
কবিতা খুব ভ্রাম্যমাণ। কবিতা কিছুটা জটিল, কুটিলও বটে
কবিতা খুব ভ্রাম্যমাণ। কবিতা কিছুটা জটিল, কুটিলও বটে। আজকের কবিতার ভাষা আগামীর যে কোনো দিন পাল্টে যেতে পারে, বদলে যেতে পারে ব্যবহার রীতিনীতি। কবিতা নিয়ে কথা বলতে যাওয়া কঠিন কাজ। কবিতার সরাসরি সংজ্ঞা দেওয়াও কষ্টসাধ্য। কোন্টা সঠিক আর কোন্টা বেঠিক সে বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে কবিতা যে নন্দনতত্ত্বের উচ্চমার্গের বিষয় এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নানামাত্রিক কবির কবিতার বিষয় বিচিত্র ভাবনা। আমি কিছুটা তুলে ধরছি।
যুক্তরাষ্ট্রের কবিদের মধ্যে রবার্ট ফ্রস্ট সবচেয়ে বহুল পঠিত কবি। তিনি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি খুব প্রভাবশালী একজন কবি হিসাবে স্বীকৃত। তিনি কবিতাকে যেভাবে দেখেছেন আমি অপরিবর্তিতভাবে সে অংশটি তুলে ধরলাম।
Poetry is a process. Poetry is the renewal of words. Poetry is the dawning of an idea. Poetry is that which tends to evaporate from both prose and verse when translated. Poetry is the liberal arts.
এখন দেখি স্বনামখ্যাত বাঙালি কবিরা কবিতা নিয়ে কী ভেবেছেন ? তাঁদের সংজ্ঞা অনুযায়ী কবিতা কী ?
চারুশিল্পের অন্যতম একটি শাখা হচ্ছে কবিতা। ইংরেজিতে যার প্রতিশব্দ দেওয়া হয়েছে চড়বস বলে। “কবিতা অন্তর্জাতিক এমন একটি উপলব্ধি যা বিশিষ্ট শব্দকল্প এবং অলঙ্কারের মাধ্যমে রসাশ্রিত হয়ে মানব মনে অনির্বাণ আনন্দধারা সৃষ্টি করে থাকে।” ইংরেজ কবি কোলরিজ কবিতার সংজ্ঞায় বলেছেন, “Best Word In The Best Order।” কবি ড. সৈয়দ আলী আহসান যার রূপান্তর করেছেন, “সুষম শব্দের সুষম বিন্যাসই কবিতা।” এটাকে অন্যভাবেও বলা যায়, “অনিবার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাসই কবিতা।”
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, “রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।” রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মতে, উপমাই কবিতা। মালার্মে বলেছেন, শব্দই কবিতা। দান্তের মতে, সুরে বসানো কথাই হলো কবিতা। ম্যাকলিশ বলেছেন, কবিতা কিছু বোঝায় না, কবিতা হয়ে ওঠে। রবার্ট ফ্রস্টের মতে, সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।
কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, ছন্দে সমর্পিত শব্দেরই নাম কবিতা। সৈয়দ শামসুল হকের মতে, কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। হুমায়ুুন আজাদের মতে, পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে, ওষ্ঠে, হৃৎপি-ে, রক্তে, মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।
সিকান্দার আবু জাফরের মতে, আমি কবিতা লিখি অনায়াসে। যেমন সকলেরই ক্ষেত্রে জীবনের আশেপাশে অসংখ্য সুলভ দুর্লভ মুহূর্ত নানারূপে অনাবৃত হয়েছে আমার সামনে। আমি কোনো কোনো সময় সেই সব মুহূর্তের স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ করেছি সত্য-বিচ্যুতি না ঘটিয়ে। সেই আমার কবিতা।
কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝি না, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না’, ‘বোঝানো’ যাবে না।
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদল্লাহর মতে, যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সঙ্গে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে তাকেই বোধহয় কবিতা বলা যেতে পারে।
শক্তিমান কবি আল মাহমুদ বলেছেন, পাখির নীড়ের সাথে নারীর চোখের সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের দরকার সেটাই কবিত্ব।
এসব সংজ্ঞার মাধ্যমে কবিতার একটা চিত্র ফুটে উঠেছে সবার সামনে। যে কোনো লেখা তাই কবিতা হবে না, কোনো কোনো লেখা হবে কবিতা।
প্রচলিত আছে বাঙালি মাত্রই কবি। কথাটা ঠিক নয়; একটু ঝামেলা আছে; কারো দ্বিমত থাকতে পারে। বলা যায় বাঙালি কবি ভাবাপন্ন। কবিতা ভালোবাসে, মানসপটে ভাবের খেলা চলতে থাকে। কবি জীবনানন্দের মতে কেউ কেউ কবি, সবাই নয়। কথাটা ঠিক। আবার বলা হয়, কবি হয়ে জন্মাতে হয়, জন্মে কবি হওয়া যায় না, সেটাও একেবারে ঠিক নয়। তবে প্রকৃত অর্থে কবি হয়ে ওঠা দুঃসাধ্য কাজ।
এখন থেকে বহু বছর আগে আমি যখন কলেজে পড়ি তখন কজনকে নিয়ে তৎকালীন বাংলা একাডেমি প্রধান ডক্টর কাজী দীন মোহাম্মদ-এর কাছে গিয়েছিলাম একটা লিটলম্যাগে ওনার লেখা চাইবার জন্য। আমাদের দলের প্রায় সবাই ভাবের তাড়নায় একটু আধটু কবিতা লেখার চেষ্টা করত। স্যার আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন কী বিষয়ের প্রতি আমাদের আগ্রহ। অতি উৎসাহিত হয়ে অনেকটা গর্বভরেই বললাম, স্যার আমরা এ দলের সবাই কবিতা লিখি। শুনে থমকে গেলেন তিনি। একটু যেন ঢোক গিলেই শুরু করলেন, বেশ ভালো। কিন্তু একটা জিনিস মনে রেখো, কবিতা সাহিত্য অঙ্গনে পোলাউ-কোর্মার মত। খাঁটি ঘি-এর পোলাউ সবার ভাগ্যে জোটে না, আবার সবার পেটে হজমও হয় না। এখন ভেবে দেখো গল্প-উপন্যাস লিখবে, না কবিতা নিয়েই থাকবে। বলেছিলাম, স্যার দোয়া করবেন যেন কবিতা নিয়েই এগুতে পারি।
আজ দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে এসে অধরা কবিতা নিয়ে কতটা এগিয়েছি বলতে পারছি না। মনে পড়ে গেল কাব্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সৈয়দ শামসুল হকের কথা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নিজের কবিতা লেখা বিষয়ে যে কথাগুলো বলেছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। একটি কবিতার জন্মের পর সৈয়দ হক কী বিষয়গুলো বিচার্যে আনতেন? তা আদৌ কবিতা হয়ে উঠেছে কিনা, যদি কবিতা হয় তবে বাংলা কবিতার মূল ধারায় প্রবহমান কিনা? দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি সৈয়দের কাছে জরুরি তা হলো, সৈয়দ হকের পূর্বের কবিতার চেয়ে পরবর্তীটির উত্তরণ ঘটেছে কিনা। শেষ বিষয়টি, অন্তত, মানদ-ে এই কবিতাটির (পরের কবিতাটির) অবস্থান কোথায়? অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, আমরা যারা বাংলা কবিতা লিখছি বা চর্চা করি, তাদের মনের গহীনে কথাগুলো সযতেœ গেঁথে রাখবার মতোই বটে।
বাংলা কবিতা উন্নয়নের সঙ্গে যে কথাটি বলতে চাই, তা হচ্ছে আধুনিক কবিতার জনক জীবনানন্দ দাশই বাংলা কবিতার যে নতুন ধারা তৈরি করেছেন, কবিতা আজ অবধি সেই ধারায় প্রবাহিত বলে আমার বিশ্বাস। কবি শামসুর রাহমান বিষয়ের দিক থেকে কিছুটা অভিনবত্ব এনেছেন বটে। অর্থাৎ যে বিষয়টি কবিতায় আনাটা প্রায় অসম্ভব ছিল, তাকেও তিনি কবিতায় ধরবার চেষ্টা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। এমনকি মাতালের প্রলাপও তাঁর কবিতা থেকে বাদ যায়নি। একাত্তরের পর থেকে বাংলা কবিতা নিয়ে কাজ করবার ক্ষেত্রটি অগাধ থাকা সত্ত্বেও ততটা কাজ যেন হয়নি। তথাপি এখনো কেউ কেউ রবীন্দ্র্র কিংবা জীবনানন্দীয় বলয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেননি। বিশেষ করে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। কেননা, রবীন্দ্রকাব্যের এক বিশাল সাগর থেকে বেরিয়ে না এলে সেই কবিকে আলাদাভাবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।
এখন ভাবনাকে একটু ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য; কবিতার কৌশলগত দিক কিংবা ছন্দ অথবা চিত্রকল্প অথবা কবিতার জনপ্রিয়তা নিয়ে শব্দ ও কিছু টুকরো কথা বলতে চাই। একজন নির্মাণ প্রকৌশলীকে ইট-কাঠ সিমেন্ট অর্থাৎ প্রতিটি বিষয় যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে হয়; তেমনি একজন কবিকেও পোয়েট্রি টুলস বা কবিতা লেখার কৌশল জানাটা অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার। তবেই সম্ভব ফর্ম কিংবা কাঠামো ভেঙে নতুন মাত্রা যোগ করার। কবির ছন্দ বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা থাকাটা জরুরি। তবে তিনি এর ব্যবহার কিভাবে করবেন তা তার নিজস্ব ব্যাপার। চিত্রকল্পকে কবিতার প্রাণ বলে জ্ঞান করা হয়।
যতটা শক্তিশালী বা নতুনত্ব ধারণ করে যে কবিতা, সেই কবিতা ততো উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে। অনেকের ধারণা, মুক্তছন্দ কবিতা লেখা খুব সহজ। কেননা, সেখানে যথেচ্ছাচার চলে। এটি একেবারেই ভুল কথা। মুক্তছন্দের ভেতরও ছন্দ থাকে, তবে কবি তাকে নিজের মতো করে ব্যবহার করবার স্বাধীনতা রাখেন। কবিতার উপাদান একেবারে কাদামাটির মতো নরম। এত নরম উপাদানে কবিতার শরীর তৈরি করাটা যথেষ্ট কঠিন কাজ। গড়তে গিয়ে হয় বিমূর্ত অর্থাৎ অবোধ্য হয়ে দাঁড়ায় অথবা এতটাই সরলরৈখিক মূর্তি গড়ে ওঠে, যা উজাড় বলিরেখা, চোখের নাচন কিংবা স্নায়ুুর কাঁপন দৃশ্যমান হয় না। তবে সব কথার শেষ কথা হলো কবিতা অর্পিত কিছু নয়। এটি স্বতঃর্স্ফূতভাবে কবির মাঝে আন্দোলিত হবার বিষয়। বেশ কয়েক বছর পূর্বে কবি মান্নান সৈয়দের সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। তিনি চিত্রকল্প নিয়ে স্পষ্টতই বলেছেন, তিনি কবিতার ঘরে কড়া নাড়েন না। কবিতা তার কাছে এলেই লেখেন কবিতা।
বাংলা কবিতার উন্নয়ন ঘটাতে গেলে কবিতা নিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ভাবতে হবে। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে প্রগতিশীল হতে হবে। তবেই হয়তো কবিতা অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতো বিপুল গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কবিদের নিশ্চয়ই ভাবতে হবে কবিতার জন্য কবিতা লিখছি। আবার নন্দনতত্ত্বের বিষয়টি থেকে যেন বিচ্যুতি না ঘটে; সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। ইদানীং অনেক কবিতাপ্রেমিক কবিতা লিখছেন অনেকটা মনের খেয়ালে, কিছুটা খেলার ছলে। হয়তো লিখতেন গল্প, প্রবন্ধ কিংবা উপন্যাস। এখন কবিতার প্রতি দুর্বল হয়ে লিখছেন কবিতা। সাধুবাদ।
কিন্তু ভাবছেন কি কতটা কবিতা হয়ে উঠছে; আর কবিতা হলেও তার গুণগতমান কোন্ পর্যায়ের? আমার দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতা লেখাটাকে অত সহজভাবে নেয়াটাও কবিতার প্রতি এক ধরনের অবহেলা। ভাববেন না আমি কাউকে নিরুৎসাহিত করছি। শুধু ভাবছি সময় অপচয়ের কথা। যে কোনো বিষয়ের ওপর স্কিল বা কলাকৌশল অর্জন করতে অনেকটা সময় ব্যয় হয়। কবিতা বিষয়ে রায় দেবার মতো আমি কেউ নই। আমার কালো চশমা এবং ভাবনার অন্তরালে যে ভাবনাগুলো ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে, তা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চাই।
সবশেষে এটুকুই বলব, কবিতা বিষয়ে আমাদের মননে, চিন্তা চেতনায় ঝড় তুলবার জন্য প্রচুর কর্মশালা এবং কবিদের মাঝে আলাপচারিতা প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। এছাড়া বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনের কবিতা অনেক বেশি বেশি পড়ার কোনো বিকল্প আমার অন্তত জানা নেই।