
ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ
রান্নায় স্বাদ-গন্ধ বাড়ায়, শরীরে আনে উপকার—জেনে নিন তেজপাতার গুণাগুণ, ব্যবহার ও সতর্কতা: রান্নাঘরের এক পরিচিত উপাদান তেজপাতা। খিচুড়ি হোক বা মাংস, পোলাও হোক বা তেহারি—তেজপাতা ছাড়া যেন স্বাদ ও ঘ্রাণে কিছু একটা অপূর্ণ থেকে যায়। তবে এই পাতাটি শুধু স্বাদ আর গন্ধ বাড়াতেই নয়, এর রয়েছে বহু স্বাস্থ্য উপকারিতা। ভেষজ চিকিৎসা, আয়ুর্বেদ এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রাচীন বইগুলোতে তেজপাতার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
তেজপাতার পরিচয় ও উৎপত্তি
তেজপাতা (Bay Leaf) মূলত Laurus nobilis নামের একটি গাছের পাতা, যা লরেসি (Lauraceae) গোত্রভুক্ত। এটি সাধারণত গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে জন্মে। আমাদের দেশে প্রধানত ভারতীয় প্রজাতির তেজপাতা রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এটি শুকিয়ে ব্যবহার করা হয় এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য।
তেজপাতা দেখতে লম্বাটে, গাঢ় সবুজ, আরেকটু খসখসে ধাঁচের। শুকনো অবস্থায় এটি আরও শক্ত হয়ে যায় এবং রান্নার পর সহজেই আলাদা করা যায়।
তেজপাতার পুষ্টিগুণ ও ওষুধি উপকারিতা
তেজপাতা শুধু রান্নার উপাদান নয়, এতে রয়েছে স্বাস্থ্যরক্ষাকারী নানা উপাদান। এতে রয়েছে:
ভিটামিন এ, সি ও বি৬
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম
ফাইবার এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান
এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, হজমে সাহায্য করতে এবং বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকর।
তেজপাতার ৭টি বিস্ময়কর স্বাস্থ্য উপকারিতা
১. হজম শক্তি বাড়ায়
তেজপাতা হজমে সহায়তা করে এবং গ্যাস, পেট ফাঁপা ও বদহজমের সমস্যা দূর করে। এতে থাকা এনজাইম খাবার ভাঙতে সাহায্য করে।
২. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত পরিমিত তেজপাতা খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হতে পারে।
৩. শ্বাসকষ্ট ও সর্দি-কাশি উপশমে
তেজপাতা দিয়ে বানানো ভাপ বা চা ঠান্ডা, কাশি ও ফ্লু জাতীয় উপসর্গে আরাম দেয়। ব্রঙ্কাইটিস বা শ্বাসনালির প্রদাহে এটি কার্যকর।
৪. রক্তচাপ ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক
তেজপাতায় থাকা ফাইটোকেমিক্যাল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে এবং হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে।
৫. ব্যথানাশক হিসেবে কার্যকর
তেজপাতার তেল বা পেস্ট ব্যবহার করলে পেশির ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা এবং ত্বকের জ্বালাপোড়া উপশম হয়।
৬. চুল ও ত্বকের যত্নে
তেজপাতার রস বা পেস্ট খুশকি দূর করতে এবং মুখের ব্রণ বা র্যাশ কমাতে ভালো কাজ করে।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
তেজপাতার অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
ব্যবহার পদ্ধতি: রান্না থেকে চিকিৎসা পর্যন্ত
রান্নায়:
তেজপাতা সাধারণত গোশত, পোলাও, খিচুড়ি, তেহারি প্রভৃতি খাবারে ব্যবহার করা হয়। রান্নার শুরুতেই ১-২টি পাতা দেওয়া হয়।
তেজপাতার চা:
১ কাপ গরম পানিতে ১টি তেজপাতা, কিছুটা আদা, লবঙ্গ এবং মধু দিয়ে তেজপাতার চা বানিয়ে পান করলে ঠান্ডা ও মাথাব্যথা দূর হয়।
ভাপ নেওয়া:
সর্দি-কাশিতে তেজপাতা ফুটিয়ে তার ভাপ নিলে আরাম পাওয়া যায়।
তেল বা পেস্ট:
তেজপাতা সিদ্ধ করে সেই পানি মাথায় দেওয়া বা পেস্ট করে স্কিনে লাগালে উপকার মেলে।
সতর্কতা: যেভাবে ব্যবহার করবেন নিরাপদে
তেজপাতা রান্নায় ব্যবহারের পর খেয়ে ফেলার দরকার নেই—পাতাগুলো তুলে ফেলে দিন।
অতিরিক্ত তেজপাতা খাওয়া পেটের সমস্যা বা এলার্জির কারণ হতে পারে।
গর্ভবতী নারী ও রক্ত তরলকারী ওষুধ গ্রহণকারীরা তেজপাতা ব্যবহারে সতর্ক থাকবেন।
শিশুদের ক্ষেত্রে তেজপাতার চা বা ভাপ ব্যবহার করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তেজপাতা কেবল রান্নার স্বাদ-গন্ধ বাড়ায় না, এটি একটি প্রাকৃতিক পথ্যও বটে। হজম সমস্যা থেকে শুরু করে ঠান্ডা-কাশি, এমনকি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখতে পারে এই সাধারণ পাতাটি। তবে যেকোনো ভেষজ উপাদানের মতো তেজপাতাও পরিমিতভাবে ও সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করলেই উপকার মেলে।
আজ থেকেই রান্নাঘরের তেজপাতাটিকে শুধু সুগন্ধি নয়, বরং সুস্বাস্থ্যের সাথী হিসেবেও ভাবতে শুরু করুন।
নোভা