ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

বিলুপ্ত ফুলের ডিএনএ থেকে তৈরি হচ্ছে পারফিউম

প্রকাশিত: ০১:২৭, ৬ জুলাই ২০২৫

বিলুপ্ত ফুলের ডিএনএ থেকে তৈরি হচ্ছে পারফিউম

বিজ্ঞানীদের একটি দল, একটি ডিএনএ সিকোয়েন্সিং ল্যাব এবং কিছু বিলুপ্ত প্রজাতির সংমিশ্রণে যা তৈরি হয়েছে, তা শুনতে সিনেমার গল্পের মতো লাগলেও, বাস্তবে এটি Future Society নামের একটি বায়োটেক সুগন্ধি কোম্পানির নতুন বাস্তবতা। এই কোম্পানিটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হারবারিয়া ও বায়োটেক প্রতিষ্ঠান Ginkgo Bioworks-এর সহযোগিতায় এমন সুগন্ধি তৈরি করছে, যার ভিত্তি বিলুপ্ত ফুলের ডিএনএ।

হাজার বছরের পুরোনো সংরক্ষিত গাছপালার ডিএনএ বিশ্লেষণ করে, এর ঘ্রাণ উপাদান শনাক্ত করে Future Society ইতোমধ্যেই ছয়টি সুগন্ধি বাজারে এনেছে, যার প্রতিটির মূল গন্ধ ফুল, কাঠ এবং ভেষজ ধাঁচের।

এর একটি হলো ‘অরবেক্সিলাম স্টিপুলাটাম’ নামে এক ধরণের ভেষজ গাছের ঘ্রাণ, যা ওহাইও নদীর ফালস এলাকার রক আইল্যান্ডে পাওয়া যেত এবং শেষবার ১৮৮১ সালে ফুল ফুটেছিল। ষাঁড় বিলুপ্ত হওয়ার কারণে এই গাছের বীজ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯২০-এর দশকে পুরো এলাকা বাঁধ দিয়ে প্লাবিত হলে এই প্রজাতিটিও হারিয়ে যায়।

ঘ্রাণের পুনর্জন্ম: এক জৈব প্রযুক্তির বিপ্লব

Future Society-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জাসমিনা আগানোভিচ বলেন, “আমরা এমন ঘ্রাণ তৈরি করতে চেয়েছি যা আগে কখনো কেউ শোঁকেনি — এমনকি যেটা তৈরি করাও একসময় সম্ভব ছিল না।” তিনি বলেন, মানুষের মতোই উদ্ভিদের ডিএনএ থেকে ঘ্রাণ নির্ধারণ করা সম্ভব, ঠিক যেমনটা ancestry.com বা 23andme-এর মাধ্যমে মানুষের জিন বিশ্লেষণ করা হয়।

তবে, আগানোভিচ স্বীকার করেন এটি একদম নিখুঁত বিজ্ঞান নয়। যেহেতু একটি ফুলের ঘ্রাণে শত শত রাসায়নিক যৌগ থাকে, তাই পুরোনো নমুনা থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সেই ঘ্রাণ পুরোপুরি নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। বরং এই বিশ্লেষণ একটি 'সুগন্ধ প্রোফাইল' তৈরি করে দেয়, যেটিকে ব্যবহার করে সুগন্ধি বিশেষজ্ঞরা কল্পনার ছোঁয়ায় ঘ্রাণ তৈরি করেন।

শিল্প ও বিজ্ঞানের মিলন

এই প্রকল্পে প্রযুক্তি থাকলেও শুধুমাত্র বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করা হয়নি। হার্ভার্ডের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা, পারফিউম বিশেষজ্ঞ এবং জীববিজ্ঞানীরা একসাথে কাজ করে গাছের ডিএনএ, তার পরিবেশ ও উদ্ভিদের বংশপরম্পরার তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন।

Future Society এর সুগন্ধিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:

  • Grassland Opera: অরবেক্সিলাম ফুলকে ঘিরে গড়া এই ঘ্রাণটি ‘ভেজা, সবুজ ও সতেজ’ ধাঁচের।

  • Reclaimed Flame: দক্ষিণ আফ্রিকার বিলুপ্ত ‘Leucadendron grandiflorum’ ফুলের স্মরণে তৈরি। মাটির গন্ধ ও ভেষজ উপাদানে তৈরি এই ঘ্রাণ পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিলুপ্তির গল্প বলে।

  • Invisible Woods: ভারতের বিলুপ্ত ‘Wendlandia angustifolia’ গাছের ঘ্রাণে অনুপ্রাণিত, যেখানে খরা ছিল বিলুপ্তির কারণ।

  • Solar Canopy: হাওয়াইয়ের বিলুপ্ত ‘hibiscadelphus wilderianus’ ফুলের ঘ্রাণ। এটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে ভেটিভার, লিচু ও ম্যাগনোলিয়ার মতো উপাদান।

ফুল নয়, ঘ্রাণের শ্রদ্ধাঞ্জলি

Future Society আসলে ফুল পুনর্জন্ম দিচ্ছে না, বরং প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করছে সেই ঘ্রাণ যা একসময় প্রকৃতিতে ছিল। এই ঘ্রাণ শুধুমাত্র সুগন্ধি নয়, বরং স্মৃতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি এক শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জাসমিনা আগানোভিচ বলেন, “আমরা প্রযুক্তি দিয়ে প্রজাতি ফিরিয়ে আনতে পারলেও, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এটি শুধুমাত্র বিজ্ঞানের বিষয় নয় — এটি অনুভূতির, স্মৃতির, সংস্কৃতির বিষয়।”

এই প্রযুক্তি হয়তো ‘জুরাসিক পার্ক’-এর মতো ডাইনোসর ফিরিয়ে আনছে না, কিন্তু মানুষের আত্ম-অভিব্যক্তির এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছে সুগন্ধির মাধ্যমে — হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর ঘ্রাণ ফিরিয়ে এনে।

Jahan

×