ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

সাগর জামান

কবিতার মোহময় ভুবন

প্রকাশিত: ০০:৪২, ২৯ জানুয়ারি ২০২১

কবিতার মোহময় ভুবন

আসাদ চৌধুরী ষাট দশকের অন্যতম প্রধান কবি। সামাজিক পারিপার্শ্বতাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করে। সাহিত্যের সব শাখাতেই তাঁর পদচারণা। মনোগ্রাহী টেলিভিশন উপস্থাপনা ও দরাজ কণ্ঠের অনবদ্য আবৃত্তির জন্য তিনি সমধিক জনপ্রিয়। ষাটের দশকের নিজস্ব ভাষা-ভঙ্গি থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করতে পেরেছেন। খুব সহজে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। প্রচলিত ধারার বাইরে থেকে সাহিত্য ভুবনে তার সদাপট বিচরণ। ছোটবেলায় তিনি প্রচুর কবিতা পড়তেন। স্কুলের অনুষ্ঠানে অনেক ছড়া, কবিতা পড়েছেন। পেট্রিস লুলুম্বার মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে তিনি কবিতা লেখেন, এটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় কবিতা। সময়টা ছিল পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে। আসাদ চৌধুরীর ভাই ‘চিত্রাকাশ’ নামের একটা পত্রিকা চালাতেন। ক্লাস লাইনে পড়ার সময় আসাদ চৌধুরীর উপলব্ধি হলো তিনি কবিতা লিখতে পারেন, লিখলেন একটা কবিতা। এটা ছিল তাঁর প্রথম কবিতা। কবিতা লেখার শুরুর গল্পটা তাঁর এ রকম। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অনুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তার কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত। তার ব্যঙ্গার্থক কবিতা ‘সত্য ফেরারি’ একটি জনপ্রিয় পদ্য। সভ্যতার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি গত কয়েক দশকে মানবিক মূল্যবোধের যে করুণ অধঃপতন, তারই প্রেক্ষাপটে একটি কবিতায় তিনি আক্ষেপ করেছেন : কোথায় পালালো সত্য? দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে, টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো। গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো, চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ, সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা, জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা, নকশী পাতিল, চৌকির তলা, সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!... তিনি সফলভাবে নিজস্ব ভাষাভঙ্গি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকৃতি প্রেম সামাজিক অবস্থান তাঁর কবিতার বিষয় আশয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল পুরনো ধারায় না লেখার। নতুন ধারায় লেখার প্রবণতা থেকে তাঁর ভাষা ভঙ্গির উন্মেষ ঘটে। তিনি এগিয়ে যান নতুন ধারার পথে। নগরে বাস করার অর্থ যদি নাগরিক কবি হওয়া হয়, তাহলে তিনি নাগরিক কবিও বটে। তাঁর মধ্যে নগরের পাশাপাশি চর থাকে, গ্রাম থাকে নদী থাকে। তিনি নাগরিক জীবনের সঙ্গে গ্রামীণ জীবন সংস্কৃতিকে একাত্ম করেছেন। সহজবোধ্য শব্দ চয়নের পাশাপাশি সরল বাক্য গঠন তাঁর কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়। এটা তাঁর নিজস্বতা হলেও তাঁর ভক্ত-পাঠক-শ্রোতা সবাই তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারেন খুব সহজে, পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য হয়, তিনি যা বলতে চান। আসাদ ধৌধুরী আন্তরিকভাবেএটাই চেয়েছেন সব সময় যে তাঁর লেখা সবাই পড়ুক, বুঝুক। তবে তিনি ইচ্ছে করে সহজভাবে লেখেন না। যা আসে ভেতর থেকে তিনি সেভাবেই লেখেন। তিনি তৈরি করেন না, যা আসে, যেভাবে আসে সেভাবেই লেখেন। সেভাবেই তাইই লেখেন। বানান না কিছু। কিন্তু কখনও কখনও তিনি কবিতার জন্য কঠিন শব্দের প্রয়োজন বোধ করেন। প্রয়োজন হলে তিনি কঠিন শব্দ প্রয়োগ করেন নির্দ্বিধায়। তবে সরলতার জন্য লেখেন না। কবিতার নতুন নতুন নিরীক্ষায় নিমগ্ন থাকেন তিনি। তাঁর অনেক দিনের চেষ্টা মন্ত্র, লোক কাহিনী, লোকগীতি সংগ্রহ করার। শুধু এদেশের নয়, বিদেশেরও। সে কারণেই বোধহয় আসাদ চৌধুরীকে বলা হয় শেকড় সন্ধানী কবি। তার কবিতায় নিরীক্ষা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ষাটের দশকের অন্য কবিদের থেকে তাকে সহজেই আলাদা করা যায়। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে অবস্থান করেও তিনি দৃষ্টিপাত করেছেন লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত বাউল জারি সারি লালন মুর্শিদ মাইজভাণ্ডারী প্রভৃতির দিকে। তিনি কখনও অব্যাহতভাবে কবিতা লেখেন, কখনও বিরতি দেন। আবার লেখেন। আমাদের দেশে শ্রেণী-সংগ্রাম প্রবল মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্তের শত্রু। নিম্নবিত্ত নিম্নবিত্তের শত্রু। বুর্জোয়া শ্রেণী তো আছেই। এর মধ্যে তাঁর বিবেচনায় তাঁর দর্শনে ‘বুর্জোয়া’ এই শব্দটি এই সমাজ গ্রহণ করে না। তিনি মনে করেন, সমাজে যে অর্থে শ্রেণী বিভাগ, শ্রেণী সচেতনতা তা আগেও ছিল এখনো আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে সহজ ভাষায় বুর্জোয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয় পশ্চিমা ভঙ্গিতে। এগুলো আমাদের সমাজ এক্সজিট করে না। আমাদের সমাজে এক পুরুষে কোটিপতি, ওয়ান জেনারেশন কোটিপতি। তাদের মধ্যে বুর্জোয়া স্বভাবের কেউ থাকার কথা না। এমন প্রতিক্রিয়া তিনি ব্যক্ত করেন। তিনি সুজন স্বপ্নের ভেলায় ভেসে বেড়ান। তার স্মৃতিপটে প্রথম কবি প্রথম বিদ্রোহীর ছবি দুলে ওঠে। তিনি উচ্চারণ করেন : মাত্র পা রেখেছ কলেজে সেই বার, শব্দ দিয়ে গাঁথো পূর্ব সীমান্তে সাহসী ‘সীমান্ত’। দ্বিজাতিতত্ত্বের লোমশ কালো থাবা শ্যামল সুন্দর সোনার বাংলাকে করেছে তছনছ, গ্রাম ও জনপদে ভীতির সংসার, কেবল হাহাকার। টেবিলে মোমবাতি কোমল কাঁপা আলো বাহিরে বৃষ্টির সুরেলা রিমঝিম- স্মৃতির জানালায় তোমার মৃদু টোকা... আসাদ চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি তাঁকে আলোড়িত করে। প্রক্ষাপট ভিন্ন যেখানে মানুষ মরতে যায়, এখন সেখানে মানুষ স্বার্থপর। নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য মানুষ মরতে গিয়েছিল। দেশের জন্য, দেশের সংস্কৃতির জন্য, দেশের সাহিত্যের জন্য, দেশের মঙ্গলের জন্য। দেশের মানুষের ভালো হবে, শোষণ বঞ্চনার অবসান হবে এই ভেবে। যারা গণহত্যা করেছে, লুটপাট করেছে, গণধর্ষণ করেছে, অগ্নি সংযোগ করেছে। প্রতিদিন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদেরকে শাস্তি দেবে, বিচার হবে। এসব মানুষের স্বপ্ন ছিলো। প্রচণ্ড দুঃস্বপ্নের মধ্যে তারা স্বপ্ন দেখেছে। গোটা জাতির জন্য এটা বড় ব্যাপার। নিকোলাস, কিউবার কবি, তিনি বলেছিলেন ‘সাবধান মানুষ স্বপ্ন দেখছে।’ একাত্তর সালে মানুষ স্বপ্ন দেখতেন, এখন দেখেন না। তরুণরা বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। দেশের জন্য বড় ত্যাগের স্বপ্ন এখন নেই। একাত্তর সালে ছিল।এমন ভাবনা থেকে তিনি উচ্চারণ করেন : নদীর জলে আগুন ছিল আগুন ছিল বৃষ্টিতে আগুন ছিল বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টিতে। আগুন ছিল গানের সুরে আগুন ছিল কাব্যে, মরার চোখে আগুন ছিল এ কথা কে ভাববে? কুকুর-বিড়াল থাবা হাঁকায় ফোঁসে সাপের ফণা শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায় জ্বলে বালির কণা... মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির সব থেকে বড় গৌরবদীপ্ত ঘটনা। একাত্তরে জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাঙালীরা পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে অংশ নেয় এবং অনেক রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। গৌরবময় এই অর্জন যেমন আনন্দের তেমন বেদনার। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিজয়গাথার পাশাপাশি নির্যাতন নিপীড়ন গণহত্যার বীভৎসতা। স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবকে ধরে রাখার জন্য ষাটের দশকের কবিরা তাদের কবিতার মাধ্যমে বাঙালী সত্তার পরিচয়ের অনন্য এই সময়কে কবিতাবদ্ধ করেছেন নানা ব্যঞ্জনায়। আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের দীপ্ত চেতনায় করুণ কথকতা তুলে ধরে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে হিরণ¥ময় আহ্বান জানান তার শব্দমালায় : বারবারা এসো, রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুূমূর্ষু মানবতাকে গাই বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই জল্লাদের শাণিত অস্ত্র সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে, দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে। কবিতার ভবিষ্যত নিয়ে অনেকে হতাশ হলেও আসাদ চৌধুরীকে কখনও হতাশাগ্রস্ত হতে দেখা যায় না। আশাবাদী তিনি সব সময়। তিনি আকালকে স্বীকার করার পাশাপাশি মনে করেন বাংলা কবিতায় শুধু নয়, গোটা পৃথিবীতে কবিতা যেন ফ্যাকাশে, রক্তহীন। কবিতা ছকের মধ্যে চলে আসছে। ছক থেকে বের হতে পারছে না। এ রকম ব্যাপার বেশি দিন থাকবে বল মনে হচ্ছে না। নতুন কবিরা আসবে, ঠিক করবে সব। রবীন্দ্রনাথের পর কত বছর রবীন্দ্র অনুসরণ চলেছে। এখনও চলছে। মফস্বলে এখনও কতজন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলেরা রবীন্দ্রনাথের গানের ভঙ্গিতে কবিতা লেখেন। আবার পরিবর্তন আসবে গোটা কবিতাই, বাংলা কবিতাই তো বটেই। আসাদ চৌধুরীর কাছে পাঠকরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসাদ চৌধুরী মনে করেন পাঠকরা এক অর্থে হচ্ছে, মূল পেট্রোন। পাঠকরা শুধু জমি দিয়ে দেবে, বাড়ি, গাড়ি করে দেবে, ঝাকায় ঝাকায় মাছ মাংস পাঠাবে কবির বাড়িতে এটা ঠিক না। পাঠক যদি কবিতার বই কেনে কবিতার রয়েলিটি কবি পাবে। পাঠকরা কবিতার প্রাণ। পাঠকদের কাছে তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রত্যাশা করেন।
×