
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে ছিলো এক রাজ্য। রাজ্যটির নাম আখরোটাবাদ। সেখানে অনেক আখরোট ফল ফলতো। আর আখরোট খেয়ে খেয়ে সে রাজ্যের মানুষগুলো রূপে, যৌবনে ছিলো অনন্য। তার মধ্যে সবচাইতে সুন্দর ছিলো সেই রাজ্যের রাজকন্যা দিলশান গুলরুখ। রাজকন্যা গুলরুখ যৌবনে পদার্পণ করলে তার রূপের খবর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো। গুলরুখের বাবা রাজা সেকেন্দার সেরনিয়াবাতের কাছে বিভিন্ন রাজা, বাদশা, রাজকুমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো। কিন্তু রাজকন্যা দিলশান গুলরুখ সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলো এই বলে যেÑ তার বর হতে হবে তার মনের মতো দুঃসাহসী এক পুরুষ। যে হবে কিনা খুব আ্যডভেঞ্চারপ্রিয়।
এমন পাত্র আর পাওয়া যায় না। রাজকন্যা গুলরুখেরও আর বিয়ে করা হয় না। এভাবে দিন কাটতে লাগলো। একদিন হয়েছে কি, আরব সাগরে অবস্থিত পান্না দ্বীপের এক ভয়ংকর ড্রাগন নাক-মুখ দিয়ে আগুন ছাড়তে ছাড়তে আখরোটাবাদের আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। তার নাম জমেই গরিনিচ। রাজকন্যা গুলরুখ তখন রাজকীয় দিঘির বিশাল শান বাঁধানো ঘাটে গোসল করছিলো। সেই ভয়ংকর ড্রাগনের চোখ পড়লো রাজকন্যা দিলশান গুলরুখের উপর। আর যায় কোথায়? রাজকন্যাকে ড্রাগনের ভালো লেগে গেল।
সে রাজকন্যাকে খপ করে ধরে নিয়ে চললো তার পান্না দ্বীপের হিরের তৈরি এক রাজপ্রাসাদে। রাজকন্যার দেহরক্ষীরা তাকে বাঁচাতে ড্রাগনের পিছু পিছু ধাওয়া করতেই ড্রাগন তাদেরকে মুখ দিয়ে আগুন ছুঁড়ে পুড়িয়ে মারলো। তখন সে বিনা বাধায় এগিয়ে চললো পান্না দ্বীপের দিকে। সেখানে গিয়ে সে রাজকন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। রাজকন্যা গুলরুখ তো কিছুতেই রাজি না। তখন ভয়ংকর ড্রাগনটির ভীষণ রাগ হলো। সে রাজকন্যাকে একটা নীলকান্ত মণির তৈরি বোতলে আটকে রাখলো।
প্রতিদিন সারা পৃথিবী ঘুরে অনেক রাজ্যে অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ড্রাগনটি রাতে হীরের রাজপ্রাসাদে ফিরে নীলকান্ত মণির বোতলটি খুলতো আর রাজকন্যা গুলরুখকে জিজ্ঞেস করতো সে বিয়েতে রাজি কিনা। কিন্তু রাজকন্যা রাজি হতো না। তখন ড্রাগনটি খুব রাগ হয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠতো আর বোতলের মুখ বন্ধ করে দিয়ে ভোর হতেই আবার পৃথিবীতে চড়ে বেড়াতে বেরিয়ে যেতো।
এদিকে রাজকন্যা গুলরুখকে ড্রাগনে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই আখরোটাবাদ রাজ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল। রাজা সেকেন্দার সেরনিয়াবাত ঘোষণা করলেন, যে রাজকন্যা গুলরুখকে ড্রাগনের কবল থেকে উদ্ধার করতে পারবে, তাকে অর্ধেক রাজত্ব দান করা হবে। একথা শুনে সে দেশের কোতোয়াল পুত্র ফয়সাল মীর রাজা সেকেন্দার সেরনিয়াবাতের দরবারে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। বলল, রাজা মশাই, আমি যাবো ঐ ভয়ংকর ড্রাগনের সাথে লড়াই করে রাজকন্যা দিলশান গুলরুখকে উদ্ধার করে আনতে আর এর বিনিময়ে অর্ধেক রাজত্ব আমি চাই না। এই রাজ্যে সবার মুখে আবার হাসি ফুটতে দেখলেই আমি খুশি।
রাজা সেকেন্দার সেরনিয়াবাত তখন কোতোয়াল পুত্র ফয়সাল মীরকে অনেক আশীর্বাদ করে বিদায় দিলেন। কোতোয়াল পুত্র ফয়সাল মীর অজানার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললো। অনেক দিন, নাকি অল্প দিন, অনেক পথ, নাকি অল্প পথ, অনেক রাজ্য, অনেক পাহাড়, মরুভূমি পার হয়ে ফয়সাল মীর একটা বিশাল মাঠের সামনে এসে পড়লো।
সে এক ধু ধু তেপান্তর। সে এগিয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু পথ যেনো আর ফুরায় না। তারপর অনেক অনেকক্ষণ পর কোতোয়াল পুত্র দেখলো একটা বিশাল মুরগির ডিমের উপর দাঁড়িয়ে একটা চৌচালা ঘর বনবন করে ঘুরছে। কোতোয়াল পুত্র ফয়সাল মীর তখন বলল, ও ঘর, ও জাদুর ঘর তোমার ঘোরাঘুরি থামিয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াও। চৌচালা ঘরটি তখন স্থির হয়ে ফয়সাল মীরের সামনে দাঁড়ালো। ভেতরে মহা জাদুকরী, মহাজ্ঞানী মা ইয়াগা চড়কাতে সুতা কাটছিলো। সে বলে উঠলো, কেগো তুমি? মানুষের সন্তান নাকি? তা কি মনে করে?
ফয়সাল মীর বলল, আমি এক কোতোয়ালের ছেলে বুড়ি মা, চলেছি রাজকন্যা গুলরুখকে পান্না দ্বীপের ড্রাগনের কবল থেকে উদ্ধার করতে। তুমি কি পারবে আমাকে সাহায্য করতে? বুড়ি মা ইয়াগা বলল, সেতো এক জাদু রাজ্য। আহা বাছা, আগে খাও দাও, গোসল করো, একটু ঘুমাও, তারপর কাজের কথা হবে। সে ব্যস্ত হয়ে একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে ফয়সাল মীরকে খেতে দিলো। ফয়সাল মীর খেয়ে, গোসল করে ঘুমিয়ে পড়লো। যখন সে জাগলো, তখন বিকেল।
মা ইয়াগা বলল, পান্না দ্বীপ, সেতো অনেক দূরে। এই নাও তোমাকে একটা ম্যাজিক কার্পেট দিলাম। এটায় চড়ে তুমি পান্না দ্বীপে যাবে। আর এই নাও এক বোতল জাদুর পানি, এটা ছিটিয়ে দিলে সব জাদু কেটে যাবে। আর এটি নাও, এটা হলো শক্তিশালী জাদুর তলোয়ার সিমবা, এটা দিয়ে তুমি যে কোন ভয়ঙ্কর আক্রমণ ঠেকাতে পারবে। এটা এতোই শক্তিশালী যে পান্না দ্বীপের ড্রাগনও এর কাছে পরাজিত হবে। তবে ড্রাগনটি হার মানলে তাকে তুমি মেরো না।
কোতোয়াল পুত্র ফয়সাল মীর বুড়ি মা ইয়াগাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে ম্যাজিক কার্পেটে চড়ে বসলো। বাতাসের মতো সেই ম্যাজিক কার্পেট উড়ে চলল পান্না দ্বীপের উদ্দেশ্যে। দেখতে দেখতে পান্না দ্বীপ এসে পড়লো। পান্না দ্বীপটা ভয়ঙ্কর সবুজ। মাঝখানে তার বিশাল হীরের তৈরি প্রাসাদ। হীরের তৈরি সে বিশাল প্রাসাদের দরজাটা সোনার তৈরি। রোদ লেগে সেটি ঝলমল করছে। ফয়সাল মীর বুঝলো, এটি জাদু দিয়ে তৈরি প্রাসাদ। সে জাদুর বোতল থেকে কিছু পানি প্রাসাদের দিকে ছুঁড়ে মারলো। আর সাথে সাথে হীরের প্রাসাদের হীরে আর সোনাগুলো গলে গিয়ে চিকচিক করতে করতে মাটিতে মিশে গেলো।
মীর ভালো করে তাকিয়ে দেখলো হীরের প্রাসাদের শূন্যস্থানে একটা বিরাট বোতল নড়ছে। কোতোয়াল পুত্র দৌড়ে বোতলটার কাছে আসতেই দেখলো তার ভিতরে বন্দী হয়ে আছে রাজকন্যা দিলশান গুলরুখ। জাদুর বোতল থেকে আরেকটুখানি পানি নিয়ে বড় বোতলটার দিকে ছুঁড়ে মারলো, আর সাথে সাথে বোতলটা ভেঙে অদৃশ্য হয়ে রাজকন্যা মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসলো।
রাজকন্যা দিলশান গুলরুখ কোতোয়াল পুত্র ফয়সাল মীরকে আগে থেকেই চিনতো। সে মুক্তির আনন্দে দৌড়ে এসে মীরকে জড়িয়ে ধরলো। সেই সাথে তাদের মনের মধ্যেও ভালোবাসা দোলা দিয়ে গেল। বোতলটা যখন ভেঙে যাচ্ছিলো, তখন থেকেই বাতাসে একটা চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে গর্জন আরো স্পষ্ট হলো। ড্রাগন জমেই গরিনিচ ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নিচে নেমে এলো। নিচে নেমেই সে ফয়সাল মীরের দিকে এক ঝলক আগুন ছুঁড়ে মারলো। ফয়সাল মীর মা ইয়াগার দেয়া তলোয়ার সিমবাকে আগুনের দিকে ফেরাতেই আগুনের ঝলকটা তলোয়ারে প্রতিফলিত হয়ে ভীষণভাবে ড্রাগনের বুকে এসে লাগলো। এভাবে যতবার ড্রাগনটা আগুন ছুঁড়ে মারে, তা তলোয়ারে লেগে তার শরীরেই আঘাত হানে।
এভাবে ক্রমে ক্রমে ড্রাগনটি দুর্বল হয়ে যেতে লাগলো। তারপর একসময় আর্তনাদ করে বলল, বুঝেছি, এই তলোয়ার তো আমার খালা মা ইয়াগার। এর সাথে আমি কিছুতেই পারবো না। আমাকে ছেড়ে দাও বীর সুজন। আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কোনোদিন মানুষের বসতিতে আসবো না। দূরের বন-পাহাড়ে থাকবো। কোতোয়াল পুত্র ফয়সাল মীরের মনে তখন দয়া হলো। সে ড্রাগনকে ছেড়ে দিলো। ড্রাগনটি উড়তে উড়তে চলে গেলো দূর পাহাড়ের দিকে। আর ফয়সাল মীর ও রাজকন্যা দিলশান গুলরুখ তখন ম্যাজিক কার্পেটে করে ফিরে এলো আখরোটাবাদ রাজ্যে। রাজা-রাণীসহ সবাই খুব খুশি। কিছুদিন পরেই বেজে উঠল দুজনের বিয়ের বাদ্য। রাজ্য জুড়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো।
প্যানেল