ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পার্কবেঞ্চের কবিতা

অপূর্ব কুমার কুন্ডু

প্রকাশিত: ০০:৪০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

পার্কবেঞ্চের কবিতা

পার্কবেঞ্চের কবিতা

আত্মাভিমান-অহমিকা আর স্বঘোষিত আমিত্বের এই দোদুল্যমান সময়ে খাল-বিল, নদী-নালা যতই তার বিরাটত্ব তার বিস্তৃততার প্রকাশ তরঙ্গ আর গর্জনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করুক না কেন, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই বোঝে তার উৎসমূলে হিমালয়ের বরফ গলা জলরাশি কিংবা পুঞ্জীভূত মেঘমালা। বর্তমানের আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে একটা অতীত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। সফোক্লিস যে অয়দিপাউস নাটকের জন্য বিশ^খ্যাত তারও উৎস মূলে সেই আড়াই হাজার বছর পূর্বে অন্ধ কবি হোমার রচিত মহাকাব্য ওডিসি।

অতীতের কবিকে যখন বর্তমানের কবি তার সৃজন রচনায় স্মরণ করে পরম শ্রদ্ধায়, অনুপ্রাণিত হয়ে সৃজন করে চলে আপন মহিমায়, তখন যে ভালটা লাগে সেই ভালটাই লাগছিল এবারের অমর একুশে বইমেলায়, কবি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কবি-প্রাবন্ধিক-গবেষক এবং ভ্রমণবিষয়ক কথাসাহিত্যিক সৌম্য সালেক রচিত, চল্লিশটি কবিতা নিয়ে কাব্য গ্রন্থ ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’ বইয়ের সোনালী দুঃখ কবিতাটা পড়তে পড়তে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের   সোনালী দুঃখ গ্রন্থ পাঠ, অধ্যয়ন, আত্মস্থতা শেষে কবি সৌম্য সালেকের রচনায় কি এক জোর্তিময় অভিব্যক্তি,
আপনার ত্রিস্তান আমাকে পাগল করেছে কবি /পাখির মতো সুরও সংকেত, সিংহ-সাহস, দুঃখ যাপন/ সোনালীর প্রেমে অসহ আকাক্সক্ষার সে বিষণ্ণ মুখ আমার ঘুম কেড়েছে...
ঘুম কেড়ে নেওয়ার ব্যাপার না বরং শরৎএর কাশফুলের মতো আকাশে স্বপ্নদের ভেসে বেড়ানোয় পথের বাঁক পরিবর্তন। কবি সৌম্য সালেকের কবি সত্তার জীবনে জালাল উদ্দীন রুমী সত্য বলেই যেমন মহাকবি ফেরদৌসী সত্য তেমনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সত্য বলেই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সত্য। আর সেটাই তো সঠিক।

হিমালয়ের জল কত পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে গিয়ে মিশতে পারায়, মিলিয়ে যেতে পারায় তবেই না তার প্রশান্তি, তার তৃপ্তি। আর সেকারণে কবি সোম্য সালেক ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়’ কবিতায় লিখলেন,
রুমি আমাকে যখন হ্যাঁচকা-টানে উর্ধে ওড়াচ্ছিল অট্টহেসে/ ভীষণ যাতনায় অজ্ঞেয় মিলনে; আপনি তখন গেয়ে চললেন/ মৃদুলয়ে যেন অনন্ত বয়ে চলা নদী, আমি পেলাম পিপাসার / জল, পুষ্পরাগের প্রভা, নমিত নারীর গান আর বন্দনার ন¤্র রাণী।
হে কবি, আমার উচ্ছ্বাস ঘুচে গেছে অমরার! / আমি আজ গেয়ে চলি ধীরতায়-সৃজনের বনে বনে...
বনে-জলে জঙ্গলে মনের বসতি যেখানে, সেখানে প্রেম থাকবে অথচ সন্দেহ থাকবে না, ঘৃণা থাকবে না একথা স্বীকার করার মতো ক্ষমতা ওথেলো নাটকের নাট্যকার- কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারেও ছিল না পাঁচশত বছর পরে এখনও নেই বাংলার কবি-প্রাবন্ধিক-নাট্যকার সৌম্য সালেকের। আর সে কারণে তিনি উপন্যাস সমবিস্তৃত বিষয়কে কাব্যের সীমিত লক্ষণ রেখায় বেঁধে ফেলেন ‘স্ত্রী বিষয়ক টিকা’ কবিতা রচনার অন্তরাত্মায়,
বিবাহের দ্বিতীয়বর্ষে এক অষ্টাদশী রমণীর পায়ের গোছা  ও ঘনচুল/ বাংলা রেলের টিকিট কালেক্টর কামরুদ্দিনের মনোযোগ আকর্ষণ করে / আর ঘোরের বশেই এদিন প্রাতঃরাশের মুহূর্তে স্ত্রীর/ কাছে সে ঘনচুল ও মোটাগোছার বর্ণনা করে বসে! সেই থেকে শুরু /সন্দেহের লাল নীল বিচিত্র গ্রন্থনা, সেই থেকে মাছি-ভনভন সকাল-/ দুপুর-অষ্টপ্রহর! সেই থেকে স্বপ্নও সুন্দরের পিঠে অবিরাম কাকের কীর্তন!
ভোরের কীর্তন হোক কিংবা সন্ধ্যা বেলার পূরবী রাগ হোক কথা হচ্ছে কবি মনেও তো সংশয় জাগে। বিনিদ্র রজনী জেগে যে কাব্য সৃজন, কাব্য সত্তায় যে সত্যের অনুসন্ধান, অনুরাগী পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের কাছে কাব্যের ঢালি উপহার হিসাবে তুলে ধরার যে তীব্র ব্যাকুলতা, সেসবের প্রেক্ষিতে গোলায় ফসলরুপ ধান তোলার মতো কাব্য সৃজনের স্বীকৃতি, পুরস্কার কিংবা প্রশাংসা শেষ পর্যন্ত মিলবে তো। সংশয় আছে কিন্তু মীমাংসার সমাধান নেই বলেই কবি সৌম্য সালেকের ‘আমি জানি আমার কবিতা’য় উচ্চারিত এক চাপা ক্রন্দন,
আমি জানি এসব কাব্যকাহন শুনবে না লোকে/ গীতরূপে কণ্ঠে পাবে না ঠাঁই, কারও
নিবিড় পঠনে হবে না উদ্ধার-/ছেঁড়াখোঁড়া অক্ষরে মেশা এসব অতিইচ্ছার আহাজারি
আহাজারি না বরং নান্দনিক-নয়নাভিরাম-আলংকারিক প্রচ্ছদে ‘পার্ক বেঞ্চের কবিতা’ বইটিকে পার্ক-বেঞ্চ-পাখি-কবির সমন্বিত নিঃসঙ্গতায় প্রাণবন্ত করেছেন প্রচ্ছদ শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর।

কবি প্রকাশনীর কাব্য বইটির প্রকাশনায় একটা রোমান্টিক ছোঁয়া পাওয়া যায়। প্রাজ্ঞ জনেরা বলেন, সৃজন হয় নিঃসঙ্গে, প্রকাশ পায় সর্বজনে। কবি সৌম্য সালেকের রচিত ‘প্রেমে পড়ে’ কাব্যের কয়েকটি পঙ্ক্তিই হোক সংশয় অবসানে চিরন্তন সৃজনের মর্মমূলের উচ্চারণ,
কখনও কুয়াশা চোখে কখনও আলোক/ কখনও উদাস মন কখনও হুতাশ/কখনও হৃদয় থাকে শান্ত-কোমল/ কখনও বজ্রঝড়-কামনা উত্তাল/ এই জ¦ালা আর কত সইব নীরবে
নেই লোক, নেই সঙ্গ, নেই প্রাণ-প্রাণের মতন/ তাই একা গানে গানে ফেরি করি প্রেমের কাহন।

×