ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নান্দীমুখের নাট্যোৎসব

অপূর্ব কুমার কুন্ডু

প্রকাশিত: ০১:৪০, ২৫ নভেম্বর ২০২২

নান্দীমুখের নাট্যোৎসব

.

অর্থনৈতিক মন্দা, বিশ্বজোড়া অস্থিরতা, করোনা পরবর্তী ধীরলয়ে হেঁটে চলা প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় যখন একটু গভীর নীরবতা তখন সরবে, উচ্ছ্বাসে, উৎফুল্লতায় নাট্য সমুদ্রে প্রথম ঢেউটি তুলল সমুদ্র তীরবর্তী চট্টগ্রামের বলিষ্ঠ, দক্ষ, প্রাণবন্ত, চৌকস একঝাঁক নাট্যকর্মী-নাট্যমোদী -নাট্যানুরাগী দর্শক-শ্রোতা। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী নাট্যদল নান্দীমুখের প্রাণ পুরুষ, অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক অভিজিৎ সেনগুপ্তের নিরবচ্ছিন্ন কর্মস্পৃহা, বিশ্বজনীন সংযোগ তৈরির অবিশ্বাস্য পারঙ্গমতা, নাট্যকর্মীদের সম্মানজনক আতিথেয়তায় আদৃত করার মানবিক প্রবণতার এক অমোঘ প্রচেষ্টা এবং প্রাপ্তীর ফল চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গত ১৭ নভেম্বর থেকে আরম্ভ হয়ে আগামীকাল ২৬ নভেম্বর সমাপ্ত হতে চলা দশ দিনব্যাপী ‘নান্দীমুখ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০২২’।
নাট্যোৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নান্দীমুখের দলীয় প্রধান এবং উৎসব সমন্বয়কারী অভিজিৎ সেনগুপ্তের সভাপতিত্বে উৎসব উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চেয়ারম্যান কর্মবীর লিয়াকত আলী লাকী। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজ বিজ্ঞানী এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন নাট্যগবেষক আশীষ গোস্বামী এবং চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বাবু। সম্মানিত অতিথিদের বক্তব্যে উৎসব আয়োজনের ধারাবাহিকতায় নবম বারের মতো এই আয়োজন গুরুত্ব-সৌন্দর্য্য-বিশ্বভাতৃত্বের জয়গানে কতটা প্রাসঙ্গিক, সেটা যেমন ছিল প্রজ্জ্বলিত মঙ্গলালোকের মতো বর্ণিল, তেমনি লিয়াকত আলী লাকীর কণ্ঠে জাপানি সুর-তাল-লয়ে জাপানি সংগীত উপস্থাপন ছিল, জাপানী নাট্যকর্মীদের কাছে সূর্যোদয়ের দেশের স্বকীয়তার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা-শ্রদ্ধা এবং আতিথেয়তা আছে- ছিল এবং থাকবে অমলিন।
অমলিন না বরং ক্ষমতায় যেতে ক্ষমতাধর মানুষের পাশের মানুষরা কতটা এবং কিভাবে রূপ বদলাতে বদলাতে এক সময় সম্পূর্ণ হয়ে যায় অচিন, সেটাই করে দেখাল গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটক মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে। কামনার প্রার্থনাকে প্রেম কিভাবে ব্যাকূলতায় রূপান্তর করে দুটো মানব-মানবীকে করে তুলল চির প্রবহমান তারই মর্মমূলে পৌঁছাল লোক নাট্য দলের মঞ্চায়ন ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’। বিশ্বজুড়ে অজস্র মানুষ যে বাস্তুহারা তাদের বাঁচাতে এবং নিজেদের বাঁচতে পরস্পর  হাতে হাত ধরাটাই যে সর্বজনীন বাস্তবতা, সেকথাই  বোঝাল জাপানের নাট্যদল থিয়েটার গ্রুপ গাম্বো তাদের মঞ্চায়ন ‘টিরুম অন দ্য বর্ডার’। বিরক্তিকর অপেক্ষা করাকে অনেকটাই আনন্দদায়ক করার চেষ্টা করল ডানকুনির থিয়েটার শাইন তাদের মঞ্চায়ন ‘অপেক্ষায় অপেক্ষায়’।

দারিদ্র্র্যতার অভিশাপে অভিশপ্ত মানবের করুণ আর্তনাদ গগনবিদারী চিৎকারে জানান দিয়েছে নাট্যদল সবার পথ এর মঞ্চায়ন ‘শীতলপাটি’। চিৎকার না ধিক্কার, মায়া কান্না না অশ্রু দানা,  অভিনয় না বাস্তব, প্রাপ্তি না দুর্গতি, স্বীকৃতি না আত্মাহুতি, বলিদান না উৎসর্গপ্রাণ কি ছিল অভিনেত্রী বিনোদিনীর যাপিত জীবনে, তা যেন আগুন ফলবান হয়ে মঞ্চ মাতাল নান্দীমুখ তাদের প্রযোজনা ‘আমার আমি’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। নিঃসঙ্গতার দহনে দগ্ধ হয়ে চলা রাগনার নামের মানুষটি কিভাবে অপর মানুষটিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পেরে পেয়ে যায় জনঅরণ্যের সান্নিধ্য, সে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলে সুইডেনের নাট্যদল লোটা গার্টন। সমাজ-পরিবার দ্বারা পরিত্যক্ত-তাড়িত মানুষের জীবন বাস্তবতা কতটা নিদারুণ তার এক মর্মচিত্র তুলে ধরে ম্যাক্সিকোর একিকেলিমা টিটরো। নদীর জলে ডুবতে ডুবতে মনোজগতে কোমায় পৌঁছে যাওয়া লিম্বো নামের মানুষটির মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠা অতীত-বর্তমান আর রূঢ় ভবিষ্যৎ বাস্তবতার এক মরমীয় আখ্যান স্পেনের নাট্যদল লা টুরবা কোম্পানির মঞ্চায়ন ‘ভেজিটেরিয়ান ওফেলিয়া’। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার রূপ এবং রঙ কত তীক্ষè থেকে তীক্ষèতর আজ শুক্রবার তা দেখাবে কলকাতার নাট্যদল থিয়েটার প্লাটফর্ম। আগামীকাল সমাপনীতে বারাসাত কাল্পিক ‘ওয়ার্ড নং-৬’ নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তুলে ধরবে অস্থির দোদুল্যমান এই সময়ে মনের রোগ সারিয়ে তুলতে মানবিক মানুষের প্রয়োজনটা কতটা অনস্বীকার্য।
স্বীকার্য সত্য রিও নিশিহারা, আশিষ গোস্বামী, অনির্বাণ সেন, শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জিতা মুখার্জী, অভীক ভট্টাচার্য্য,  লোটা গার্টন, রিচার্ডো মেনা রোসাডা, কারলোটা বার্জেল, সলিল সরকার, দেবাশীষ রায়, দেবব্রত ব্যানার্জী প্রমুখ নাট্যজন পরিচালিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, দলীয় নাট্যকর্মীদের অংশগ্রহণে প্রতিদিনকার মাস্টার্স ক্লাসগুলো ছিল ভাবনার আদান-প্রদানে সংস্কৃতি বান্ধব, দৈনিক-মানসিক চরিত্র নির্মাণে গঠনমূলক, নাটক পাঠ এবং দেখার কল্পনা সহায়ক। তবে বিগত দুটি হয়ে যাওয়া সেমিনার এবং আজ শুক্রবার হতে চলা সেমিনার বিষয়ে দীর্ঘ বিশ্লেষণ না করেও শুধু বলা, প্রথমদিনের সেমিনারের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকীর বিশ্বাসের উচ্চারণই হোক আগামীর বাস্তবায়ন, ‘আমরা পিছনে তাকাব কিন্তু পিছনে যাব না’। পিছনে তথা পশ্চাৎমুখী যে কারও লক্ষ্য না তার নির্দশন তো অভিজিৎ সেনগুপ্তের ভাবনা ও পরিকল্পনায় প্রকাশিত, যেখানে নাটক শেষে মঞ্চায়নের দল শীতকালীন উপযোগী ভারী চাদরের আদলে উত্তরীয় বস্ত্র, ক্রেস্ট প্রভৃতি পাচ্ছেন আগামী দিনের দলের নাট্য নির্দেশকের হাত থেকে। আর প্রতিদিনই তো একাডেমি প্রাঙ্গণের অনুরুদ্ধ মঞ্চে দীপ্তা রক্ষিত লাভলীর সঞ্চালনায়  চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক মানের শিল্পীরা গান পরিবেশন করছেন, যেন যথাযথ বন্দনায় শুরু হতে পারে নাটকের যথাযথ মঞ্চায়ন।

শ্রদ্ধাভাজন রবিউল আলম, শিশির দত্ত, প্রদীপ দেওয়ানজী, ম. সাইফুল আলম চৌধুরী, অসীম দাশদের মতো প্রমুখ নাট্য ব্যক্তিদের  নিয়মিত উপস্থিতিতে  এবং ভারতীয় হাইকমিশন, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ইস্পাহানি, এইচএসবিসির সার্বিক সহযোগিতায় সেকাল-একাল ও ভাবিকালের পথচলায় সমুদ্র বিধৌত, পাহাড় পরিবৃত, সমতলে অবস্থিত চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত নান্দীমুখ  আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০২২ যেন সুর-স্বর-লয়-তালের বহমান প্রবাহ ধারায় বিশ্ব ভাতৃত্বের  জয়গাথা রংধনুর সপ্তরঙ্গে চৌদিকে মাতিয়ে রয়।

 

×