
শুধু গভীর রাতে নয়, জীবনের নানা মুহূর্তে আমরা নিজের অজান্তেই এক অদ্ভুত মানসিক টক শোয়ের মধ্যে আটকে পড়ি একটার পর একটা অপ্রয়োজনে ভেসে ওঠে পুরনো ভুল, ভবিষ্যতের আশঙ্কা কিংবা কাল্পনিক বিতর্ক। এই নিরবচ্ছিন্ন মানসিক আওয়াজ ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলে আমাদের মন-শরীরকে। অথচ, আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না এই অতিচিন্তা (overthinking) নিছক এক অভ্যাস নয়, বরং এটি ক্লান্তি, অনিদ্রা, এমনকি উদ্বেগ ও বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বেশিরভাগ পরামর্শ তখনই আসে ধ্যান করুন, শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করুন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি মন তাতেও বসতে না চায়?
ঠিক তখনই সহায়ক হতে পারে 'কগনিটিভ শাফলিং' নামে এক অভিনব মানসিক কৌশল। শব্দটি যতটা বৈজ্ঞানিক শোনায়, পদ্ধতিটি ততটাই সরল ও খেলাধুলার মতো মজার। কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট লুস বোদোইন এই কৌশলটির প্রচলন করেন, যা পরে স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণাতেও সমর্থন পায়।
কী এই কগনিটিভ শাফলিং?
ভাবুন, আপনার মনে এলোমেলোভাবে কিছু শব্দ ছুঁড়ে দিলেন আপেল, মই, মেঘ, সোয়েটার, কমলা। কোনও ধারাবাহিকতা নেই, যুক্তিও নেই। এইভাবে যখন মন একধারার চিন্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে এলোমেলো পথে হাঁটতে থাকে, তখন তা স্বপ্নের মতো এক ধরণের বিশ্রাম এনে দেয়। বিজ্ঞান বলছে, এই এলোমেলোতা মস্তিষ্কের সেই স্বাভাবিক প্রবণতাকেই অনুকরণ করে, যা ঘুম বা গভীর বিশ্রামের আগে ঘটে থাকে।
ধারণাটি সহজ: মস্তিষ্ক যখন কোনও কিছুর অর্থ খোঁজার চেষ্টা বন্ধ করে দেয়, তখন অতিচিন্তার ঘূর্ণি থেকেও বেরিয়ে আসে।
শুধু ইতিবাচক চিন্তা নয়, চাই ‘ননসেন্স’ চিন্তা
অনেক সময় আমাদের বলা হয় 'ইতিবাচক ভাবুন', 'ভেড়া গুনুন'। কিন্তু সেগুলোও মনকে একরৈখিক চিন্তার ভেতর আটকে রাখে। কগনিটিভ শাফলিং ঠিক তার বিপরীত—এটি চিন্তার ধারাবাহিকতাকে বিঘ্নিত করে, যেন কোনও গল্প তৈরি না হয়, বরং শুধু নিঃসত্তার ছবিগুলো এসে-যায়।
এভাবেই অতিচিন্তার চক্রটিকে ভেঙে দিয়ে মনকে এক নতুন ধরণের বিশ্রামে নিয়ে যায় এই কৌশল।
কীভাবে করবেন এই কগনিটিভ শাফলিং?
রাতের ঘুমের আগে কিংবা যখনই মনের ভিতর শব্দের কোলাহল বাড়ে, শুরু করুন একটি এলোমেলো অক্ষর বেছে নিয়ে ধরা যাক, ‘স’। এবার চিন্তা করুন এমন পাঁচটি অদ্ভুত, অসম্পৃক্ত জিনিস সূর্য, স্যান্ডেল, সাপ, সোয়েটার, সিংহ। প্রতিটি শব্দ কল্পনায় একটু করে দেখুন, তারপর পরবর্তী শব্দে যান। কোনও গল্প নয়, যুক্তিও নয় শুধু ছবি।
পাঁচ থেকে সাতটি শব্দ কল্পনার পর আবার নতুন একটি অক্ষর বেছে নিন। কোনও শব্দ কল্পনা করতে কষ্ট হলে সেটি বাদ দিন, কোনও সমস্যা নয়। লক্ষ্য একটাই মস্তিষ্ককে তার স্বাভাবিক ধারা থেকে আলগা করে হালকা ঘুমের মতো স্থিতিতে নিয়ে যাওয়া।
প্রায় ৫–১০ মিনিটেই আপনি অনুভব করবেন, মন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে, ঘুম আসছে বা অন্তত চিন্তার ঘূর্ণিপাক থেমে যাচ্ছে।
এই কৌশলের সৌন্দর্য এর সহজতা
এখানে মন ফাঁকা করার চাপ নেই, শ্বাস নেওয়ার নিয়ম নেই, এমনকি ধ্যানের মতো নির্দিষ্ট ভঙ্গি রাখারও প্রয়োজন নেই। এটি ধ্যান নয়, কিন্তু ততটাই প্রশান্তিদায়ক বরং অনেকের জন্য হয়তো আরও সহজলভ্য।
শুয়ে থাকতে থাকতে, বাসের অপেক্ষায় বা ব্যালকনিতে বসে থেকেও এটি করা যায়। কোনও অ্যাপ, ধূপ কিংবা নিস্তব্ধতা দরকার হয় না শুধু কল্পনা শক্তিই যথেষ্ট। ধীরে ধীরে এই অভ্যাস মনকে একটি সংকেত দিতে শেখায় এখন সময় থামার, নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার।
এলোমেলো চিন্তাই কেন কার্যকর?
চমকপ্রদ হলেও সত্য, উদ্বেগপূর্ণ অবস্থায় মস্তিষ্ক আসলে যুক্তি চায় না, চায় অর্থহীন কিছুতে আশ্রয়। সেই কারণেই মানুষ অতিরিক্ত সিরিজ দেখে কিংবা অনর্থক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে। এগুলো তাকে নিজের চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়।
কগনিটিভ শাফলিংও তেমনই এক আশ্রয়, তবে আরও স্বাস্থ্যকর ও ঘুম-বান্ধব। এটি চিন্তার গোলকধাঁধায় না রেখে সেগুলোকে আলতো করে ছিঁড়ে দেয়। যেন একরাশ এলোমেলো স্বপ্ন এসে বলে 'এখন কিছু ভাবতে হবে না'।
অতিচিন্তা শুধু ঘুম কেড়ে নেয় না, মনের স্বস্তিও নষ্ট করে। তাই যদি মস্তিষ্ক অকারণে কথা বলে চলে, তাকে থামানোর জন্য চেষ্টা করে দেখুন ‘কগনিটিভ শাফলিং’। এতে না আছে নিয়ম, না আছে কাঠামো তবু শান্তি আছে। মাঝে মাঝে এলোমেলো ভাবনাই মনকে সবচেয়ে নির্ভার করে। এখন শুধু দরকার নিজের কল্পনাকে কাজে লাগানো একটুকরো শান্তির খোঁজে।
সূত্র:https://tinyurl.com/2sm4k4mx
আফরোজা