হিউজের মৃত্যুরও অনেক পরে, ২০১০ সালে। জনশ্রুতি আছে যে, চিঠিটি হিউজকে পাঠানোর পরদিন সিলভিয়া হিউজকে ফোন করেছিলেন এবং হিউজের পরিবর্তে সে ফোন তুলেছিলেন হিউজের আরেক প্রেমিকা সোসান এলিস্টন। ফলে সিলভিয়ার মানসিক বিপর্যয় চরম আকার নেয়। যে ফ্ল্যাটে তিনি আর হিউজ বাসরযাপন করেছেন, একান্ত সময় কাটিয়েছেন, সেই ফ্ল্যাটেই হিউজ অন্য কাউকে নিয়ে প্রণয়লীলায় ব্যস্ত, এ ভাবনা সিলভিয়ার সংবেদী মনকে আরো বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সে রাতেই তিনি গ্যাসচুল্লিতে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ফলে পরদিন এসে হিউজ তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। 

অনেকেই অভিযোগ করেন যে, মূলত হিউজই সিলভিয়াকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সিলভিয়ার আত্মহত্যার পর হিউজ ‘দ্য হাউজিং অব ওল্ডস’ এবং ‘সং অব এ র‌্যাট’ শিরোনামে দুটি কবিতা লেখেন। পরবর্তী তিন বছরে তাকে আর কোনো কবিতা লিখতে দেখা যায়নি। প্লাথের আত্মহত্যার ছয় বছর পর হিউজের চার বছর বয়সী কন্যা আলেক্সান্দ্রা তাতিয়ানা এলিসকে খুন করে ওয়েভিল নিজেও ১৯৬৯ সালের ২৩ মার্চ সিলভিয়ার মতোই গ্যাসচুল্লির মধ্যে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেন। যা হিউজকে ভীষণ মর্মাহত করে। এই মৃত্যুর জন্যও অনেকে হিউজকেই দায়ী করেন। কারণ ওয়েভিলও মৃত্যুর আগের লেখা চিঠিতে বলেন, ‘ভেবে দেখলাম, টেড হিউজের কোথাও নেই আমি। তার ভাবনাজুড়ে শুধুই সিলভিয়া।’
পরবর্তী সময়ে, ১৯৭০ সালে হিউজ ক্যারল অরচার্ড নামের এক সেবিকাকে বিয়ে করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু হিউজ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিলভিয়াকে ভুলতে পারেননি। তার বিভিন্ন লেখায় এর প্রমাণ মেলে। মৃত্যুর এক মাস আগে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বার্থডে লেটারস’ই এই কথাটির উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে। এখানকার ৮৮টি কবিতাজুড়ে আছেন সিলভিয়া। এছাড়া দলাস্ট লেটার’ কবিতার শেষে হিউজ লেখেন, 
‘Then the voice like a selected weapon
Or a measured injection,
Coolly delivered its four words
Deep into my ear: `Your wife is dead’.
তবু অতিরিক্ত নারীসঙ্গই হিউজের ব্যক্তিজীবনকে বিষিয়ে তুলেছিল এবং হিউজকে অনেকাংশে হিতাহিত বোধশূন্য করেছিল বলে মনে করা হয়।    
হিউজ ১৯৯৮ সালের ২৮ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে লন্ডনের সাউদওয়ার্কে কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর পর, ৩ নভেম্বর, ১৯৯৮ সালে তার শবযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সাহিত্য জগতে উইলিয়াম জেমস টেড হিউজ একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। ১৭ আগস্ট বিশ্বসাহিত্যের এই অমর প্রতিভার জন্মদিন। তার প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।

×