ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ প্রিয় জার্সি

রহমান ঘরামী

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ৩ নভেম্বর ২০২২; আপডেট: ২০:৫৩, ৩ নভেম্বর ২০২২

গল্প ॥ প্রিয় জার্সি

মুহিত আর স্বপ্না একজন আরেকজনকে ভালোবাসে

মুহিত আর স্বপ্না একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। মুহিতকে শুধু ভালোই বাসে না স্বপ্না, বলা যায় সবচেয়ে বেশি নির্ভরও করে। তবে একটা কারণে মুহিতের সঙ্গে এখন রোজই ঝগড়া হচ্ছে স্বপ্নার, কারণটা আর কিছু নয় বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বকাপে ওরা দুজন ভিন্ন দলের সমর্থক। স্বপ্না আর্জেন্টিনার সমর্থক আর মুহিত ব্রাজিলের। মুহিত সারাদিন হলুদ রঙের জার্সি পরে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়।
একদিন কথা বলছিল ওরা দুজন। এ কথা সে কথা শেষে উঠলো খেলার কথা। স্বপ্না বললো  এই তোমার কী আর কোনো শার্ট বা টি-শার্ট নাই। প্রত্যেকদিন এই শর্ষে ফুল মার্কা টি-শার্টটা পরে ঘুরে বেড়াও কেন?
কী বললা? এইটা শর্ষে ফুলমার্কা টি-শার্ট?
হলুদ যখন শর্ষে ফুল তো বলাই যায়, তুমি কী বলো? শীতল গলায় জবাব দিলো স্বপ্না। বুঝি না ব্রাজিলিয়ানদের এই রুচিবোধের আকাল কেন হলো? যে দেশে বিশ্বের ফুসফুস নামে পরিচিত আমাজন জঙ্গল, সে দেশের জার্সিতো হওয়ার কথা সবুজ।
শোন, এই হলুদ হচ্ছে ফুলের প্রতীক। আমাজনে যখন ফুল ফোটে তখন যে হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে সেই প্রতীক। জানো তো বেশিরভাগ বুনো ফুলই হলুদ হয়!
ব্যাখ্যাটা ওর নিজের বানানো, আকস্মিক এ ধরনের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোয় কৃত্রিম একটা হাসি ফুটে উঠলো মুহিতের মুখে।
যে ফুলই হোক তুমি কাল থেকে এই কটকটে হলুদ জার্সি পড়ে আমার সামনে আসবা না।
তাহলে তো আগামীকাল থেকে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না!
কেন?
এই যে তুমি ব্রাজিলের টি-শার্ট পরে তোমার সামনে আসতে মানা করলা। ঠিক আছে আসবো না। উঠতে শুরু করলো মুহিত। স্বপ্না ওর হাত টান দিয়ে আবার বসিয়ে দিলো। আরে ঠিক আছে, না হয় হলুদের প্রেমে পড়ে আমাকে বিসর্জন দিলে, কিন্তু আরেকটু সময় না হয় বসো।
তোমার সঙ্গে তো বসে থাকতেই চাই, কিন্তু ঝামেলা তো বাধায় ওই রাতটা আর ক্লাসগুলো!
মানে?
মানে আর কী? রাত আসে বলেই তো তুমি ঘরে ফিরে যাও, আর ক্লাস আছে বলেই না আমাকে মাঝে মধ্যে ক্লাসের বেঞ্চিতে বসে আকরাম স্যারের মতো মটকু কিন্তু ফ্যাসফ্যাসে গলার স্যারের কথা শুনতে হয়। রুবিনা ম্যাডামের ক্লাস হলেও না কথা ছিল, কত সুন্দর ম্যাডামটা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
এই তুমি কী বললে? তোমাদের না চোখ! কেউ রেহাই পায় না।
তাকানোর আর সুযোগ কোথায়? রুবিনা ম্যাডামের মেজাজ যদি দেখতে, সবাইকে ‘এই ছেলে’ ‘ওই ছেলে’ করে কথা বলে। তাও যা গলা ঠিক যেন বাঘিনী। তার দিকে তাকানো যায় না, দেখতে হয় চোরা চোখে।
শোনো উনি যদি শান্ত মেজাজের হতেন তাহলেই হতো, দেখা যেত, সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে রুবিনা ম্যাডাম, এটা মনে করে তোমরা সবাই তার রুমের সামনে লাইন ধরতে।
শোনো, অমন সুন্দর ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে লাইন ধরে অপেক্ষা করতেও রাজি।
তাই, তাহলে যাও, গিয়ে লাইনে দাঁড়াও, তোমার রুবিনা ম্যাডামের রুমের সামনে, আমি চললাম।
আরে আরে উঠছো যে, রাগ করলে নাকি?
না, রাগ করিনি, রুবিনা কেন, শাবানাও তোমার নজর কাড়তে পারবে না সে আমি জানি।
স্বপ্না চোখের আড়াল হতেই মুহিত গায়ের জার্সিটার দিকে তাকালো ও, কোনো দূর ব্রাজিলের এই জার্সিটার কি অসামান্য ক্ষমতা, কত ভালোলাগা মিশে আছে এতে, ব্রাজিল নামটা ওর মতো আরও কোটি কোটি মানুষের মনে গাঁথা। একই কথা আর্জেন্টিনার বেলায়ও।

আর্জেন্টিনার প্রতি বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই মুহিতের, তবে স্বপ্নার দল বলে কেন জানি খানিকটা সহানুভূতি আছে দলটির প্রতি, বিশেষ করে গত বিশ্বকাপে যখন ওরা ফাইনালে ওঠে তখন মুহিতও চেয়েছিল হোক না স্বপ্নার স্বপ্ন পূরণ।
রাতে পড়ার টেবিলে বসা স্বপ্না। বেজে উঠলো মোবাইল ফোন, মুহিত কল করেছে।
বলো, কল রিসিভ করে বললো স্বপ্না।
কি এখনো মেজাজ খারাপ করে বসে আছো।
হ্যাঁ।
তো মেজাজ ভালো করার জন্য কী করতে পারি?
তুমি পারবে না।
একশ’বার পারবো।
পারবে?
হ্যাঁ পারবো।
সত্যি সত্যি পারবে?
তোমাকে একশ’টা পারতে হবে না, একটা পারলেই চলবে।
পারবো, সত্যি সত্যি পারবো। এই দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি আমাকে কি পারতে বলছো!
জানতাম তুমি পারবে না।
তুমি তো বলোইনি, কি পারতে হবে।
তার আগেই তো তোমার গলা ধরে এসেছে।
আচ্ছা বলো তো, তুমি কি বলতে চেয়েছো, আমি যা ধারণা করছি তা কি-না।
আমার ধারণা, তুমি যে ধারণা করছো তা ঠিক।
আমাকে ব্রাজিলের জার্সি পরতে মানা করবে, এইতো!
তুমি দেখছি আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে জ্ঞানী হয়ে উঠছো।
কিন্তু তুমি হয়ে উঠছো একটা বোকার হদ্দ।
হ্যাঁ সঙ্গদোষ আর কী! ঠিক আছে, বাদ দাও। এখন বলো ফোন করেছো কেন?
কাল আসবে ক্যাম্পাসে?
ঠিক নেই, আসতে পারি, নাও পারি।
হেয়ালি রাখো, আসবে কি না বলো।
আসবো, কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না।
মানে কী?
মানে আবার কী? মানে হচ্ছে শর্ষে ফুল।
ও তাই!
হ্যাঁ তাই।
রাখি বলে মোবাইলটা রেখে দিলো স্বপ্না, তার ভাবনা জুড়ে আবার মুহিত। সত্যিই কী সে কাল ক্যাম্পাসে যাবে না, মুহিতের সঙ্গে দেখা হবে না। স্বপ্না জানে, এটা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে না, ও ক্যাম্পাসেও যাবে, মুহিতের সঙ্গে দেখাও হবে। কিন্তু ওর গা থেকে ব্রাজিলের জার্সিটা খোলা যায় কীভাবে?
বই খুলে পড়তে শুরু করলো স্বপ্না। পড়ছে কিন্তু তাতে মন বসছে না, মুহিতের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে মুহিতকে ব্রাজিলের জার্সি ছাড়া আর কোন পোশাকে কল্পনায় আনতে পারছে না স্বপ্না, ওকে কল্পনা করতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্রাজিলের জার্সি পড়া মুহিত।
পরেরদিন ক্যাম্পাসে গেল স্বপ্না। আধা ঘণ্টার মতো একাই বসে থাকলো আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে। মুহিতের জন্য অপেক্ষা করতে হলে এখানেই এসে বসে স্বপ্না। আজও এসে বসেছে সে, যদিও মুহিতকে বলে দিয়েছে ওর সঙ্গে দেখা হবে না, কিন্তু তারপরও কিভাবে আর কেন যেন এসে প্রতিদিনকার ওই জায়গাটাতে এসে বসলো স্বপ্না। বান্ধবীদের দুই একজন যাওয়ার সময় হাস্যোজ্জ্বল টিপ্পনি কাটলো ‘এখনো আসে নাই’!
স্বপ্নার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, মুহিত কি আসবে না! একটা ফোনও তো করতে পারে। এমন সময়ই সেখানে এসে হাজির মুহিত, গায়ে সেই কটকটে জার্সি আর মুখে সারল্য মিশ্রিত হাসি।
এতক্ষণ স্বপ্নার মনে কি যেন একটা অভিমান জমা হচ্ছিলো, মুহিতকে দেখে কোথায় উবে গেল সে অভিমান।
এই তুমি আসছো, সেই কটকটে হলদে পড়ে, তোমাকে না বলেছি, এই সরিষা ক্ষেত বাদ না দিতে পারলে আমার কাছে আসবে না।
সত্যি বলছো আসবো না।
না, আসবে না।
ঠিক আছে, আজ যখন এসে পড়েছি, আজ কিছু সময় থাকি, কাল না হয় আবার সময়মতোই এসে পড়বো।
বেশি কথা বললে, আমি কিন্তু উঠবো। আরও কিছুক্ষণ কথা বললো দুজন, তারপর স্বপ্নাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আবার টিএসসিতে এলো মুহিত, ও থাকে হলে, আজ ক্লাস না থাকায় একটা পর্যন্ত রুমেই ছিল সে। এখন ওর কোনো কাজ নেই, টিএসসিতে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হলবাজি করা ছাড়া।
মুহিতের শরীর থেকে ব্রাজিলের জার্সি খোলাটাকে একটা চ্যালেঞ্জের মতো মনে হচ্ছে স্বপ্নার কাছে। কিন্তু মুহিত তো এর কথায় কোনো গা-ই করছে না। ঘরের মধ্যেই পায়চারি করতে লাগলো স্বপ্না। হঠাৎ সে নিজেই বলে উঠলো ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’- হ্যাঁ পেয়েছি, এবার আর তোমার উপায় থাকবে না বাছাধন। সে মুহিতকে ফোন করতে মোবাইল হাতে নিয়েও কল দিলো না, না আরও দু’একজনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। ও ফোন করলো ঝর্ণাকে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ঝর্ণা বললো, আইডিয়াটা নাকি ‘ইউনিক’ এই ওষুধে কাজ হবে!
মোবাইল তুলে সে কল দিলো মুহিতকে।
কল রিসিভ করে মুহিত বললো, এই অসময়ে ফোন করলে যে!
তোমার বারোটা বাজাতে!
তাই নাকি?
আমি সত্যি সত্যি তোমার সঙ্গে কাল থেকে দেখা করছি না।
সে কালই দেখা যাবে।
দেখা হতে পারে এক শর্তে বললো স্বপ্না।
একটা বাদে সব শর্ত মানতে রাজি, জবাব মুহিতের।
না তোমাকে আর ওই সরশে ক্ষেত নিয়ে আমি জ্বালাবো না।
তাহলে?
শোনো।
বলো।
মন দিয়ে শুনবে।
হ্যাঁ মন দিয়ে শুনছি।
তোমার সঙ্গে আমার দেখা হতে পারে, তুমি যদি পরশু তোমার সবচেয়ে প্রিয় জার্সি পড়ে আমার সামনে আসতে পারো।
পরশু কেন? কালই আসতে পারি, তুমি বললে এখনি আসতে পারি।
না, এখন আসতে হবে না, কালও না, তোমাকে আসতে হবে পরশু এবং পড়তে হবে সবচেয়ে প্রিয় জার্সি। আর শোনো পরশু আমার ভূগোলের একটা ক্লাস আছে, একটায়। তুমি শহীদ মিনারের ওখানে থেকো।
আর কথা বাড়ালো না স্বপ্না, লাইনটা কেটে দিলো।
মুহিত ভাবতে লাগলো হঠাৎ করে এমন কী হলো যে স্বপ্না ওর ভোল পাল্টে ফেললো, ‘প্রিয়’ দলের জার্সি পড়ে ওকে পরশু যেতে বললো। ওর ভাবনার জগতে ভর করলো আরেকটা চিন্তা, হঠাৎ করে স্বপ্না কেন ব্রাজিলের দলের ব্যাপারে এত নমনীয় হলো? এর ভেতরে অন্য কিছু নেই তো!
পরের দিন ক্যাম্পাসে এসে দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বললো মুহিত, ব্রাজিল সমর্থন করে এমন দু’একজন বন্ধু বললো, মেয়ে মানুষের মন, নরম। হয়তো তোর ব্রাজিলপ্রেমের কারণে হার মেনেছে তোর আর্জেন্টিনাপ্রেমী প্রেমিকা। আর্জেন্টিনার সমর্থন করে এমন একজন বললো, ‘এহোনো বোঝো নাই, প্রিয় মানুষের দল মানেই তো প্রিয় দল, মানে স্বপ্না চায় তুমি তার দল মানে আর্জেন্টিনার জার্সি পরো।
কোনো জবাবই যুতসই মনে হলো না মুহিতের, তার মনে হচ্ছে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে, স্বপ্নার এ কথার অন্য কোনো অর্থ আছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না, নিজের গায়ে চাপানো ব্রাজিলের জার্সিটার দিকে তাকালো, মুহিতের মনে হচ্ছে সে চোখে শর্ষে ফুল দেখছে!
মুহিতের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো, সে ভাবছে তাকে এ কেমন ধন্দের মধ্যে ফেললো স্বপ্না।

হঠাৎই তার মনে হলো বিষয়টা নিয়ে মামুন ভাইর সঙ্গে কথা বলা যায়, মামুন ভাই বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, ভালো বিতার্কিক হিসেবেও পুরো ক্যাম্পাসে তার একটা পরিচিতি আছে। মামুন ভাই নিশ্চয়ই এ কথার একটা ভালো সমাধান দিতে পারবেন।
ফোন করে মামুনের অবস্থান জেনে সেখানে গেলো মুহিত।

সব শুনে মামুন বললেন, বিষয়টা একটু জটিলই মনে হচ্ছে, তবে এটুকু বুঝতে পারি তোমার আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের বন্ধুরা যা বলছে বিষয়টা অমন নয়, আর আমি তো ইতালির সমর্থক, এবার তো তারা বিশ্বকাপেই নেই, তাই তোমাকে ইতালির জার্সি পড়তে বলেও লাভ নেই।
মামুন ভাই, এটা আমার জীবন-মরণ সমস্যা, দুষ্টামি না করে বলুন তো স্বপ্না আসলে কি বুঝাতে চেয়েছে?
আরে বলবো, একটু তো ভাবতে দেবা, আমার বুদ্ধিতে একটা কিছু করলা, সেইটা হইলো না শেষে তোমার বান্ধবীর কাছে আমি ‘বুদ্ধু’ সাজি আর কী! টিএসসির সামনে গিয়ে চা নিলেন মামুন আর মুহিত।
হঠাৎই মামুন বললেন, আমি বোধ হয় কিছুটা ধরতে পেরেছি।
তাই নাকি! কি মামুন ভাই?
তোমাকে কি পড়তে বলেছে?
প্রিয় দলের জার্সি
না, বললেন মামুন
হ্যা, প্রত্যুত্তর মুহিতের।
তোমাকে পড়তে বলেছে ‘সবচে প্রিয় জার্সি’।
চুপ করে গেল মুহিত, কথা সত্য। এমন করে ভাবেনি সে। ‘প্রিয় দলের জার্সি’ আর ‘প্রিয় জার্সি’। একটা পার্থক্য তো আছেই।
আর তোমাকে যেতে বলেছে কোথায়? যেতে বলেছে শহীদ মিনারে, নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিলেন মামুন।
কিছু বুঝেছো?
মুহিত, চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিলো, ওর মুখে হাসির ঝিলিক, বুঝেছি।
সত্যি বুঝছো?
হ্যাঁ মামুন ভাই, আপনার কথাটার অর্থ আমি ধরতে পেরেছি।
বুঝলেই ভালো, আচ্ছা আমাকে বলো কি বুঝেছো, পরে না কমলাকে গামলা বানিয়ে ফেলো।
মুহিত যা বুঝেছে, তা চুপি চুপি মামুনকে বললো।
মামুন, হেসে দিলেন, বললেন আরেক কাপ চা, তোমার পাওনা হয়ে গেছে।
দুজনেই আরও এক কাপ করে চা খেয়ে চলে গেলো।
রাতে আবার স্বপ্নাকে ফোন করলো মুহিত, ফোন বাজছে কিন্তু ধরছে না।
আবার কল দিলো মুহিত।
এবার স্বপ্না ফোন ধরলো, ধরে শুধু বললো, দেখা হচ্ছে কাল দুপুর ২টায়, শহীদ মিনারের সামনে।
মুহিত কোনোরকমে শুধু বললো ‘প্রিয় জার্সি পড়ে’।
আরও কয়েকজনকে ফোন করলো মুহিত, সবাইকে কিছু কথা বললো সে।
রাতে ঘুমটা ভালোই হলো মুহিতের, সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। এগারোটায় একটা ক্লাস আছে। তৈরি হয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বের হলো সে।
ক্লাস শেষে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে সে আবার রুমে ফিরলো।
একটার দিকে, রিকসায় করে ও রওনা দিলো শহীদ মিনারের দিকে, ব্রাজিলের হলুদ জার্সিটা ওর গায়ে। সেখানে আগেভাগেই উপস্থিত ছিল মুহিতের আরও বেশ ক’জন বন্ধু। মুহিতের বন্ধুদের ক’জন বন্ধুও এসেছে কারও গায়ে ব্রাজিলের জার্সি, কারও গায়ে আর্জেন্টিনার।
দুপুর ২টা বাজে, স্বপ্না এখনো আসেনি। মুহিতের হাত-পা কাঁপছে। স্বপ্নার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কখনো এমন লাগেনি ওর। স্বাভাবিক থাকতে এ আধঘণ্টার মধ্যে তিন কাপ চা খেলো।
খানিক পরেই একটু দূরে দেখা গেল স্বপ্নাকে। সঙ্গে ওর বন্ধু ঝর্ণা আর মিতা।
শহীদ মিনারে আসতেই স্বপ্নার সামনে এসে দাঁড়ালো মুহিত।
স্বপ্নার মনটা খারাপ হয়ে গেলো, চোখে মুখে নেমে এলো রাজ্যের হতাশা। মুহিত কী তার কথার অর্থ বুঝতে পারেনি!
‘প্রিয় দলের জার্সি পরে এসেছি’ বললো মুহিত।
তুমি, বুঝতে পারোনি, অস্ফুট উচ্চারণে বললো স্বপ্না।
বুঝেছি। দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বললো মুহিত।
না, তুমি বোঝনি, ঘুরে দাঁড়িয়ে যেতে উদ্যত হলো স্বপ্না।
আমি বুঝেছি, মুহিতের কণ্ঠ কানে বাজলো স্বপ্নার।
হঠাৎ স্বপ্না শুনলো পেছন থেকে সমস্বরে জাতীয় সংগীত গেয়ে উঠলো কয়েকজন।
স্বপ্না ঘুরে দাঁড়ালো।
এ কী দেখছে সে! অবাক বিস্ময়ে মুহিতের দিকে আগাতে লাগলো স্বপ্না।
মুহিত আর তার বন্ধু সবাই গায়ে পড়ে আছে, ‘সবচেয়ে প্রিয়’ জার্সি। লাল-সবুজের সেই জার্সিতে উজ্জ্বল সবার চোখ মুখ। স্বপ্না, ঝর্ণা আর মিতা এগোতে লাগলো। স্বপ্নার চোখে পানি, হাত দিয়ে পানি মুছে সে কান্না আড়ালের চেষ্টা করলো, মুহিত আর তার বন্ধুরা শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়ালো, স্বপ্না আর ওর দু’বান্ধবীও এসে দাঁড়ালো ওদের পাশে, গায়ের ওপর থেকে বড় করে দেয়া ওড়নাটা সরালো ওরা, ওদের তিনজনের গায়েও সবচেয়ে প্রিয় জার্সি।

স্বপ্নার কান্না বাঁধ মানছে না। সে নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করলো, একে একে সবার চোখে-মুখের দিকে তাকালো স্বপ্না আর মুহিত, ওরা খেয়াল করলো শুধু ওদের চোখেই নয়, সবার চোখেই পানি, আর সবার চেষ্টা চোখের সে পানি আড়াল করার, আর তাই কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে ওরা জোরে জোরে গাইতে লাগলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

×