ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

সংশপ্তক

জোবায়ের রাজু

প্রকাশিত: ০১:২১, ৭ অক্টোবর ২০২২

সংশপ্তক

সংশপ্তক

সংসারটা ঠিক আগের মতো থাকলেও বড়দার গুরুত্বটা ঠিক আগের মতো নেই। এই সংসারে মানবেতর জীবন যাপন করতে করতে সে দিন দিন হয়ে ওঠেছে অবহেলার পাত্র। এই সংসারের ওপর তার ন্যূনতম অধিকারটুকু দিনে দিনে হয়ে ওঠেছে কঠোর। তার চাওয়া পাওয়ার কোন দাম নেই এখানে।
অথচ আগে ছিল বড়দার বিপরীত জীবন। সেই যে ভোরে অফিসে বের হতো, ফিরতো মধ্যরাতে। ভাত বেড়ে মা তার বড় ছেলের অপেক্ষায় রাত জেগে বসে থাকতেন। যখন মাস শেষে মায়ের হাতে বড়দা তুলে দিত বেতনের কাড়ি কাড়ি টাকা, আত্মতৃপ্তিতে স্বস্তি পেতেন মা। দোয়া দুরুদ পড়ে ছেলেকে আশীর্বাদও করে দিতেন। কেননা মাস্টার্স পাস করা তার বড় ছেলে রোজগার করে। কোম্পানিও ভালো। প্রাইভেট কোম্পানি। এমন কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। সে ভাগ্য নিয়েই জন্মেছে বড়দা।
সাত বছর আগে আমাদের এই ছোট্ট পরিবারের ছোট ছোট স্মৃতির চিত্রপট চোখে ভাসছে। এক পড়ন্ত বেলায় বড়দার আনন্দিত গলার চিৎকারে আমাদের ছোট্ট ঘর ভারি হলো। রোজী আপা, আমি আর শ্যামা দৌড়ে এসে দেখি ড্রয়িংরুমে বড়দা মাকে জড়িয়ে ধরে হুল্লোড় গলায় বলছে-‘আমাদের দুখের দিন শেষ মা। আমার চাকরি হয়ে গেছে। ভালো বেতন।’
আনন্দের ধারা বয়ে গেল সেদিন আমাদের ঘরে। চুলোয় মা মোরগ পোলাও বসালেন। তৃপ্তি নিয়ে মায়ের বানানো অমৃত স্বাদের মোরগ পোলাও খেলাম আমরা সেদিন। বড়দা স্বচ্ছ গলায় মাকে বলল-‘সবই দেখি আমার প্লেটে দিচ্ছো। ওদের প্লেটে এত কম কেন?’ মা টু শব্দ না করে বড়দার প্লেটে মুরগির বড় বড় টুকরাগুলো দিতে লাগলেন।
দিন দিন অফিসমুখী হতে লাগল বড়দা। আমাদের চিরকালের অভাবের সংসারে সুখের জোয়ার আসতে লাগল। কাশেম কাকুর দোকানের বাকি খাতায় বাকির বোঝাটাও হাল্কা করে দিল বড়দা। বাজার সদাই কি জিনিস, যেটা আমরা কখনই আগে দেখিনি, বড়দা সেখানে বাজার থেকে বড় বড় মাছ ভর্তি ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরতো। মা মহা উল্লাসে মুগডাল দিয়ে বোয়াল মাছ রান্না করলে বড়দার প্লেটে উঠে যেত বোয়াল মাছের বিশাল মাথা।

কোন কোন দিন মাছের টুকরো প্লেটে নাড়াচাড়া করে মা নিরিবিলি চোখের পানি ঢালতেন। আমি আর শ্যামা অবাক হতাম মায়ের রহস্যময় আচরণে। তখনও বুঝতাম না আকাশের তারা হয়ে যাওয়া আমাদের দিনমজুর বাবা তার স্ত্রীকে সারা জীবন যে নিরামিষ খাইয়েছেন আর আজ সময়ের আবর্তে ছেলের আয়ের টাকায় বোয়াল মাছের টুকরো প্লেটে নিয়ে মা তার অতীতে ফিরে যান।
একদিন সাত সকালে গোয়ালা এলো দুধ নিয়ে। মা অবাক হয়ে বললেন-‘দুধ?’ গোয়ালা বলল-‘আপনার বড় ছেলে বলেছে রোজ দুধ দিয়ে যেতে। মাস শেষে টাকা দিবে।’
 সেই থেকে আমরা দুধ খাই। আমি, রোজী আপা আর শ্যামা আধা কাপ করে। বড়দা পুরো এক গ্লাস। শ্যামা মাকে বলল-‘বড়দাকে এক গেলাস দাও, আর আমাদেরকে এত কম কেন?’ মা ধমক দিয়ে বললেন-‘চুপ থাক। রোজগার তোরা করিস না। রতন করে। সে বেশি পাবে।’

অথচ রোজগার করার আগে বড়দাকে দেখতাম প্রতি শুক্রবারে তার ময়লাচ্ছন্ন জামাগুলো খুব কষ্ট করে ধুতে। চাকরি জীবনে যাওয়ার পর সে এই সাপ্তাহিক কাজ থেকে মুক্তি পেল। বড়দার জামা ময়লা হলেই মা তড়িঘড়ি করে সেটা ধুয়ে দেন। অথচ আমাদের জামা আমরাই কষ্ট করে ধুই। মা আমাদেরকে কোন রকম সাহায্য তো দূরের কথা, বরং গর্জে উঠে বলেন-‘এত ঘন ঘন কাপড়ে সাবান ঢলিস কেন? রুজি-রোজগার করিস নাকি?’
দিনে দিনে আমি দেখতে লাগলাম মায়ের ভালোবাসার নমুনা। আমাদের চার ভাই বোনকে তিনি স্নেহের তুলনায় শাসনটাই করেছেন বেশি। ছোটবেলায় দেখতাম বড়দার সাথে কারণে অকারণে মায়ের দ্বন্দ্ব লাগত। অথচ এখন বড়দা কর্ম জীবনে যাওয়ার পর তার ইনকামের টাকাগুলোর লোভে বড়দার কটূবাক্যেও মায়ের নীরব থাকার ভূমিকা সহসা চোখে পড়ে। স্নেহ আর ভালোবাসার সাথে এ এক অভিনব দুর্নীতি।
একদিন মাঝরাতে খারাপ সংবাদ নিয়ে বড়দা বাসায় এলো। তার মলিন মুখ দেখে মা বললেন-‘তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন রতন?’ বড়দা মলিন গলায় বলল ‘কোম্পানি তার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে লন্ডন চলে যাচ্ছে।’
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বড়দা বেকার হয়ে গেল। তার  কোম্পানি ব্যবসা চুকিয়ে বিদেশে চলে গেল। বড়দা হন্য হয়ে চাকরি খুঁজছে। কোথাও চাকরি পাচ্ছে না।
সংসারে আবার যখন আগের মতো অভাবের দৃশ্যপট সবাই দেখতে শুরু করেছে, তখনই অকল্পনীয়ভাবে আমার চাকরিটা হয়ে গেল ব্যাংকের ম্যানেজার পদে। কিন্তু বড়দার আর কোন গতি হল না। চাকরি নামের সোনার হরিণের সন্ধান পায়নি বলে দিন দিন মায়ের কাছে বড়দার গ্রহণযোগ্যতা কমতে লাগল। বড়দার কোন বিষয়কে আগের মতো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। কারণ তার চাকরি নেই। সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকে। মা বিরক্তি মাখা গলায় বলেনÑ‘এভাবে শুয়ে বসে থাকাটা অলুক্ষণে। যা বাইরে থেকে ঘুরে আয়।’ বড়দা নত গলায় বলেÑ‘টাকা নাই। টাকা দাও। তোমাকে যে টাকা দিতাম, সেসব কি করেছো?’ মা তেজী গলায় বলতে থাকেনÑ‘তোর সব টাকা আমি কলসিতে ভরে মাটিতে পুতে রেখেছি? সংসারের কাজে লাগাইনি? ফালতু কথা বলবি না শুয়োর।’ বড়দা আর কথা বাড়ায় না। কাঁথা গায়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে।
এই যে মা বড়দাকে ‘শুয়োর’ বলে গালি দিল, আমি নিশ্চিত বড়দার চাকরিটা থাকলে মা কখনও তার এই ছেলেকে এমন অসভ্য কথা বলতেন না।
সময়ের আবর্তে আমার ওপর মায়ের অন্যরকম এক টান বাড়তে লাগল। আগে আমি রোগে শোকে ভুগলেও সেদিকে মায়ের কোন ভ্রƒক্ষেপ থাকত না। আর এখন আমার সামান্য কাশি হলেই মায়ের হাঁকডাকÑ‘ডাক্তার দেখাস না কেন! এভাবে চলতে থাকলে তো যক্ষ্মা হবেরে। দোহাই বাপ, আজই ডাক্তার দেখা।’
আমার অবাক লাগে। আমাদের মা এত স্বার্থবাজ কেন!  কেন আমার প্রতি তার এই প্রকাশ্য ভালোবাসা! আমি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ ম্যানেজার বলে? অথচ বড়দার যে আজ তিনদিন যাবত জ্বর, মায়ের সে খেয়াল নেই। শুনেছি সন্তানদেরকে সমান ভাগে ভালোবাসা বিলাতে মায়েদের কখনও দুর্নীতি থাকে না।
গভীর রাতে কে যেন আমার ঘরে এলো। আবছা আলোয় আবিষ্কার করলাম সে বড়দা। জিজ্ঞাসু সুরে বললামÑ‘কে বড়দা?’ মলিন গলায় জবাব এলোÑ‘হ্যাঁরে, তোর কাছে প্যারাসিটামল হবে? জ্বর বাড়ছে।’ আমি টিউবলাইট জ্বালিয়ে দিলাম। বড়দার কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলাম! বড়দার এত তীব্র জ্বর! বিস্মিত গলায় বললামÑ‘জ্বরে তো সমস্ত গা পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার দেখাসনে? মা তো আমাকে কিছুই বলেনি।’ বড়দা কাঁপা গলায় বললÑ‘মা তো জানে না আমার অসুখের খবর।’
আমার চোখে পানি চলে এলো। এই তো সেদিনও বড়দার কত গুরুত্ব ছিল এই সংসারে। রোগে শোকে মা তার পাশে পাশে থাকত ছায়ার মতো। এখন তার চাকরি নেই। সংসার নামের পুরাতন বৃক্ষে মায়ের চোখে সে আজ পরগাছা। কিন্তু আমাদের সংসারে এই দুর্নীতি থাকবে কেন? ছেলে ইনকাম করলে সে সবার চোখের মধ্যমণি আর ইনকাম না করলে চোখের বিষ! না, এই সমাজ আর এই সংসার থেকে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এই দুর্নীতির কারণে এক সময় আমাদের কর্মঠ বড়দা আজ সংসারে কতটা নিচে যে নেমে এসেছে, সেটা ভাবতে গিয়ে আমার সমস্ত বুক কেঁপে উঠল।

×