ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

সিটি করপোরেশনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভয়াবহ চিত্র

শিক্ষকে ঠাসা, নেই শিক্ষার্থী

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ২৭ জুলাই ২০২৫

শিক্ষকে ঠাসা, নেই শিক্ষার্থী

সরকারি প্রাথমিকগুলো তীব্র শিক্ষার্থী সংকটে

দেশের সব সিটি করপোরেশন (মহানগরী) এলাকার সরকারি প্রাথমিকগুলো তীব্র শিক্ষার্থী সংকটে ধুঁকছে। স্কুলগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকের কোনো সংকট নেই। একাধিক স্কুল রয়েছে যেখানে পদের চেয়ে বেশি শিক্ষক কর্মরত আছেন। কোনো কোনো স্কুলে প্রেশনে (সংযুক্তিতে) শিক্ষক নিয়ে আসা হয়েছে। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ একটি জরিপেই এমন তথ্য উঠে এসেছে। 
জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ স্কুলেই তিনজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। এমন পরিস্থিতির পরও ১০টি সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৫৩৪টি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। তবে এর বরাদ্দের বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই।
ঢাকা সিটি করপোরেশনে মোট ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এই সিটি করপোরেশনের একটি স্কুল হলো মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুই শিফটে চলে এই স্কুল। সবমিলিয়ে স্কুলটির শিক্ষার্থী সংখ্যা ২১ জন। অথচ এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ আছে ৫ জন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩। অর্থাৎ মাত্র তিনজন শিক্ষার্থীর জন্য পাঠদান করাচ্ছেন একজন শিক্ষক। এই স্কুলে প্রাক প্রাথমিকে রয়েছে মাত্র ২ জন শিক্ষার্থী। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি আছে ৫ জন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতেও শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ জন করে। আর পঞ্চম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী আছে মাত্র ২ জন।
এই সিটি করপোরেশনের আরেকট স্কুল শহীদ আনোয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুই শিফটের এই স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪৯ জন। অন্যদিকে শিক্ষকের পদ আছে ১৫ জন। অর্থাৎ প্রতি ৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য আছেন ১ জন শিক্ষক। স্কুলটিতে আরও দুই শিক্ষক প্রেষণে কর্মরত আছেন। 
প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষার পরিবেশ, মান ও নানা কারণে ঢাকা শহরের সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ভর্তি সংখ্যা বাড়ছে না। প্রাথমিক শিক্ষক, শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কেউ তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে পড়ান না। ফলে দিন দিন শিক্ষার্থী কমছে আর শিক্ষক আনুপাতিক হারে বাড়ছে।
ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অধীন ৮৬টির মতো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। অন্তত ১০টি সরকারি প্রাথমিক রয়েছে, যার কোনোটার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৯, আবার কোনোটির ১:১৩। এরমধ্যে একটি স্কুলের নাম সিটি কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুই শিফটের এই স্কুলে শিক্ষক ও  শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৯। এই স্কুলে এই শিক্ষার্থী থাকলেও তা অনিয়মিত। জরিপে এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মেথর কলোনিতে স্কুলটি অবস্থিত হওয়ায় অন্য শিক্ষার্থীরা আসে না।
সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:২৮। এসব স্কুলে কর্মরত শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৪ জন। প্রাথমিক অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, উন্নয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পে ব্যয় করা হচ্ছে কয়েকশ’ কোটি টাকা। 
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কারের নেতৃত্ব দেওয়া ড. মনজুর আহমদের মতে, প্রাথমিক শিক্ষায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে তা সেভাবে কাজে আসছে না। দৃষ্টিন্দন স্কুল নির্মাণ বা এই নামের মধ্যেই বৈষম্য লুকিয়ে আছে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, নগর এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী কমলেও শিক্ষকের জন্য সুপারিশের কমতি নেই। তারা এখানে আসতে চান কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানোর জন্য। শিক্ষার মান উত্তরণে শিক্ষকদের ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে চরাঞ্চলে প্রক্সি শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন আর মহানগরীতে শিক্ষার্থীই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, প্রাথমিক অধিদপ্তরের এসব স্কুলের শিক্ষকরাও তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ান না। তারা পাশের বেসরকারি স্কুলে পড়ান। শিক্ষার মানের বিষয়টি উপলব্ধি করেই তারা এমন উদ্যোগ নিচ্ছেন। আসলে মান বাড়ানো না গেলে কোনোভাবেই দৃষ্টি নন্দন স্থাপনা শিক্ষার্থীর হার বাড়াতে পারবে না।
গাজীপুর মহানগরীর রওশন এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টিও দুই শিফটে চলছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত মাত্র ১:৮। এই মহানগরীর ধোবাপাড়া টেকবাড়ি বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী আছে ৫৭ জন। দুই শিফটের এই স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত মাত্র ১:৭। এই বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাত্র ৭ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে মাত্র ৫ জন ও চতুর্থ শ্রেণিতে ৪ জন শিক্ষার্থী পড়ছে। একই সঙ্গে কুমিল্লার আনছর আলী সরকারি প্রাথমিকের  শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৭।

এই বিদ্যালয়ে দুই শিফটের এই স্কুলে এক জন শিক্ষক প্রেশনে কর্মরত আছেন। বিদ্যালয়টির কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা সাতজন। চট্টগ্রামের খাগড়িয়া ছড়া বিদ্যালয়টি পাঁচলাইশে অবস্থিত। দুই শিফট মিলিয়ে এই স্কুলে শিক্ষার্থী রয়েছে ৭১ জন। শিক্ষক ও ছাত্র অনুপাত মাত্র ১:৬। এই মহানগরীর বান্ডেল এস কলোনি বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত আরও কম। বিদ্যালয়টিতে প্রতি ৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। খুলনা মহানগরীর রহিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। অথচ স্কুলটিতে রয়েছে দুইটি শিফট। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৪। একই সঙ্গে পল্লী মঙ্গল সরকারি প্রাথমিকে এই চিত্র ১:৫ জন।
জরিপের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী- রাজশাহী মহানগরীতে এমন একাধিক সরকারি প্রাথমিক রয়েছে যার শিক্ষক ও  শিক্ষার্থী  অনুপাত ১:১০ এর আশপাশে। ময়মনসিংহ মহানগরীতে কাচিঝুলি সরকারি প্রাথমিকে ১৫৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এই স্কুলটিও চলছে দুই শিফটে। যে কারণে বিদ্যালয়টির শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত ১:১০। বিদ্যালয়টিতে ২ জন অতিরিক্ত শিক্ষক কর্মরত আছেন। রংপুর মহানগরীতে এমন অন্তত ১০টি সরকারি প্রাথমিক রয়েছে যার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত ১:১০ এর নিচে।

অথচ দেখা যাচ্ছে এসব স্কুলও চলছে ২ শিফটে। এরমধ্যে নেকার পাড়া স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৬। কিশামত বিষু স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাতও একই। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দেখা যাচ্ছে বরিশাল মহানগরীর। এমন একাধিক স্কুলও রয়েছে যেখানে প্রতি দুইজন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একজন শিক্ষক। এরমধ্যে হরিজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চরজাগুয়া স্কুল অন্যতম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের শিক্ষার ভিত্তি। এটি নড়বড়ে হলে আমরা আর এগুতে পারব না। যে কারণে দেখছি প্রাথমিক শেষ করেও অনেকে কোনো কাজে যোগ দিতে পারছে না। আবার যারা মাধ্যমিক শিক্ষায় যাচ্ছে তাদের বড় অংশ ফেল করছে। উচ্চমাধ্যমিকে এই হার আরও বেশি। সর্বশেষ বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করছে। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলগুলো যা রয়েছে তার অবস্থা এত খারাপ না।

কিন্তু শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আমরা প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে পারিনি। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ উপজেলা ভিত্তিক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক বলের কারণে অনেকেই পদ না থাকার পরও মহানগরীতে পোস্টিং নিচ্ছে। আর এসেই কোচিং বাণিজ্যে জড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন পোভার্টি ম্যাপিং করে শিক্ষায় বিনিয়োগ করা হলে এমন দূরবস্থা দেখা লাগবে না। এ ছাড়াও এলাকাভিত্তিক ও চাহিদাভিত্তিক বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, মহানগরীতে প্রাথমিক শিক্ষায় যে বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার সিকিভাগ চা অধ্যুষিত সিলেটে করা হলে সেখানকার আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব হতো।

প্যানেল হু

আরো পড়ুন  

×