ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বদরবারে পৌঁছে যাক বাংলা সাহিত্য

মোহিত কামাল

প্রকাশিত: ২১:১০, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

বিশ্বদরবারে পৌঁছে যাক বাংলা সাহিত্য

গীতাঞ্জলি শ্রীর সঙ্গে লেখক

বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে ২০১১ সাল থেকে শুরু করা হয়েছে এ অনন্য আন্তর্জাতিক সাহিত্য-উৎসব। শুরুতে ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ নামে পরিচিতি লাভ করলেও ২০১৫ সাল থেকে নামকরণ করা হয়েছে ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’। বিশাল এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছেন বিশ্বের নানা দেশের সাহিত্যিকগণ। চার দিনব্যাপী অসাধারণ উদ্যোগের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই।  অনেক সীমাবদ্ধতা থাকার পরও বিশ্বের বরেণ্য সাহিত্যিকদের কাছে পেয়ে ভাবের আদান-প্রদান ঘটেছে আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের।
এভাবে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে বলতে চাই এ ধরনের আয়োজন প্রতিবছর হওয়া উচিত। অনেক প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ পাননি। তাঁদের কেউ কেউ কষ্ট পেয়েছেন, কেউ কেউ সহজভাবে নিয়েছেন। কেউ কেউ উৎসবকে উপেক্ষা করতেও পেরেছেন। কেউ কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজেদের হতাশা এবং ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেছেন।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় এ ধরনের অভিব্যক্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে ঢাকা লিট ফেস্টের প্রতি তাঁদের মনের  তীব্র আকর্ষণ; প্রেষণার গোপন স্পন্দন। সেটা পূরণ না হওয়ায় তাঁদের মনে হতাশা জেগেছে। হতাশা থেকে জেগেছে ক্ষোভ। শব্দ-আক্রমণের  মাধ্যমে তাঁরা সেই ক্ষোভের রিলিজ করেছেন। এভাবে বিবেচনা করলে কোনো প্রতিক্রিয়াকেই অশুভ কিংবা অসম্মানের জনক মনে হবে না।

সবার আবেগের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে ভুল-ভ্রান্তি এবং ঘাটতি  সংশোধন করে এ ধরনের আরও জমজমাটভাবে উৎসবের আয়োজন হবে-এই আশাবাদ রাখছি। বলতে দ্বিধা নেই এ রকম আয়োজন কবি-সাহিত্যিকদের perceptual quality বদলে দিয়েছে, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করেছে, চিন্তার জগৎকে নতুনভাবে নাড়া দিয়েছে, মনকে উদার ও মহৎ করেছে। কবি, সাহিত্যিকগণ একদিন সীমান্তহীন সাহিত্যবিশ্বের অংশীদার হবেনÑ এ বিশ্বাসও মাথায় তুলে রাখলাম। ইতোমধ্যে বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ভারতে তো আছেই। বই প্রকাশিত হচ্ছে ইংরেজিতে।

এতে করে আমাদের সাহিত্য বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহসহ বুকারজয়ী নুরুদ্দিন ফারাহ, শিহান কারুনাতিলকা, গীতাঞ্জলি শ্রী বাংলা সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থ পড়ার আগ্রহ জানিয়েছেন, খোঁজখবর নিয়েছেন। এটিও ছোট ঘটনা নয়, কিংবা ছোট হলেও অনেক বড় বিষয়ের অগ্রযাত্রাÑ মনে রাখতে হবে আমাদের সাহিত্যবোদ্ধাদের। 
বারবারা এপলার একজন লেখক, প্রকাশক এবং সংগঠক। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের পর প্রথম আলোচনা অনুষ্ঠান তিনি সঞ্চালন করেন। সে আসরে কথা বলেছেন তিন বুকারজয়ী। তাদের কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছেন উপস্থিত দর্শক শ্রোতা, কবি-কথাসাহিত্যিকগণ। বাংলাদেশের দ্বিভাষিক পত্রিকা, শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহ, শব্দঘর-এর English translation of Bangla Masterpieces হাতে পেয়ে তিনি মুগ্ধ হন। এই মাসিক পত্রিকাটির প্রোডাকশনের প্রশংসা করেন এবং  পত্রিকার একটি কপি তিনি সংগ্রহে রাখেন। গীতাঞ্জলি শ্রীও বুকারজয়ী-সংখ্যাটি সংগ্রহ করেন।

হাতে পেয়ে পত্রিকাটিতে নিজের প্রকাশিত ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন মনে হলো। সেখানে তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়েও বিশেষ আলোচনা করা হয়েছে বাংলায়। বিষয়বস্তু পড়তে না পারলেও নিজের ভালোলাগার কথা জানিয়ে দেন স্বল্প কয়েকটি বাক্য ব্যবহার করে। পত্রিকাটির সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল। শিগগিরই পত্রিকাটির দশম জন্মদিন পালিত হতে যাচ্ছে। ছোট থেকেই বড় আয়োজনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে মানুষ। চট করে লাফ দিয়ে হিমালয় ওঠা যাবে না। ধাপে ধাপে কাজের মান উন্নত করে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সাহিত্য-উৎসবে ঘুরে ঘুরে এ বোধ জেগেছে আমার।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের উৎসবে প্রবেশ মূল্য নির্ধারিত করে দেওয়া হয়। টিকিট কেটে উৎসব-প্রাঙ্গণে ঢুকতে হয়। আবার প্রতিটি ইভেন্টের জন্য আলাদা টিকিট কাটতে হয়। দর্শকশ্রোতা, পাঠক-লেখকদের আত্মিক ও আর্থিক সম্পৃক্ততা থাকার কারণে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে কথা শোনার মনোযোগও বেড়ে যায়। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আর তাই এবার ঢাকা লিট ফেস্টে প্রবেশ মূল্য ঠিক করে দেওয়ায় অনেকেই হোঁচট খেয়েছেন।

নতুন সিস্টেম সহজে বরণ করে নিতে পারেননি অনেকে, নানা সমালোচনা করেছেন তাঁরা। মনে রাখতে হবে, এই উৎসবে এক টিকিটে সব ধরনের ইভেন্টে দেখার সুযোগ পেয়েছেন দর্শক। আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের টিকিটের মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখা হয়েছিল। ভিআইপি টিকিটেরও ব্যবস্থা ছিল। ব্যবস্থাপকদের মনোভাব থেকে বোঝা গেছে এই টিকিট মূলত এক ধরনের স্পন্সরশিপ। যারা এই টিকিট কিনেছেন মূলত তারা অন্যদের সাহিত্য-উৎসবকে উপভোগ করা সহজ করে দিয়েছেন।

উৎসবে আগত বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিকদের মধ্যে অমিতাভ ঘোষ ছাড়াও সাহিত্যে নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক  গুরনাহ, বুকারজয়ী নুরুদ্দিন ফারাহ, শিহান কারুনাতিলাকা, গীতাঞ্জলি শ্রী প্রমুখের উপস্থিতি উৎসবের আনন্দকে হিমালয়ের চূড়ায় তুলে দিয়েছে। আর করোনার টিকা আবিষ্কারক সারাহ গিলবার্ট, বারবারা এপলার, জয় গোস্বামী, ফ্লোরেন্স নোইভিল, টিন্ডা সুইনটন, এসথার ফ্রয়েডের উপস্থিতি সাহিত্য আসরকে উজ্জ্বল করেছে, জমজমাটও।
সবার মধ্যমণি ছিলেন ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহ। তানজানিয়ার জাঞ্জিবার দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী এই কথাসাহিত্যিকের উপস্থিতি বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কবি জয় গোস্বামীর উপস্থিতিও কবিদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে।

বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি কামাল চৌধুরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, হুমায়ুন কবির, পারভেজ হোসেন, শাহীন আখতার, মোহিত কামাল, জাকির তালুকদার , মশীউল আলম, প্রশান্ত মৃধা, শামীম রেজা ,আহমাদ মোস্তফা কামাল, হামীম কামরুল হক, শাহনাজ মুন্নি, মাশরুর আরেফিন, আলতাফ শাহনাজ, স্বকৃত নোমান, মোজাফফর হোসেন, ফারহানা রহমান, রুমা মোদক, নাহিদা আশরাফী, সাদাত হোসেন, নীলয় রফিক প্রমুখ লেখকের উপস্থিতিও ছিল প্রাণোচ্ছল, প্রাণময়।

প্রাবন্ধিকদের মধ্যে সলিমুল্লাহ খান, আহমেদ মাওলার উপস্থিতিও ছিল অনন্য। লুভা নাহিদ চৌধুরী, আসিফ সালেহ, মাহরুখ মহিউদ্দিন, মুহাম্মদ মহিউদ্দিনও নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। এই আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত একটি পর্বে কথা বলেছেন কবি কামাল চৌধুরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা , মোহিত কামাল ও আরও একজন। বক্তারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বর্তমানের উন্নয়নের ধারার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা তৈরি করতে পেরেছেন।

কলকাতার কয়েকজন লেখক এই পর্বে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছেন বলে তাঁদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন। স্বকৃত নোমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত বাংলা সাহিত্যের আগামীর আখ্যান কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং ইমদাদুল হক মিলন সাহিত্য আসরকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। সাহিত্যচর্চার সুযোগ বাড়াতে দৈনিক সাহিত্যপাতার সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। বইমুখী প্রজন্ম গড়ে তুলতে ঘরে ঘরে লাইব্রেরি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

বইমুখী প্রজন্ম তৈরি না হলে ভবিষ্যতে পাঠক কমে যাবে বলেই তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন। সবকিছু রাষ্ট্রের ঘাড়ে না চাপিয়ে ছেলেবেলা থেকে পরিবারভিত্তিক বই পঠনের সংস্কার উন্নত করার প্রতি জোর দিয়েছেন তিনি। বাংলা কবিতার বিশ্বায়ন পর্বে কবি কামাল চৌধুরী এবং যশোদা রায় চৌধুরী অনুপম আলোচনা করে দর্শকদের মনে অধ্য আলো গেলে দিয়েছেন।
উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে পর্বে কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেনের সঞ্চালনায় আনিসুল হক, শাহীন আখতার, মোহিত কামাল, জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা একমত হয়েছেন যে আমাদের সাহিত্য হতে হবে আমাদের সংস্কৃতিক জীবনধারা ও ঐতিহ্যনির্ভর। বিভিন্ন সাহিত্যমতবাদ ও মনস্তাত্ত্বিক মতবাদের বিষয়ের লেখকদের জেনে রাখা ভালো।  তবে আমাদের সাহিত্য হতে হবে আমাদের মতো, জীবনমুখী।

এই সাহিত্য উৎসবে প্রথম দিন জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ প্রদান করা হয়। ‘শব্দটা যারা শিখে গেছে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য কবি কামাল চৌধুরী পেয়েছেন এ  পুরস্কার। তরুণ ক্যাটাগরিতে ‘সোনার নাও পবনের বৈঠা’ উপন্যাসের জন্য মো. সাজেদুল ইসলাম পুরস্কারটি জিতে নিয়েছেন। ‘ঘুমিয়ে থাকা বাড়ি’ পা-ুলিপি পুরস্কার পেয়েছেন সাকিব মাহমুদ।

প্রথম দিন ফিতা কেটে ঢাকা আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবটি উদ্বোধন করেছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি, নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহ, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, অমিতাভ ঘোষ। ব্যবস্থাপকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ, আহসান আকবর ও সাদাফ সাজ। তার আগে মঞ্চে পরিবেশিত হয় অনবদ্য এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এই নিবন্ধের লেখক হিসেবে স্পষ্ট করে বলতে চাই, সবকটি অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য হয়নি। একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রাঙ্গণে/কক্ষে ভিন্ন ইভেন্ট থাকায় অনেক অনুষ্ঠান মিস করেছি। তবু বলব এ রকম জমজমাট সাহিত্য আসর প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হোক। আমাদের সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ আরও বাড়ানো হোক এবং তা বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম কিংবা সাঁকো নির্মিত হোক- এই উৎসবে ঘুরে ঘুরে এমনটি চেয়েছি মনে মনে, বারে বারে।

×