ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গভীর বেদনার শিল্পরূপ

তকির হোসেন

প্রকাশিত: ০০:২৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

গভীর বেদনার শিল্পরূপ

গভীর বেদনার শিল্পরূপ

নিষ্ঠাবান চিত্রশিল্পী মুশতাক আহমেদ ১৯৮০ সাল থেকে ঢাকা আর্ট সার্কিটে সক্রিয় আছেন। এই সময় কালে, জাতি অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করেছে; আমাদের সৃজনশীল অনুষদগুলো অভিনব স্বপ্নও ধারণার এক বলয় তৈরি করেছে। একজন নিবিড় দর্শক হিসেবে মুশতাক দেশের  পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করেন। তার আঁকা ছবি অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের ইশারায় পূর্ণ। তারা একটি জটিল বাস্তবতাকে অনুধাবন করে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এটি মুশতাককে বাংলাদেশের শিল্প পরিমণ্ডলে বিশিষ্ট শিল্পীদের একজন করে তুলেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুশতাক নিজেকে পরিশীলিত করতে থাকেন এবং দক্ষতার একটি মেলডি আয়ত্ত করতে থাকেন। ফল স্বরূপ নতুন লাইন, কৌশল, ফর্ম এবং বিভিন্ন ধরনের বস্তু তার চিত্রকর্মে অন্তর্ভুক্ত  হয়। রোমান্টিক এবং প্রকৃতি কেন্দ্রিক হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন   রাজনীতি সচেতন চিত্রশিল্পী। ১৯৭৫ সালের হত্যাযজ্ঞ তার মনস্তাত্ত্বিক মেজাজ, ক্রোধ, ব্যথা এবং উদ্বেগের পাশাপাশি  ১৯৭১  এবং ১৯৭৫ সালের বিপজ্জনক দিনগুলোকে প্রতিফলিত করে।

সেই সময়ের গভীর উপলব্ধি তার চিত্রকর্মে যথাসম্ভব অবিকলভাবে এবং প্রতীকীভাবে ফুটে ওঠে। মুশতাকের চিত্রকর্মে তার বিষয়গুলোর শিকড়ে গভীর চিন্তাভাবনার কারণে আরও পরিপক্ব দেখায়। আলো ও ছায়ার মিশ্রণ তার রচনায় নীরবতা ও নির্জনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। একজন সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু“ হওয়ার পর থেকেই মুশতাক তার চিন্তাভাবনার স্বকীয় প্রক্রিয়া এবং ভাষা বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
১৯৭৫ সালের হত্যাযজ্ঞের সময় মুশতাকের বয়স ছিল মাত্র ১৮ এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সঙ্কটের সময় বাইকে করে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ঘটনার একটি ধারণা পেতে।
এই ঘটনা নিয়ে মুশতাক দুটি পেইন্টিং করেছেন  (ক্যানভাসে এ্যাক্রিলিক) যা থিমভিত্তিক এবং তাদের প্রকাশের ধরনটি বিশুদ্ধ বর্ণনামূলক। একটি চিত্রকর্মে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। তিনি ক্যানভাসে সারাদেশের মানচিত্র জুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল রক্ত মাখা শরীরকে চিত্রিত করেছেন। পেইন্টিংটি এই আইকনিক ব্যক্তিত্বের বিশাল তাৎপর্যকে বোঝাতে চায়। পেইন্টিংয়ের উপরিভাগ মসৃণ এবং কোথাও কোথাও অসম দেখায়, যেখানে রঙগুলোকে চমৎকারভাবে মিশ্রিত করা হয়েছে।

একটি অনন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দুঃখের অভিব্যক্তি তৈরি করতে তিনি তার অসম সৃজনশীলতা প্রকাশ করেছেন। এগুলো ছাড়াও চিত্রশিল্পী ইমপ্রেশনিজমের মুডে লাল রক্তের প্রবাহসহ একটি পান্না-সবুজ রঙের চিত্র প্রস্তুত করেছেন। হত্যাকাণ্ডটি চাঁদনি রাতে করা হয়েছিল এবং এটিকে তুলে ধরতে ক্যানভাসে একটি ক্ষীয়মাণ চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। এর আগে মুশতাক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর জীবন এবং কর্মের ওপর বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম করেছেন।
অন্য পেইন্টিংটিতে কিছু এলিয়েনকে (আকৃতি) দেখানো হয়েছে, যেগুলো রক্ত চুষে বাতাসে উড়ছে। এলিয়েনদের পা রক্তমাখা। আর ক্যানভাসের নিচের অংশটি নরম সবুজ আর লাল রঙের মিশেলে বৈশিষ্ট্যময় হয়ে উঠেছে। ক্যানভাসটি একটি সদ্য জন্ম নেয়া দেশকে উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির স্পর্শ অনুভব করার কথা বোঝায, যা একদল লোক জোরালোভাবে ব্যর্থ করে  দেয় এবং তা করার পরই প্রস্থান করে।

১৯৭৫ সালের খুনীরা একটি দেশের উন্নয়নকে থামিয়ে দিয়েছিল এবং এর জনগণের জন্য অন্যায়, বৈষম্য এবং ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ভরা একটি নতুন পথ তৈরি করতে সহায়তা করেছিল। চিত্রটি ২০০৪ সালে করা হয়েছিল এবং ২০০৬ সালে শহরের একটি গ্যালারিতে প্রথম প্রদর্শন করা হয়েছিল। এখন আবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চিত্রকর্ম প্রস্তুত করার ওপর মন দিচ্ছেন।

মুশতাক আহমেদ অস্পষ্ট  আকৃতি এবং একটি চিত্রকর্মের সামগ্রিক মৌলিক দিকগুলোর ব্যবহারে অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ। তিনি তার ট্রেডমার্ক কৌশলের জন্য সতর্কতার সঙ্গে ব্রাশ ব্যবহার করেন। এছাড়া তিনি রঙের স্তর নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। তার ক্যানভাসে দমিত ও প্রাণবন্ত রঙ যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। তার সমতল রঙের ব্যবহার একটি আভা তৈরি করেছে, যেখানে কেউ শিল্পের প্রতি তার অধ্যবসায় এবং নিষ্ঠা উপলব্ধি করতে পারে।

পেইন্টিংগুলোতে বিভিন্ন জায়গা খোলা এবং বড় বলে মনে হয়, যার ফলে স্পষ্টভাবে প্রতিটি মুহূর্তের ওপর জোর দেয়া হয়। তার রঙের বার্তা আমাদের আত্মা এবং মন দ্বারা সহজেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
মুশতাক আহমেদ রাজনীতি সচেতন চিত্রশিল্পী, যিনি অনেকদিন ধরেই ঢাকার চিত্রকলায় বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। যখনই দেশ কোন অস্থিরতায় ডুবে যায়, তিনি পরিস্থিতিকে তীব্রভাবে চিত্রিত করার জন্য হাত লাগান।
কোভিড-১৯ মহামারী দেশে পৌঁছানোর কিছুদিন পরেই শিল্পী প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষের ক্রমবর্ধমান দোদুল্যমান মেজাজ,  তাদের আতঙ্ক এবং উদ্বেগ, সেই সঙ্গে সামগ্রিক বিপজ্জনক সময়কে প্রতিফলিত করার জন্য একটি ধারাবাহিক চিত্রকর্ম তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই মহামারীর ওপর তার গভীর পর্যবেক্ষণ তাকে পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত এবং বাইরের অবস্থা বিশ্লেষণে সহায়তা করেছিল।
সময়ের এই পর্যায়ে মুশতাক অনেকগুলো মানবরূপ চিত্রিত করেছেন, যার প্রত্যেকটির একটি অনন্য চেহারা রয়েছে। কারণ, চিন্তাশীল এবং বিষণœ অভিব্যক্তি একে অপরের থেকে আলাদা। রঙের সমৃদ্ধ মিশ্রণের কারণে পেইন্টিংগুলোর উপরিভাগ মসৃণ এবং কখনও কখনও অসম দেখায়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এত অভিব্যক্তি  তৈরি করতে গিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন তার অসম সৃষ্টিশীল ক্ষমতা। এগুলোর পাশাপাশি চিত্রকর কিছু পান্না সবুজভিত্তিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ইমপ্রেশনিজমের মুডে চিত্রিত করেছেন, যেখানে কখনও কখনও একটি ক্ষীয়মাণ চাঁদ ভাল দিনের আশা প্রকাশ করতে উঁকি  দেয়।
কর্মজীবনের শুরু“থেকেই একজন বিচক্ষণ শিল্পী হিসেবে মুশতাক শিল্পের মাধ্যমে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া ও ভাষাকে তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার চিত্রকর্মে রয়েছে অকৃত্রিম নান্দনিকতার ছোঁয়া। তারপরও শিল্পীর মনের সঠিক গতিপ্রবাহ আন্দাজ করা খুব কঠিন। কিন্তু মুশতাকের আঁকা ছবিগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর যে কেউ নিশ্চিত হতে পারেন যে, তিনি একজন রূপক ও আধুনিকতাবাদী শিল্পী। আকাশী, সবুজ, কালো এবং ক্রিমসন তার পেইন্টিংগুলোতে খুব লক্ষণীয় এবং রঙগুলো একে অপরের সঙ্গে ভালভাবে মিশে যায়।  
বর্তমান চিত্রকর্মের সিরিজের চরিত্রগুলোর বিন্যাসও নিঃসন্দেহে অনন্য এবং অভিব্যক্তিপূর্ণ। তার চিত্রগুলো দেখলে যে কোন দর্শক একটি একাকী আত্মার বিলাপ, অন্তর্নিহিত দুঃখ এবং নির্জনতার ছাপ অনুভব করতে পারে।
মুশতাক ক্ষুদ্র অস্পষ্ট আকৃতি এবং সামগ্রিক মৌলিক দিকগুলোর ব্যবহারে অত্যন্ত যতœশীল। কখনও কখনও কালো তার কাজগুলোতে প্রধান ছায়া হিসেবে কাজ করে এবং শিল্পী এই রঙের স্তরগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তার লাইনগুলো একটি আভা তৈরি করেছে, যেখানে কেউ তার অধ্যবসায়, আকাক্সক্ষা এবং শিল্পের প্রতি নিষ্ঠা সম্পর্কে জানতে পারে।
মুশতাক তার হলমার্ক টেকনিকের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রাশ ব্যবহার করেন। তিনি সরাসরি রং প্রয়োগ করেন এবং তারপর তাদের শৈল্পিক প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সাবধানতার সঙ্গে পালিশ করেন। তার কাজগুলো কৌশলভিত্তিক এবং এদের মধ্যে এ্যাক্রিলিকনির্ভর চিত্রগুলো স্পষ্টভাবে তার আবেগী মনকে প্রকাশ করে।
রঙের পাশাপাশি আলো এবং ছায়ার মিশ্রণ তার প্রকৃতিভিত্তিক চিত্রগুলোতে নীরবতা এবং অন্ধকারের অনুভূতি তৈরি করে। প্রকৃতি সর্বদা তার আত্মার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত থাকে। এর আগে তার ক্যানভাস চমৎকারভাবে প্রাণবন্ত রঙ বহন করেছিল, যেখানে কেউ শান্তি, সম্প্রীতি এবং প্রশান্তি খুঁজে পেতে পারে। কিন্তু বর্তমান মহামারী তার চিন্তাভাবনা প্রক্রিয়া এবং রঙ প্রয়োগের পদ্ধতিকে নির্মমভাবে পরিবর্তন করেছে।
এটি সহজেই বোঝা যায় যে মুশতাক তার রঙের প্রয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন, যাতে তারা একই সঙ্গে স্বাধীন এবং সংযত দেখায়। এখন তার  শৈল্পিক চিন্তাভাবনার গতিপথকে আরও পরিপক্ব মনে হয়, কারণ যদিও কোভিড-১৯ প্রায় সবার ওপরই প্রভাব ফেলছে, সৃজনশীল ব্যক্তিরা এর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।
মুশতাক আহমেদ ঢাকা আর্ট সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি একজন শিল্পসংগ্রাহকও বটে। তার শিল্পসংগ্রহে সমসাময়িক বাংলাদেশী মাস্টারপেইন্টার, ভারতীয় মাস্টারপেইন্টার, পশ্চিমা সমসাময়িক শিল্পী এবং অনেক উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিশীল বাংলাদেশী শিল্পীর শিল্পকর্ম রয়েছে। তার সংগ্রহের চিত্রগুলো বিভিন্ন বিভাগে সাজানো রয়েছে। বিভাগগুলো হলো-  আলঙ্কারিক এবং বস্তুনিষ্ঠ বিভাগ, ল্যান্ডস্কেপ বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিভাগ এবং বিমূর্ত বা অত্যাধুনিক বিভাগ।
তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাও। তার ডকুমেন্টারি “ডাইমিলিয়ন ’৭১” কলকাতায় ইন্টারন্যাশনাল বাংলা ফিল্ম ক্রিটিক এ্যাাওয়ার্ড ২০১১ পেয়েছে। ডকুমেন্টারিটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার ওপর নির্মিত। মুশতাক সবসময়ই নতুন ধারণার প্রতি খুব আগ্রহী এবং সমসাময়িক সংস্কৃতি ও শিল্প সবসময়ই তার এই নতুনের অন্বেষণ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

×