ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওমর আলীর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

আশরাফ পিন্টু

প্রকাশিত: ২১:৩০, ৫ জানুয়ারি ২০২৩

ওমর আলীর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

ওমর আলীর কাব্য-কবিতায়

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালির যে স্বাধিকার চেতনার সূত্রপাত ঘটেছিল সেই চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে ১৯৭১ পর্যন্ত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা অর্জন একুশের চেতনারই এক সফল প্রতিসরণ। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের রয়েছে অসামান্য অবদান। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে কাব্য কবিতায় স্বদেশ প্রেমের যে অকৃত্রিম স্ফুরণ দেখা যায়, তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেরই ফল। এই মুক্তিযুদ্ধের ফলেই সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র ধারা বিকাশ ঘটে, যা এ দেশের মা-মাটি-মানুষের কথা বলে।
ওমর আলীর কাব্য কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের এক সুনিপুণ আলেখ্য চিত্রায়িত হয়েছে। তার প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই রয়েছে মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা। এছাড়া ‘‘স্বাধীনতার কবিতা” শিরোনামে তার একটি স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। এসব কবিতায় পাওয়া যায় স্বদেশ প্রেমের উপলব্ধির সচকিত উচ্চারণ-
পান্তাভাত পেঁয়াজ কাঁচামরিচ অথবা আগুনে পোড়ানো
শুকনো লালমরিচ আর একটু ফ্যাঁকসে লবণ
পরিতৃপ্তি এই তো আমার বাংলাদেশ
কমদামি তাঁতের শাড়ি ছাপাকাপড় গ্রীষ্মের দুপুরে
বাঁশ বাগানের সুশীতল ছায়া আম নিম কাঁঠাল গাছে 
জাম গাছে পেয়ারার ডালে সুকণ্ঠ পাখি দিনভর...
(পান্তাভাত কাঁচামরিচ এই তো আমার বাংলাদেশ)
স্বাধীনতা কি? সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার প্রকৃত সংজ্ঞা জানে না। তারা-
খুব একটা বেশি কিছু চায়না কারো কাছে
দোচালা ঘরের ডোয়াগুলো মাটি ও গোবর
পানিতে গুলিয়ে পাট মুঠো করে দু-চারদিন পরেই মসৃণ শুধু লেপা
উঠোনে খোলা চুলোয় অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে
 দুটো চালসিন্ধকরা লবণ মরিচ দিয়ে শাকভাজা 
(আয়াতুন নেসার স্বাধীনতা)

কিন্তু এমন অকৃত্রিম স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। তারা এ দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে এতটুকু শান্তিতে থাকতে দিতে চায়নি। তারা-
যাকে তাকে মারছে ঘরদোর দিচ্ছে পুড়িয়ে লুটে নিচ্ছে 
নারীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ নরপশু দুর্বৃত্ত হানাদার 
পাকিস্তানিদের অত্যাচারের প্রতিশোধ ছাড়তে হবে নিয়ে
এদের বিবেকে বাঁধেনি মাসুম শিশুকেও হত্যা করতে আর ...
(বিজয় দিবসে উত্তরাকে)
এমতাবস্থায় কবি স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। এই অত্যাচার এই পরাধীনতা কবে শেষ হবে? এই দুঃসহ সময় কাটতে চায় না কিছুতেই। তাই সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ব্যথাতুর হতাশার সুর যেন বেজে ওঠে কবির কবিতায়-
আমি কি আমার স্বাধীনতা পাবো কোনদিন খাঁটি ও নিখাঁদ 
মনে হয়েছিল আর আমার ঠোঁটের সামনে ফুল ফুটবেনা।
সাদা দু’দিনের চাঁদ জুঁই বেলী মল্লিকা ধুতরা কোনোদিন 
আমার পায়ের নিচে সেই প্রিয় পথ থাকবেনা চিরচেনা
গ্রীষ্মের মাঠের মধ্যে আর কি ডাকবে সেই বিটপি প্রাচীন
আমার শহর গ্রাম মনে হয়েছিল ছেড়ে যাচ্ছি শেষবার 
দিনের আলোতে ভয় আর রাতের ভূতের ভয়াল অন্ধকার।
(আমি কি আমার স্বাধীনতা পাবো)
কিন্তু বাঙালি ভীতু জাতি নয়, বীরের জাতি। শত অত্যাচারেও তারা দমবার পাত্র নয়। তারা মনোবলকে সুদৃঢ় করে নিজেদের তৈরি করে। বৃদ্ধ তরুণ যুবক সকলেই স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয়। কিন্তু অত্যাচারিত মজলুম জনতার হাত রিক্ত এমনি একজন জনতার দীপ্ত উচ্চারণ-
আগ্নেয়াস্ত্র নেই, ছুরি নেই, বেয়োনেট নেই,
আমার ওসব কিছুই নেই
আমার একটাই অস্ত্র আছে
অভিশাপ।
আমার বিশ্বাস
তুমি বলতে পার- অন্ধবিশ্বাস
এ অস্ত্র থেকে পাবেনা রেহাই
এবং হবেনা কথার খেলাপ 
এই মারণাস্ত্রে ঠিকই ধ্বংস হবে
মূর্তিমান পাপ
আমার একটাই অস্ত্র আছে
অভিশাপ। 
(অভিশাপ)
শুধু অভিশাপ নয়, যুদ্ধে জেতার জন্য সশস্ত্র্র সংগ্রামেরও প্রয়োজন হয়; প্রয়োজন হয় সম্মুখ সমরের । আর এ জন্যই আমাদের তরুণ যুবকরা সংশপ্তক মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার পাক সেনাদের ওপর। ফলশ্রুতিতে আসে আমাদের মহান স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের চরম বিজয়-
আমরা আগুনের ক্রুদ্ধ  মুঠো ছুঁড়ে দিয়েছিলাম
হানাদারদের মুখে তাদের বাধ্য করেছিলাম নতমস্তকে
আত্মসমর্পণ করতে রেসকোর্স মাঠে
এইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চরম বিজয়
আমরা বন্দুকের নলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম
স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা প্রথম বিজয়ের গর্বিত পতাকা
উত্তরা তার অভিমন্যুকে হারিয়েছে চিরকালের মতো ঠিকই 
কিন্তু কত উত্তরা আজ সুখী সংসারে অভিমন্যুকে নিয়ে ...
ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত আর অজ¯্র মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম সে স্বাধীনতার স্বাদ কি প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারছি? নাকি ফিরে যাচ্ছি সে পাক হানাদারদের চিরচেনা হত্যা জুুলুম আর অত্যাচারের দিকে! বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট যেন পাওয়া যায় “বিপদাপন্ন স্বাধীনতা” শিরোনামের কবিতাটিতে-
স্বাধীনতা স্বাধীনতা বিপদাপন্ন স্বাধীনতা দাকোপে 
সুন্দরবনে আগুন বাঘের মুখে চিত্র হরিণ
ছুটছে ছুটছে ছুটছে ভয়ে অরণ্য কাঁপিয়ে 
দ্রৌপদী ছুটছে আর দাকোপের যুবতী রহিমা পালাচ্ছে সম্ভ্রম প্রাণ নিয়ে
একদল রক্তলোপী মাংসলোভী তেড়ে আসে স্বপ্নে জাগরণে রাতদিন 
বিপদাপন্ন স্বাধীনতা সুন্দরবনের চিত্র হরিণ 
বৃত্রাসুর দৈত্যরা দখল করে ঢাকা ও পাবনা শহরের অলিগলি
কমল শিশুর মাংস পোরে ইস্পাতে পুড়িয়ে 
দীর্ঘ চুল দাঁড়ি আর সাধু-সন্ত মানুষকে ক্রুশে 
বিদ্ধ করছে মচ্ছবে দিচ্ছে নরবলি।...

ওমর আলীর কাব্য-কবিতায় ঐতিহ্য চেতনা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে; কখনো সচেতন ভাবে, কখনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কবিতায় তিনি ইতিহাস চেতনার যে চিত্র ও ভাষা নির্মাণ করেছেন তা অনন্য। লোক-ঐতিহ্য ব্যবহারে তিনি আরো অগ্রগামী। তিনি লৌকিক জীবনকে পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করেছিলেন। গ্রামে আজন্ম নিমগ্ন থেকেই তিনি কবিতা লিখেছেন। ফলে, তাঁর কবিতার শরীর হয়ে উঠেছে লোক-উপাদানে ঋদ্ধ ও পরিপুষ্ট। যে কোনো পাঠক তাঁর কবিতা পড়ে খুঁজে পাবেন গ্রাম ও লোকজীবনের প্রকৃত স্বাদ। এ প্রসঙ্গে কবি ও গবেষক মজিদ মাহমুদের উক্তিটি স্মর্তব্য-” নিশ্চয়ই এ বিশ্বাস আমার আছে, যদি ভাবিকালে কোনো কবি কিংবা পাঠক ওমর আলীর কাব্য নিসর্গে ভুলে ভ্রমণ করতে যান, তাহলে সত্যিই তার ইতস্তত, বিক্ষিপ্ত, রোপিত প্রতীক বৃক্ষরাজি ও উজ্জ্বল লোকজীবনে মোহিত না হয়ে পারবেন না।”

×