
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-ব্যয় কিংবা সেমিস্টার ফি সাধারণত নির্ধারিত হয় সেখানে প্রদত্ত শিক্ষাদানের মান, অবকাঠামো এবং সার্বিক শিক্ষা-পরিবেশের উপর ভিত্তি করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এই ব্যয়ের প্রায় পুরোটা অংশই সরকারিভাবে বহন করা হয়ে থাকে। অপরদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইনস্টিটিউটসমূহে এই ব্যয়ভার বহন করতে হয় মূলত শিক্ষার্থীদেরকেই।
তবে সময়ের সাথে সাথে এই শিক্ষা-খরচের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকায় অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা দিন দিন দুষ্কর হয়ে উঠছে। সাভারস্থ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ (নিটার)-এর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও তাদের সেমিস্টার ফি নিয়ে রয়েছে নানা রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এই প্রেক্ষাপটই তুলে ধরেছেন দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার মিঠুন দাস মিঠু।
মেরাজ হোসেন সিয়াম, শিক্ষার্থী (৪র্থ বর্ষ), নিটার
নিটারে বর্তমানে শিক্ষার মান মোটামুটি গড় পর্যায়ে রয়েছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। বিশেষ করে টেক্সটাইল বিভাগের নন-ডিপার্টমেন্টাল বিষয়গুলোর পাঠদানে ঘাটতি রয়েছে। গত তিন বছর ধরে চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে শিক্ষকরা যেসব টপিক পড়ান, তার সঙ্গে প্রশ্নের সামঞ্জস্যতা থাকে না।
অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে, শিক্ষকরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও প্রজেক্টরের অভাবে ক্লাসে বোর্ডে লিখতেই অধিক সময় ব্যয় হয়। ফলে পাঠদান ব্যাহত হয় এবং শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান সম্ভব হয় না। ল্যাবভিত্তিক শিক্ষায় টেকনিক্যাল অফিসাররা দক্ষ ও আন্তরিক হলেও অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকার কারণে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যায়।
শিক্ষার মান উন্নয়নে ক্লাসে প্রজেক্টরের ব্যবস্থা, ল্যাবে আধুনিক যন্ত্র সংযোজন, ল্যাবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, লাইব্রেরির পরিবেশ উন্নয়ন এবং নিয়মিত ফিডব্যাক গ্রহণ জরুরি। বর্তমান সেমিস্টার ও ভর্তি ফি অধিক হওয়ায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারছে না। তাই ফি যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা উচিত। পাশাপাশি, অভিজ্ঞ শিক্ষকরা কেন বারবার নিটার ত্যাগ করছেন, সেই কারণ অনুসন্ধান করে তা বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
মুজাহিদুল ইসলাম আলিফ, শিক্ষার্থী (৩য় বর্ষ), নিটার
নিটারে বর্তমান যেভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তা গড়পড়তা মানদণ্ডে পেছানোর সামিল বললেই চলে। সেমিস্টার ফি অনুযায়ী পাঠদানের মান সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অধিকাংশ শিক্ষক সিলেবাস, পাঠদান ও ম্যাটেরিয়াল প্রদানে উদাসীন। যদিও বেশিরভাগ শিক্ষক ক্লাস নেন, কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার অতিরিক্ত উদাসীনতা লক্ষণীয়।
ল্যাবভিত্তিক শিক্ষা মোটামুটি ঠিক থাকলেও অনেক মেশিন নষ্ট থাকায় কার্যকর প্র্যাকটিক্যাল শেখায় বাধা আসে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করলেও একাডেমিক ও প্রশাসনিক সাপোর্ট ফি অনুযায়ী সন্তোষজনক নয়। ল্যাব ও লাইব্রেরি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় নিটারের টিউশন ফি তুলনামূলক বেশি এবং শিক্ষার মান ধীরে ধীরে নিম্নমুখী হয়ে যাচ্ছে।
নাসরা তাসনিম, শিক্ষার্থী (৩য় বর্ষ), নিটার
নিটারে পাঠদানের মান মোটামুটি ভালো, তবে প্রদত্ত শিক্ষার তুলনায় সেমিস্টার ফি আরও যুক্তিসংগত করা যেতে পারে। অধিকাংশ শিক্ষক নিয়মিত, দায়িত্বশীল এবং শিক্ষার্থীদের সহায়তায় সদা প্রস্তুত থাকেন। ল্যাব ক্লাসগুলো যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং বিষয়বস্তু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
তবে ২.৫ ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ ক্লাসগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) না থাকায়, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে, পরিবেশ খুবই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। কিছু ল্যাবে শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথকভাবে হাতে-কলমে অনুশীলনের সুযোগ সীমিত, যা আরও উন্নত করা প্রয়োজন।
যদিও একাডেমিক সহায়তা এবং মৌলিক সুবিধাসমূহ মোটামুটি সন্তোষজনক, তবে ইন্টারনেটের গতি, আধুনিক ল্যাব সরঞ্জাম এবং লাইব্রেরির রিসোর্স আপডেটের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মতামত উন্নয়নের জন্য গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। সেমিস্টার ফি’র সাথে মানানসই শিক্ষাসেবা নিশ্চিত করতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়নে, বিশেষ করে ল্যাবে এসি স্থাপন ও ইন্টারনেট সংযোগ শক্তিশালী করার দিকে জোর দেওয়া উচিত।
আনিকা তাবাসসুম, শিক্ষার্থী (২য় বর্ষ), নিটার
নিটারে পাঠদান বনাম ফি—এই দুটি শব্দই আজ শিক্ষার্থীদের আলোচনার কেন্দ্রে। পাঠদানের নিয়মিততা থাকলেও গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। শুধু ক্লাস নেওয়া মানেই শেখানো নয়, বরং মানসম্মত উপস্থাপনা ও বোঝানোর গভীরতা এখনো অনুপস্থিত।
ল্যাবভিত্তিক শিক্ষা তুলনামূলকভাবে উন্নত হলেও প্রযুক্তিগত আপডেট এবং দক্ষ নির্দেশনার অভাব খুবই স্পষ্ট। ইয়ার্ন ল্যাবের কোনো মেশিন কখনো চলতে দেখা যায়নি, অথচ সেই ল্যাবের কোর্স শেষ হয়ে যায়। এত টাকা ফি নেওয়া সত্ত্বেও ইন্টারনেট, লাইব্রেরি এবং সফট স্কিল উন্নয়নে বড় ঘাটতি রয়েছে।
যদিও ফিডব্যাক নেওয়া হয়, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কম—ফিডব্যাক যেন কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ। শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রশাসনের প্রতি সুপারিশ থাকবে: শিক্ষক প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া, ল্যাব ও লাইব্রেরি আপগ্রেড, ফি পুনর্মূল্যায়নের আগে শিক্ষার্থীদের মতামত শোনা এবং প্রশাসনিক সহায়তা আরও দ্রুত ও সহানুভূতিশীল করা। নিটার যদি সত্যিই ‘Centre of Excellence’ হতে চায়, তবে শুধু অবকাঠামো নয়, মানের প্রতিও যথাযথ দায়বদ্ধতা নিতে হবে।
অনিরুদ্ধ সিকদার অন্তু, শিক্ষার্থী (২য় বর্ষ), নিটার
নিটারে ক্লাসরুম ও ল্যাবগুলোর মান মোটামুটি ভালো হলেও সংখ্যার দিক থেকে তা খুবই কম। এখানে কাঠামোগত অনেক সুবিধার অভাব রয়েছে। ক্লাসরুম আর ল্যাব বাদ দিলে, একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব স্ট্রাকচার থাকা উচিত, তার অনেক কিছুই নিটারে অনুপস্থিত—যা অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিকভাবে দেখা যায়।
যদি কোনো দাবি করতে হয়, তাহলে আমি অতিরিক্ত ক্লাসরুম নির্মাণ এবং টিনশেড স্থায়ীভাবে হল হিসেবে নির্মাণের দাবি করতাম। নইলে প্রতি সেমিস্টারে যে ২৯ হাজার টাকা ফি নেওয়া হয়, তা কমিয়ে ২০ হাজার করা উচিত। নিটার আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরাসরি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা কঠিন হলেও, শিক্ষার্থীরা যে পরিমাণ ফি দিচ্ছেন, তার বিনিময়ে উপযুক্ত পরিকাঠামো ও সুবিধা পাওয়া তাদের ন্যায্য অধিকার—কিন্তু নিটার সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ।
মেহেদী হাসান মাহিন, শিক্ষার্থী (২য় বর্ষ), নিটার
নিটার একটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রতি চার মাস অন্তর শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফি দিতে হয়। তবে এই ফি’র পরিমাণের সঙ্গে শিক্ষার মানের কোনো সামঞ্জস্য নেই। স্বাধীন চিন্তা বা সৃজনশীলতার জন্য এখানে পরিবেশ নেই বললেই চলে; শিক্ষাজীবন সিলেবাসের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই—৩০ জন ধারণক্ষমতার কক্ষে ৭০ জন শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে ক্লাস করে, নেই পর্যাপ্ত প্রজেক্টর বা আধুনিক টুলস। প্রশ্ন ওঠে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও, অনেক শিক্ষকই ক্লাসে ভালোভাবে বোঝাতে পারেন না— এমনকি দুই বেঞ্চ পেছনে বসলেই কিছুই শোনা বা বোঝা যায় না। ফলে গুগল, ইউটিউব বা চ্যাটজিপিটির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক নেওয়া যেন স্বপ্ন— কারণ, বন্ধুসুলভ সম্পর্ক না থাকলে শিক্ষকরা ফিডব্যাক কিভাবে নেবেন? ক্লাসে শুধু স্লাইড স্ক্রল করলেই পাঠদান সম্পন্ন হয় না, বরং শিক্ষার্থীরা বুঝছে কি না তা যাচাই করে সেই অনুযায়ী ক্লাস পরিচালনা করা জরুরি। একটি সহায়ক ও মানবিক শিক্ষা-পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষকদের আরও সংবেদনশীল ও শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক হতে হবে।
এম.কে.