বিন্ধ্য সাহিত্য
সাহিত্যের ছোট কাগজের সুবর্ণ সময় আর নেই, এ এক তিক্ত সত্য। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে লিটল ম্যাগখ্যাত সাহিত্যের ছোট কাগজের যে গুরুত্ব ছিল পাঠকের কাছে, পরবর্তীতে তা কমতে থাকে, যা এখন তীব্র সঙ্কটে রূপ নিয়েছে। এর জন্য লিটলম্যাগ দায়ী নয়; প্রযুক্তির বৈচিত্র্যময় বিনোদনের বিপুল আয়োজন আমাদের অবসরের প্রায় সবটুকু কেড়ে নিয়েছে, নিরিবিলি সময়ে একটু আয়েশভঙ্গিতে বসে সাহিত্যে নিমগ্ন হওয়ার সময় এখন দুর্লভ।
তবু সাহিত্যের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কিছু তরুণ আজও লিটলম্যাগ বের করার ঝুঁকি নেয়, যা দুঃসাহসিকতাই বলতে গেলে। লিটলম্যাগের পাঠক অপ্রতুল, তবু গাঁটের পয়সা খরচ করে লেখা সংগ্রহ থেকে শুরু করে আকর্ষণীয় দুই মলাটের ভিতর তা প্রকাশ করা পর্যন্ত যে সীমাহীন শ্রম বিনিয়োগ করা হয়, তাকে দুঃসাহসিকতা ছাড়া আর কী বলা যায়। তেমনি এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ দেখতে পেলাম ‘বিন্ধ্য’ বাহিনীর।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ছোট কাগজ ‘বিন্ধ্য’র দ্বিতীয় বর্ষেও প্রথম সংখ্যা। বোঝা যাচ্ছে, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিয়মিত প্রকাশ করার প্রত্যয় তাদের আছে। সম্পাদকের বয়ানে আছে সেই স্বপ্নেরই প্রত্যয়। “বিন্ধ্য বাংলা সাহিত্যে ‘কল্লোল যুগ’ কিংবা ‘কণ্ঠস্বর’-এর মতো কোন বিপ্লব ঘটাতে আসেনি। বিন্ধ্য সাহিত্যের এসব সমৃদ্ধ ইতিহাসকে লালন করে পরম দরদে আগলে রাখতে চায় কেবল।” আকারে বড় নয় সংখ্যাটি, তবে বেশ পরিপাটি আয়োজন।
কিছু প্রচলিত শব্দের ভিন্ন নাম নতুনত্ব এনেছে। যেমন- বাংলায় অনুবাদের নাম দিয়েছে বাংলায়ন। এ শব্দটির অন্যত্র অন্য ব্যবহার থাকলেও বঙ্গানুবাদের প্রতিশব্দ হিসেবে পাইনি, অথচ চমৎকার মিলে গেছে।
এ সংখ্যায় প্রকাশিত কবিতা, গল্প, অনুবাদ, সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ, স্মৃতিগদ্য, গ্রন্থালোচনা কোনটাই অতিদীর্ঘ নয়, দীর্ঘ লেখনী প্রযুক্তি আসক্ত পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় কিনা, এ বিষয়ে হয়ত সাবধান ছিলেন তারা; অথচ কিছু রচনা পড়ে মনে হলো আরও দীর্ঘ হতে পারত। বিশেষ করে ইসহাক খানের স্মৃতিগদ্য ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’, রাহাত রাব্বানীর নেয়া কবি ভাস্কর চৌধুরীর সাক্ষাৎকার আর ফারুক সুমনের প্রবন্ধে আনোয়ারা সৈয়দ হকের জীবনকথা। সুখপাঠ্য এ লেখাগুলো আরও দীর্ঘ হলেও কোন ক্লান্তি আসত না। ইসহাক খানের স্মৃতিগদ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভারতে ট্রেনিং নেয়ার রোমাঞ্চকর বর্ণনা বেশ উপভোগ্য ছিল।
ভাস্কর চৌধুরীর সাক্ষাৎকারে তার সাহিত্যভাবনার পাশাপাশি বাড়তি সংযোজন কবি ত্রিদিব দস্তিদার সম্পর্কে জানা। ‘.. .. ..কবি হতে তার ঢাকায় পদার্পণ। সবার আদর পেল। অনেকে খুব ভালবাসার কথা বলল। কিন্তু কেউ তাকে বলেনি কী কাজ করে, কোথায় খায়, কোথায় ঘুমায়। কেউ জানেনি। সত্যিকার অর্থে তার প্রকৃত কোন বন্ধু ছিল না।’কবি ত্রিদিব দস্তিদার সম্পর্কে ভাস্কর চৌধুরীর নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে অনেকটাই জানা যায়, অকালপ্রয়াত প্রচারবিমুখ এই কবিকে নিয়ে তেমন ভাবে আর কারও লেখায় পাইনি।
মনে পড়ে, শিল্পী এস এম সুলতান সম্পর্কেও লেখক আহমদ ছফার কাছ থেকে আমরা এভাবে জেনেছিলাম তাঁর ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ে আর তারেক মাসুদের প্রামাণ্য চিত্রে। প্রচার উদাসীন এই কবি শিল্পীদের আমরা এভাবে একটু একটু জানি তাদের বন্ধু বা শুভাকাক্সক্ষী কোন সাহিত্যিকের কাছ থেকেই। তাদের সাহিত্যকর্ম ও জীবনকে জানানোর কোন উদ্যোগ আমরা বড় পরিসরে দেখি না। এদেশের একজন পাতিনেতা বা সিনেমার সাইড হিরো সম্পর্কেও মানুষ কত কী জানে।
অথচ একজন কবি বা শিল্পী তার গোটা জীবন নিয়ে আড়ালেই পড়ে থাকেন। আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘নরক ও ফুলের কাহিনি’ আত্মজীবনী নিয়ে ফারুক হোসেনের প্রবন্ধটি বেশ সুখপাঠ্য। স্বামী সৈয়দ শামসুল হকের ব্যাপক খ্যাতির ঔজ্জ¦ল্যে ও ম্লান হয়নি আনোয়ারা সৈয়দ হকের সৃজনী প্রতিভা। আত্মজীবনীতে অকপটে সত্য বলার যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। দুভার্গ্যবশত অনেক সাহিত্যিকের আত্মজীবনীতে অকপটে সত্য স্বীকারের সাহস সুলভ নয়।
এ সংখ্যায় বেশ কিছু গল্প প্রকাশিত হয়েছে। শাহান শাহাবুদ্দিনের লেখা ‘বিমর্ষ পাখির গল্প’ যেন এক দীর্ঘ কবিতা। গল্পটি পাঠ করতে করতে এর ভাষার সৌন্দর্যে মন আবেশিত হয়। তবে ইরমের সাথে প্রেমের বোঝাপড়ার জন্য আদিত্ত হুমায়ুন ফরিদীর কবরকে স্থান হিসেবে বেছে নেয়া অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। পুনর্জন্ম নিয়ে সালমা খানমের ‘অরুণিমা’ ভাল লেগেছে।
নিগার সুলতানা শিমুর ‘অন্ধেরযষ্ঠি’ও মোটামুটি ভাল লেগেছে। আসিফ মেহদী লিখেছেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক ‘কিঞ্চিৎ মিথ্যা’ গল্পটি। আরও ছিল সাঈদ আজাদের ‘দাবি’ ও সুলতানুল আরেফীন আদিত্যর ‘ইউএনও আপা’ গল্প। অণুগল্প ছিল তিনটি। সোহেল নওরোজের ‘বাজি’, মাসুম বিল্লাহর ‘টান’ এবং সোহেল রানার ‘আত্মগ্লানি’। এর মধ্যে ‘আত্মগ্লানি’ যথার্থ এক সার্থক অণুগল্প।
শুধু ক্ষুদ্রায়তনের জন্য নয়, বৈশিষ্ট্য বিচারেও। ‘বাজি’ও ভাল ছিল। সাহিত্য টিকে থাকে মূলত উপস্থাপন-কৌশল আর ভাষাশৈলীর বিচারে। সেদিক থেকে গল্প ও অণুগল্পের মধ্যে সাঈদ আজাদের ‘দাবি’, মাসুম বিল্লাহর ‘টান’ ও সুলতানুল আরেফিন আদিত্যও ‘ইউএনও আপা’ ভাষাশৈলী ও গল্পবুননে কিছুটা দুর্বল মনে হয়েছে।
ভাললাগার মতো বেশ কিছ ুকবিতা ছিল এ সংখ্যায়। বিশেষভাবে ভাল লেগেছে জিল্লুর রহমানের “নৈঃশব্দ নিহত হলে’ ও ‘তবু গুণে গুণে পার করি দিন’, আব্দুল্লাহ আল রিপনের ‘শিকার’ ও ‘ধরে নাও’, মঈন মুনতাসিরের ‘মেট্রোপলিটন-জুড়ে মধুমিতা’, মিজান হাওলাদারের ‘শব্দের গল্প’, ত্রিস্তান আনন্দের ‘আত্মস্বর্গ’ এবং মিলু শামসের ‘আদি স্ক্রিপ্ট’ ও ‘সাঁওতালিআগুন’ কবিতাগুলো। মঈন মুনতাসির বরাবরই সহজ পঙ্ক্তিতে বিভৎস সত্যকে উন্মোচন করেন।
‘বাতাসে ল্যাম্প পোস্ট দুলছে/ ঘুনে-ধরা মেট্রোপলিটন/অচেনা জানালাটা খুলছে/ বুঝি কারও মৃত্যুও আয়োজন’। এ যেন শব্দের খেলায় নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আব্দুল্লাহ আল রিপনের ‘শিকার’ কবিতার দার্শনিকতা মুগ্ধ করেছে। কবিতা পাঠের যথেষ্ট প্রস্তুতি না থাকলে মিলু শামস ও ত্রিস্তান আন›দের কবিতার রসাস্বাদন সম্ভব নয়।
এছাড়া বীরেন মুখার্জী, সৈয়দ তারেক, বিটলু দেব, নূরুজ্জামান ফিরোজ, শামস আল মমীন, আলোক আচার্য ও হাসান হামিদ, একরাম আজাদ ও মনিরা মণির কবিতাগুলোও বেশ ভাল লেগেছে। আরও আছে জাফর সাদেক, রকিব লিখন, পিয়াস মজিদ, মেহেদী ইকবাল, সৈয়দ এনামুল তাজ, নাহিদা নাহিদ, রাফাতুল আরাফাত, ই¯্রাফিল আকন্দ, আবু আফজাল সালেহ, রায়হান মুশফিক, ফখরুল, আসিফকা ওসার প্রমুখের কবিতা।
মাহমুদ দারবীশের কবিতার অনুবাদ ভাল ছিল। কিন্তু তাঁর আরও ভাল কবিতা অনুবাদের জন্য বাছাই করা যেত। বই আলোচনা ছিল তিনটি। আনোয়ার কামাল আলোচনা করেছেন বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা কবি আসাদুল্লাহর ‘তর্জনীর রূপকল্প’ কাব্যগ্রন্থটি। তবে আলোচক কবিতা আলোচনার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপরই বেশি আলোকপাত করেছেন, ফলশ্রুতিতে এটি কতটা সার্থক গ্রন্থালোচনা হয়েছে, সে প্রশ্ন থেকে যায়।
জোবায়ের মিলন আলোচনা করেছেন আলমগীর রেজা চৌধুরীর ‘শ্রেষ্ঠকবিতা’কাব্যগ্রন্থটি। একরাম আজাদের ‘বাঁ পাশের শূন্য’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনা করেছেন মোহাম্মদ আলী।
‘বিন্ধ্য’ ছোট কাগজের জগতে নতুন কিন্তু যথেষ্ট মানসম্পন্ন। মান ও রুচির দিক থেকে গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে সম্পাদকদ্বয় ও সংশ্লিষ্ট সবাই যে শ্রম ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন পাঠক তা খুঁজে পাবেন এর পঠন-পাঠনে। আশা করছি ‘বিন্ধ্য’ বাহিনি পরবর্তী সংখ্যাগুলোতেও তাদের এই নিষ্ঠার নিরন্তর গতি অব্যাহত রাখবে।