ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

গল্প ॥ ঝিড়ি

ফেরদৌস জান্নাতুল

প্রকাশিত: ২১:১৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গল্প ॥ ঝিড়ি

পাহাড়ি ঝিড়ি

ঘন জঙ্গল। তার উপর নিকষ কালো অন্ধকার। ছোট টর্চের টিমটিমে আলো হাতে অন্ধকারের বুকচিরে এগিয়ে চলে মোল্লা রহিম। এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে পলো। ঘন জঙ্গলটা পেরুলেই হাল্কা বাদাড়ে পাহাড়ি ঝিড়ি। সেখানে অল্প পানিওয়ালা গর্তগুলোতে আলো ফেলে মাছ ধরে সে। প্রতি রাতে তার এই শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। যেন একাই এক পাহাড়ি পৃথিবী। অদম্য সাহসের শিখরে রহিমের জীবন ছুটে চলে সমস্ত ভয় কষ্ট পেছনে ফেলে। শুধু জীবন নয়, সঙ্গে ছুটে চলে ক্ষুধা-দারিদ্র। এই ক্ষুধাই তার ভয়কে জয় করেছে। জন্মই যেন এক ক্ষুধার পাহাড়। শুধুই কী শরীরের ক্ষুধা! তা কিন্তু নয়। মন এক তৃষ্ণার্ত মরুভূমি। দেহের ক্ষুধা মিটলেও সবার মনের ক্ষুধা মেটে না। রহিমের মনের বালাই নেই। একদিনের খাবারের বন্দোবস্ত হলেই ঘরে ফেরা। বউ-বাচ্চা নিয়ে আনন্দে দিন পার করা। পৃথিবীর সমস্ত মানুষযদি এই নিয়মের মগডালে দোল খেত তবে মহাকাশ থেকে নক্ষত্রেরা হাততালি দিত। 
জঙ্গলে কেবল অন্ধকারই নয়; সেই সঙ্গে আছে সাপ, কেঁচো আর রক্তচোষা জোঁক। আছে কাটাগুল্ম। হঠাৎ হঠাৎ গায়ে লেগে অনেক সময় কেটে রক্ত বের হয়। সেদিকে অতো নজর থাকে না রহিমের। ঘরে ফিরলে বউ দূর্বা ঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দিলেই গল্প মিটে গেল।
ভারি অন্ধকারে সঙ্গী হয়েছে আকাশের তারাগুলো। রহিম আকাশের দিকে তাকালেই সমস্ত পথ চিনে ফেলে। লুঙ্গির গিঁট থেকে দিয়াশলাইয়ের বাক্স আর বিড়ির প্যাকেট বের করে সে। একটা বিড়ি ধরিয়ে নেয়। বিড়ির আগুন এই অন্ধকারে হিরের মতো ঝকমক করে ওঠে। রহিম বিড়ি টানতে টানতে পথ চলতে থাকে। 
সে অনেকদিন আগের কথা। মোল্লা রহিমের বয়স তখন বারো কি তেরো। বাপের সঙ্গে এই পথে রাতে মাছ ধরতে এসেছে বহুবার। একবার মাছ ধরতে এসে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শিকার হয়। তখন বর্ষাকাল। কাদাজলে আবৃত্ত জংলী পথ মাড়িয়ে ঝিড়ির ধারে খালই হাতে বসে আছে সে। এমন সময় টর্চের আলোতে একটা সাদা কী যেন দেখতে পায়। খালইটা রেখে সেটা ধরতে যায় রহিম। শক্ত জিনিসটা পানি থেকে তুলে ভালোভাবে আলোটা ফেলতে বলে বাবাকে। আলো পড়তেই ও মাগো বলে দুজনেই পানি থেকে উপরে উঠে দাঁড়ায়। সাদা জিনসিটা আসলে মানুষের মাথার খুলি। সেদিনের পর রহিমের টানা জ্বর। সে জ্বর আর ছাড়ে না। এক মাস বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। ঘটনাটা মনে হতেই গা ছম করে ওঠে রহিমের। 
টর্চের আলো কম। তাই টর্চটা নিভিয়ে বিড়ির আগুনে পথ চলতে থাকে সে। আলোর মাছে আলো কম হলে একদিনের পরিমাণ মাছ পাওয়া মুশকিল। রহিম গান ধরতে চাইলো, কিন্তু কী মনে করে আর গাওয়া হলো না। হঠাৎ পতপত শব্দে মাথার উপর দিয়ে বাদুড় উড়ে গেল। এগুলো নিশাচর প্রাণী। ঠিক রহিমের মতো। 
আকাশে মেঘ নেই। ঝকঝকে তারা। এলোমেলো বাতাসে এক গাছ আরেক গাছের সঙ্গে মাথা ঠোকাঠুকি। দেখে মনে হয় ওরা বন্য কোনো খেলায় শৈশব পার করছে।
রহিম ঝিড়ির ধারে আসতেই অবাক হয়। আজ আরও তিন গ্রুপ এসেছে মাছ ধরতে। এমনিতেই মাছের পরিমাণ কম, তার উপর তিনতিনটে গ্রুপ। ভীষণ ঘাবড়ে যায় সে। মনে মনে গালি দিয়ে বসে। কিন্তু মুখে বলে, চাচা নাকি? খবর কি? মাছে আইছেন?
হ আইছি আইজ। মেলা দিন আহিনা। আছো কেমুন?
ভালা, তয় যে বাতাস, এর মইধ্যে তো মাছ পলায়া যাইবোনি।
হহ, তয় চেষ্টা তা করন লাগবো। 
রহিম আরেকটা বিড়ি ধরায়। রাগে গা গজগজ করে। মনে মনে ভাবে ইচ্ছা হইতাছে তোগোরে জলে চুবাইয়া ধরি। 
কখন আইছেন চাচা?
এই ঘণ্টা দেড়। রহিম নাইমা পরো।
বিড়ি টানতে টানতে বলে, তোমরাই ধরো।
রাগে গা মাথা ঘামতে থাকে রহিমের। রাগ যখন বেশি হয় তখন বিড়ি দ্রুত ফুরিয়ে যায়। আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে একা একা বিড়বিড় করতে থাকে। 
কিছু কইলা রহিম?
না, বাতাসে খালি বিড়ির আগুন নিভ্যা যায়। তাই বাতাসের গালি দিতাছি। 
ও তাই কও। তয় নামো না ক্যা?
কইলাম তো, আইজ তোমরাই মারো। আমি আইছিলাম অন্য কামে। জঙ্গলের ভেজা মাটির কাঁকড়া ধরুম। ভেজা মাটির কাঁকড়া গুলান বহুত স্বাদের হয়। 
হহ তাই করো।
সেদিনের মতো মাছ ধরা হলো না আর। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত হয়ে গেল। বাচ্চা দুটোর শান্ত কোমল মুখে হাত বুলিয়ে দেয় রহিম। আহা, কী নিষ্পাপ। সারাদিন জলে-জঙ্গলে ঘুরে প্রশান্তির ঘুমে বিভোর। মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্টে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে রহিমের। অভারের সংসারে ভালো মতো খাওয়াতেও পারে না ছেলে-মেয়েদের। মনে মনে ভাবে কাল থেকে বাজারে কোনো দোকানে কাজ নেবে। কৃষিকাজ আর মাছ ধরে সংসার চালানো দায়। কটা মুড়ি খেয়ে মাত্র বালিশে মাথা দিয়েছে অমনি বাইরে চিৎকার।
বাঁচাও গো, পাগলা হাতির দল সব শ্যাস করলো। 
ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে রহিম। দরজা খুলে বোঝার চেষ্টা করে কোনদিকে চিৎকারের শব্দ।
ওই তো সফর আলীর ঘরের চালা খোলা। অন্ধকারে আবছা বোঝা যাচ্ছে দু-তিনটে হাতি ঘরের চালা টানাটানি করছে। লোকজন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। মুহূর্তেই পুরো গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রহিম ছেলেকে কোলে নেয়। মোরশেদাকে বলে লুৎফুনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বের হতে। পালাতে হবে। এখানে থাকলে পাগলা হাতির পাল পিষে মারবে। প্রাণপণে সবাই ছুটতে থাকে। হাতিরা মারমুখী হয়ে একের পর এক ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে থাকে। এরমধ্যে একজন হাতির পায়ের তলায় পিষে মারা গেছে। হাতির দল সব তছনছ করে জঙ্গলে চলে যায়। 
ভোর অবধি একটা গাছের তলায় আটসাট হয়ে চারজনে কাঁপতে থাকে। বীভৎস একটি রাত যেন সর্পিল ফণা তুলে ছোবল দিল। আজ ভোরের পাখিদের ডাক নেই। রাতের ভয়ঙ্কর তা-বে পাখিদের মনেও আতঙ্কের উদ্রেক। 
গুটি পায়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে রহিমের পরিবার। বুকটা দুরুদুরু কাপছে রহিমের। ঘর বলতে কিছু রেখেছে তো হাতির পাল! এই শঙ্কায় পা উঠছে না। একমাত্র আশ্রয়টুক ুহারালে যে পথে বসতে হবে । জীবন যেন এক ¯্রােতের ধারা। এটি কখন অশুভ স্রোত হয়ে ধরা দেবে কেউ জানে না।
লুৎফুন জিজ্ঞেস করে, আব্বা হাতির পাল মাঝে মইধ্যেই খ্যাপে ক্যা?
খ্যাপে কী এমনে। মানুষ-ই তো যত নষ্টের গোড়া।
ক্যান মানুষ আবার কি করলো?
দখল, দখলরে মা। আমরা মানুষেরাই তো ওদের বসবাসের বন-জঙ্গল দখলে নিছি। তাইতে ওরা মাঝে মাঝে রাগ মেটায়। দখলদারিত্বে ভইরা গ্যাছে দুনিয়া। যে যত দখল দখল খেলা খেলবো সে তত জিতবো।
তাইলে কি আমাগো বৌছি খেলার মতন, আব্বা!
রহিম কষ্টের মধ্যেও মৃদু হাসে। বলে হ, অহন চল আগে দেহি ঘর আর আছে কিনা।
কলতলার কাছাকাছি গিয়ে মোরশেদা চিৎকার করে ওঠে
হায় হায়ক রছেকী, আমার সব শ্যাস কইরা ফালাইছেরে।
রহিম দ্রুত এগিয়ে যায়, টিনের চালাগুলো মাটি থেকে তোলার চেষ্টা করে। কাঠগুলো দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে ফেলেছে। বিছানা টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। লুৎফুন পুতুলের বাক্সটা ধরে কাঁদতে থাকে। সব এলোমেলো। ঘরবাড়ি সব তছনছ করে তবেই শান্ত হয়েছে হাতির পাল।
রহিম চালা ধরে উদাস দাঁড়িয়ে পড়ে। ততক্ষণে দিনের আলো পুরোপুরি ফুটে গেছে। বাতাস বইছে। দু-একটা কাক কা-কা করে এদিক থেকে ওদিক উড়ে যাচ্ছে। সমস্ত গ্রাম থমথমে। কলা গাছের গোড়ায় বসে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে একটি কুকুর। কেবল রহিমের মনের ভেতর মন নেই। শঙ্কায় গিলে ফেলেছে চারপাশ। অনিশ্চিত ভবিষৎ যেন ফিসফিসিয়ে বলে দিচ্ছে সামনে নিকষ কালো অন্ধকার। 
লুৎফুনের কোঁচড়ে দৌড়ে আসে পোষা বিড়ালটা। চোখ দিয়ে জল পড়ে লুৎফুনের, মাটিতে গড়ায়। ভেজা মাটি আরও ভিজে ওঠে নোনাজলের আকুল স্পর্শে।

×