বাতিঘরের প্রথম দীপ
প্রাচীন বাংলার প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। এ ভাষার আছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা।
বাংলা মায়ের শাশ্বতকালের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা।
বাঙালী জাতি তাদের আবহমানকালের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময়ের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম করে যুগ যুগ টিকিয়ে রেখেছে মাতৃভাষা।
বাংলা ভাষা আন্দোলন দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ধাপ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস।’ দ্বিতীয় ধাপ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন।
এ অনুষঙ্গে আলোচ্য আনোয়ার হোসেন প্রথম ধাপের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বন্দী হন এবং পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্র ভাষা উর্দু করার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পূর্ববাংলায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। সচেতন ছাত্রনেতাদের আহবানে ১৯৪৮ খ্রিঃ ১১ মার্চ তৎকালীন পূর্ব বাংলায় দেশব্যাপী প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা রক্ষার দাবিতে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ নামে ছাত্র আন্দোলন পালিত হয়।
পাকিস্তান সরকার ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৪ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করার পর জাতীয় পরিষদে রাষ্ট্র ভাষা উর্দু করার ঘোষণা দেয়াকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধে। প্রতিবাদে পূর্ব বাংলায় তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সমমনা অন্যগণ ‘১১ মার্চ/১৯৪৮ বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ নামে কর্মসূচী ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা চালান।
বাঙালী জাতির মাতৃভাষার প্রতি বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নয়া পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সচেতন ছাত্রদের এটি ছিল প্রথম ধাপের আন্দোলন। এই আন্দোলনে খুলনা থেকে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন বি এল কলেজের মেধাবী ছাত্র আনোয়ার হোসেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে জীবন দানকারী প্রথম শহীদ।
শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা) ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের বাংলা ভাষার দাবি দিবস আন্দোলনকে সফল করার জন্য ফরিদপুর, যশোর, খুলনা,বরিশালে এসে জনসভা করেন। তিনি আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে খুলনার দৌলতপুরে (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮) সভা ও সমাবেশ করেন এবং বিরোধী পক্ষের বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার দাবিতে সভায় বক্তব্য রাখেন ও আন্দোলনকে সফল করার জন্য আহ্বান জানান।
একই সঙ্গে আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা শেখ আবদুল আজিজকে সভাপতি ও মোমিনউদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করে খুলনার কমিটি গঠন করে দেন। পরে বরিশালে মিটিং শেষে তিনি নির্ধারিত তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে গিয়ে ১১ মার্চ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। পুলিশ তাঁকে সহ বহু ছাত্রনেতা-কর্মীকে ১১ মার্চের আন্দোলনে গ্রেফতার করে। সেটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানে প্রথম কারাবরণ।
এই আন্দোলনে খুলনা বি এল কলেজের ছাত্র ফেডারেশন, আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগ ও সমমনা ছাত্রনেতা যথা- আনোয়ার হোসেন, তাহমিদউদ্দীন, স্বদেশ বোস, সন্তোষ ঘোষ, ধনঞ্জয় দাস, শৈলেন ঘোষসহ অন্য ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে একদল ছাত্র দৌলতপুর থেকে খুলনায় গিয়ে ১১ মার্চ ১৯৪৮; খুলনা হাদিস পার্কে (তৎকালীন গান্ধী পার্ক) প্রতিবাদ সমাবেশ করে বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিনামা পেশ করেন বিএল কলেজের মেধাবী তেজস্বী তুখোড় ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেন।
মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য পুলিশের প্রবল বাধার মুখে লিখিত দাবিনামা পেশ করার কারণে তিনিসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পরর্তীতে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া ছাত্ররা শর্ত সাপেক্ষে ছাড়া পেলেও আনোয়ার হোসেনকে পুলিশ ছাড়েনি।
পাক পুলিশ বন্দী আনোয়ারকে খুলনা থেকে রাজশাহী জেলে স্থানান্তর করে। জেলের মধ্যে অন্যান্য রাজবন্দীদের নিয়ে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে রাজশাহী জেলের মধ্যে অনসনসহ কয়েক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অজুহাতে ১৯৫০ খ্রিঃ ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আনোয়ার হোসেনসহ সাতজন রাজবন্দীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
জেলে থেকে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাঙালী রাজবন্দীদের ওপরে নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক দুঃসাহসিক প্রতিবাদ করা ওই সাতজন দেশপ্রেমিক বীর ছিলেন পাকিস্তান সরকার বিরোধিতাকারী প্রথম শহীদ।
এদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন ভাষার দাবি আদায়ের জন্য বন্দী অবস্থায় জীবন দানকারী প্রথম শহীদ। উক্ত হত্যাকা-ে আরও ৩৫-৪০ জন বন্দী মারাত্মকভাবে আহত হয়ে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান। নিহত অন্য রাজবন্দীগণ হলেন- বিজন সেন, দিলওয়ার হোসেন, হানিফ শেখ, কম্পরাম সিংহ, সুখেন্দু ভট্টাচার্য এবং সুধীন ধর।
এই শহীদগণের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৩ খ্রিঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে নিহত শহীদগণের বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ নামফলকসহ শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।
আনোয়ার হোসেন বাংলা ভাষা রক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে খুলনা থেকে বন্দী হন। পাক সরকারের অন্যায় দাবি ও কাজের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে জেলে বন্দী অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। ভাষা রক্ষা দাবির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হন তিনি। তাই আমাদের দৃষ্টিতে আনোয়ার হোসেনই বাঙালীর মাতৃভাষা রক্ষা আন্দোলনের প্রথম ‘ভাষা শহীদ। ’
১১ মার্চ ১৯৪৮ এর প্রথম ধাপের আন্দোলন, দ্বিতীয় ধাপের ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছে। রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার ও আউয়ালরা ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে পাক পুলিশের গুলিতে জীবন দিয়ে ভাষা শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি যেভাবে পেয়ে অমর হয়েছেন; সেই ভাবে ১১ মার্চের প্রথম ধাপের ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ আনোয়ার হোসেনকে প্রথম ভাষা শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা সময়ের দাবি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
পরিচয় : মেধাবী ছাত্র আনোয়ার হোসেনের পিতার নাম কোনাই সরদার। পৈত্রিক নিবাস ছিল সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার শোভনালী গ্রামে। তার নানা বাছের সরদারের (স্কুল শিক্ষক) বাড়ি একই উপজেলার বুধহাটা গ্রামে। আনোয়ার হোসেন তার নানা বাছের সরদারের তত্ত্বাবধানে বুধহাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ শেষে ঐ গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করে।
পরে তিনি খুলনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে ১৯৪৭-৪৮সালে। খুলনার দৌলতপুর বি এল কলেজে পড়াকালে ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালের প্রথম ধাপের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বন্দী অবস্থায় পুলিশের গুলিতে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওর্য়াডে শহীদ হন।
আনোয়ার হোসেনের সহপাটী ভাষা সৈনিক আবদুল হালিম এর তথ্য অনুযায়ী আনোয়ার হোসেন ও তিনি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে খুলনা জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়েছেন এবং আনোয়ার হোসেন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তিনি ১৯৪৬-৪৭ খ্রিঃ কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশন পাশ করে এবং দৌলতপুর বি এল কলেজে পড়ালেখা করতেন। স্বাধীনতার বাতিঘর বাঙালীর ভাষা আন্দোলন। সেই বাতিঘরের প্রথম প্রদীপ আনোয়ার হোসেন আজও আঁধারে। কবে জ্বলবে সেই প্রথম দীপ!
প্রথম ধাপের ভাষা আন্দোলনের জন্য জীবন দানকারী দেশপ্রেমিক, বাংলাভাষা রক্ষার অকুতোভয় সৈনিক, বীর বাঙালী আনোয়ার হোসেনকে তার গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘প্রথম ভাষা শহীদ’ এর মর্যাদা দানের জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।