
ছবি: প্রতীকী
আমাদের প্রতিদিনের জীবনে মোবাইল ফোন যেন এক মুহূর্তের সাথী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন শুরু থেকে রাতের ঘুম পর্যন্ত, আমরা প্রায় সবসময়ই ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকি। তবে বিশেষ করে ঘুমানোর আগের সময়টা, যখন আমরা শুয়ে শুয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন নাড়ি, তখন এই অভ্যাসটা আমাদের ঘুমের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এই সমস্যাটি অনেকেরই অজান্তে হয়ে যাচ্ছে, অথচ এর ফলাফল ভীষণ ক্ষতিকর।
ঘুমানোর আগে ফোন ব্যবহারের অন্যতম বড় ক্ষতি হচ্ছে ঘুমের সময় কমে যাওয়া। আমরা অনেকেই ভাবি, “একটু ফেসবুক দেখি”, “দুই মিনিট ইউটিউবে চোখ রাখি”, “একটা মেসেজের রিপ্লাই দেই” — কিন্তু এই ‘দুই মিনিট’ই হয়ে যায় আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা। এতে ঘুমানোর নির্ধারিত সময় পিছিয়ে যায়, ফলে ঘুমের ঘাটতি দেখা দেয়। এই ঘাটতি প্রতিদিন জমতে জমতে শরীর ও মনের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
ফোনের স্ক্রিন থেকে যে আলো বের হয়, তাকে বলে ব্লু লাইট। এই ব্লু লাইট আমাদের মস্তিষ্ককে বুঝিয়ে দেয় যে এখনো দিন, এখনো জেগে থাকার সময়। ফলে আমাদের শরীর যে ঘুমের হরমোন (মেলাটোনিন) তৈরি করে, সেটার পরিমাণ কমে যায়। যার ফলে ঘুম আসতে দেরি হয় বা ঘুম আসলেও সেটা হয় হালকা এবং অস্থির। অনেকে মাঝরাতে ঘন ঘন জেগে ওঠেন, বারবার ঘুম ভেঙে যায়। আবার কেউ কেউ একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহজে আর ঘুমোতে পারেন না।
আরেকটি সমস্যা হলো ফোনে যা দেখি – সেটা আমাদের মাথা ঘামিয়ে তোলে। কেউ সামাজিক মাধ্যমে অন্যের সুন্দর জীবন দেখে হিংসা বা হতাশায় ভোগেন, কেউ কোনো দুঃসংবাদ পড়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, কেউ আবার উত্তেজনাকর বা রোমাঞ্চকর ভিডিও দেখে ঘুমের চিন্তা ভুলে যান। মস্তিষ্ক যখন এসব তথ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন সে শান্ত হয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিতে পারে না। ফলে ঘুম দেরিতে আসে বা অস্বস্তিকর ঘুম হয়।
এই অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ এবং অবসাদের মতো সমস্যা তৈরি করে। ঘুম কম হলে শরীরে ক্লান্তিভাব, মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়, এমনকি স্মৃতিশক্তিও দুর্বল হতে থাকে। অনেকসময় শরীরিক অসুস্থতাও দেখা দেয় — যেমন উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা বা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। কারণ ঘুম ঠিক না হলে শরীর তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলে।
তাছাড়া যারা ছাত্র-ছাত্রী বা চাকরিজীবী, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি চোখে পড়ে। ঘুম ঠিক না হলে সকালে উঠতে কষ্ট হয়, কাজ বা পড়াশোনায় মন বসে না, ভুলভ্রান্তি বেড়ে যায়, আর কাজের দক্ষতাও কমে যায়। এতে দিনশেষে আমরা নিজেরই ক্ষতি করি, অথচ সেটা বোঝা যায় অনেক দেরিতে।
ঘুমানোর আগে ফোন নাড়ার আরেকটি দিক হচ্ছে “নতুন কিছু মিস করে ফেললাম” এই চিন্তা, যাকে বলে FOMO (Fear of Missing Out)। আমরা ভাবি, “আরো একটু দেখি, যদি কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিস হয়ে যায়”, কিন্তু এই চিন্তা আমাদের মনকে বিশ্রাম নিতে দেয় না। ফোন হাতে থাকলে আমরা কখনোই পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে পারি না।
এই সমস্যার সহজ সমাধান হলো, ঘুমানোর অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট আগে ফোনটা এক পাশে রেখে দেওয়া। চাইলে আলাদা একটা জায়গায় চার্জে দিয়ে রাখা যেতে পারে, যাতে ঘুমানোর সময় তা হাতের কাছে না থাকে। বই পড়া, হালকা সংগীত শোনা, কিংবা ধ্যান করার মতো শান্ত কাজ ঘুমের আগে করলে ঘুম সহজে ও ভালো হয়। অনেকে আবার স্ক্রিনের ব্লু লাইট কমিয়ে দেওয়া ফিচার ব্যবহার করেন, তবে ফোন পুরো এড়িয়ে চলাই সবচেয়ে কার্যকর।
সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে আমরা যখন বিশ্রাম নিতে যাই, তখন শরীর ও মস্তিষ্কের সবচেয়ে বেশি দরকার হয় গভীর, নিরবচ্ছিন্ন ঘুম। অথচ ঘুমানোর আগে ফোন নাড়ার মতো একটি অভ্যাস আমাদের সেই প্রয়োজনীয় ঘুম থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত করছে। তাই নিজের ভালো চেয়ে হলেও, এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা এখনই জরুরি। ভাল ঘুম মানেই ভালো সকাল, ভালো মন, আর একটি সুস্থ, সচেতন জীবন।
এম.কে.