ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সুনির্মল বসুর ছড়া

ড. আশরাফ পিন্টু

প্রকাশিত: ০১:৩২, ১২ আগস্ট ২০২২

সুনির্মল বসুর ছড়া

সুনির্মল বসুর ছড়া

যে কয়েকজন সাহিত্য সাধক আজীবন বাংলা শিশুসাহিত্য সেবায় ব্রতী ছিলেন তার মধ্যে সুনির্মল বসু অন্যতমতার জন্ম (জন্ম ২০ জুলাই ১৯০২- মৃত্যু ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭) পিতার কর্মস্থল ভারতের বিহারে হলেও পৈত্রিক নিবাস ছিল বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের মালখানগরপিতার নাম পশুপতি বসুছোটবেলা সাঁওতাল পরগণার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে তার মনে কবিতা রচনার অনুপ্রেরণা জাগায়তার প্রথম কবিতা প্রবাসীপত্রিকায় প্রকাশিত হয়

প্রধানত সরস শিশুসাহিত্য রচনাকেই সাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেনকবিতা রচনা ছাড়াও কিশোর বয়স থেকে চিত্রাঙ্কনেও দক্ষ ছিলেনছড়া, কবিতা, গল্প, কাহিনী, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, রূপকথা, কৌতুকনাট্য প্রভৃতি শিশু ও কিশোরদের উপযোগী বিভিন্ন বিষয়ক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেনআর তার জনপ্রিয়তার মূলে ছিল ছন্দের চমকারিত্ব ও মিলপ্রয়োগের কুশলতা

সুনির্মল বসুর ছড়ার ছন্দ ও বিষয় শিশু-কিশোরদের মনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেতার বেশকিছু জনপ্রিয় ছড়া রয়েছেএসব ছড়ায় কোথায় রয়েছে ছন্দের মজা, কোথাও শিক্ষণীয় বিষয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক কোথাও রয়েছে নাটকীয় পরিবেশ, আর রয়েছে নিটোল হাস্যরসভাগলপুরের ছাগলশিরোনামে তার হাস্যরসযুক্ত একটি ছড়া-

ভাগলপুরের ছাগল হঠা

পাগল হয়ে যায়,

শিঙ বাগিয়ে লাগায় তাড়া

সামনে যারে পায়

কাঁকুরগাছির ঠাকুর দাদা আনছে কিনে ডিমের গাদা

এমন সময় ছাগল তেড়ে গুতিয়ে দিলো তায়,

ঠাকুর দাদা গড়িয়ে পড়ে

ডিমগুলো সব ছড়িয়ে পড়ে

ডিমের রসে ঠাকুর দাদায় চেনাই হলো দায়

সুনির্মল বসু তার ছড়ায় হাস্যরসের মধ্য দিয়েও অনেক শিক্ষণীয় দিক তুলে ধরেছেনতার এমনি একটি ছড়া হলো হবুচন্দ্রের আইন’-

হবুচন্দ্র রাজা বলেন গবুচন্দ্রে ডেকে,

আইন জারি করে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে,

মোর রাজ্যের ভিতর,

হোক না ধনী, হোক না গরিব, ভদ্র কিংবা ইতর,

কাঁদতে কেহ পারবে না কো, যতই মরুক শোকে

হাসবে আমার যতেক প্রজা, হাসবে যত লোকে

সান্ত্রী-সেপাই, প্যায়দা, পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে,

কাঁদলে কেহ, আনবে বেঁধে, শাস্তি হবে শেষে

কিন্তু মন্ত্রী গবুচন্দ্র যুক্তি দেখান- হুজুর, যদি কেউ কখনও দৈত্য-দানা বা জুজুর ভয় পায়; কিংবা যদি পিছলে পড়ে মু-ু ফাটায়, গাড়ির তলে কারুর যদি থেঁতলিয়ে যায় দেহ; সত্যিকারের বিপন্ন হয় যদি... তবু রাজা তার সিদ্ধান্তে অটল-

রাজা বলেন, গবু,

আমার আইন সকল প্রজার মানতে হবে তবু

কেউ যদি হয় খুন বা জখম, হাড্ডিতে ঘুণ ধরে,

পাঁজরা যদি ঝাঁঝরা হয়ে মজ্জা ঝরে পড়ে,

ঠ্যাংটি ভাঙে, হাতটি কাটে, ভুঁড়িটি যায় ফেঁসে,

অন্ধকারে স্কন্ধ কাটা ঘাড়টি ধরে ঠেসে,

কিংবা যদি ধড়ের থেকে মু-ুটি যায় উড়ে,

কাঁদতে কেহ পারবে না কো বিশ্রী বিকট সুরে

হবুচন্দ্রের দেশে

মরতে যদি হয় কখনো, মরতে হবে হেসে

এরপর থেকে রাজা হবুচন্দ্রের দেশের আইন-কানুন পাল্টে গেলহাসি আর আনন্দে দিনপাত করতে করতে তারা এক সময় কান্নাই ভুলে গেলএভাবে অনেকদিন পর রাজা হবুচন্দ্র কেউ আইন ভঙ্গ করছে নাকাউকে শুলে চড়ানো যাচ্ছে নাতাই-

রাজা হবু বলেন আবার গবুচন্দ্রে ডাকি,

আমার আদেশ মেনে সবাই আমায় দিলে ফাঁকি?

রাজ্যে আমার কাঁদার কথা সবাই গেল ভুলে,

কেউ গেল না শূলে?

একটা লোকও পেলাম না এইবারে

শূলে চড়াই যারে

নিয়ম আমার কড়া

প্রতিদিনই একটি লোকের শূলেতে চাই চড়া

রাজার কথা শুনে মন্ত্রী গবুচন্দ্র হেসে বলেন, হুজুর এ রাজ্যে কাঁদার মতো কোন লোক নেইসবাই কান্না ভুলে গেছেতিনি বলেন-

আমি না হয় নিজেই কেঁদে আইন ভেঙে তবে

চড়ব শূলে, মহারাজের নিয়ম রক্ষা হবে

কিন্তু একি, আমিও যে কাঁদতে গেছি ভুলে,

কেমন করে চড়ব তবে শূলে?’

তখনÑ

রাজা বলেন, তোমার মতো মূর্খ দেখি না যে,

কাঁদতে তুমি ভুলে গেলে এই কদিনের মাঝে

এই দ্যাখো না কাঁদে কেমন করে

এই না বলে হবু রাজা কেঁদে ফেলেন জোরে

মন্ত্রী গবু বলে তখন, এবার তবে রাজা

নিজের আইন পালন করুন গ্রহণ করুন সাজা

বলেন হবু, আমার হুকুম নড়বে না এক চুল,

আমার সাজা আমিই নেব তৈরি করো শূল

শুধু হাস্যরস নয়, সুনির্মল বসু শিশু-কিশোরদের মানস তথা চরিত্রগঠনে ব্রতী ছিলেনতার প্রথম-প্রভাতকবিতায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছেÑ

আজি এ প্রভাতে আলোর প্রপাতে

আমরা করিব ¯œান,

জ্যোতির্ময়ের বন্দনা করি

ছন্দে ধরিব গান

প্রার্থনা মোরা করিব সবাইÑ

এসো এসো সুন্দর,

সরস পরশে বিকশিত কর

আমাদের অন্তর

সুনির্মল বসু শিশু-কিশোরদের মানসগঠনে ব্রতী ছিলেন বলেই তিনি লিখতে পেরেছিলেন শহিদ ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন প্রমুখ বিপ্লবীদের জীবন গাথা নিয়ে ছড়া কবিতা এদের আদর্শ তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন শিশু-কিশোরদের মাঝেমাস্টারদা সূর্যসেনকে নিয়ে তার ছড়া কবিতা-

 

সূর্যের মতো প্রখর দীপ্ত সূর্যসম

ঘন দুর্যোগে সূর্যের মতো জ্বলে ওঠেন

মুক্ত করিতে চট্টগ্রাম

করেন চেষ্টা অবিশ্রাম

সুনির্মল বসুর বহুল পঠিত এবং  বিখ্যাত ছড়া হলো সবার আমি ছাত্রএ ছড়া শিশুর মানসগঠনের পাশাপাশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যায়প্রকৃতিই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক তা আমাদের ভাবকে শেখায়Ñ

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল

উদার হতে ভাই রে,

কর্মী হবার মন্ত্র আমি

বায়ুর কাছে পাই রে

পাহাড় শিখায় তাহার সমান

হই যেন ভাই মৌন-মহান,

খোলা মাঠের উপদেশে

দিলখোলা হই তাই রে।...

 

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,

সবার আমি ছাত্র,

নানান ভাবে নতুন জিনিস

শিখছি দিবারাত্র

এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,

পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়

শিখছি সে সব কৌতূহলে,

নেই দ্বিধা লেশমাত্র

পরিশেষে বলা যায় যে, সুনির্মল বসু এমন একজন শিশুসাহিত্যিক যিনি রবীন্দ্র-উত্তর থমকে যাওয়া বাংলা শিশু সাহিত্যের গতিসঞ্চার করেছিলেনকিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তার শিশুসাহিত্য এবং তাকে আমরা সেভাবে চর্চা করতে পারিনি; ফলে অনেকটাই ভুলে যেতে বসেছি তার সৃষ্টিকর্মকে

×