
সম্প্রতি পালিত হয়ে গেল আন্তর্জাতিক মে দিবস। শ্রমিক শ্রেণির লড়াই, বঞ্চনার ইতিহাস আর দমনপীড়নের যে ইতিবৃত্ত তা আজও শেষ হয়নি। সেখানে নারী শ্রমিকের লাঞ্ছনার দুঃসহ কাহিনী আরও পীড়াদায়ক। বাংলাদেশের অবস্থাও তেমন ইতিবাচক নয়। প্রথমেই মজুরি বৈষম্যের যে অসহনীয় দুর্বিপাক তাও সমাজ সংস্কারের মর্মমূলে গেঁথে আছে। আধুনিকতার তথ্যপ্রযুক্তির নতুন সময়েও নারীরা সেভাবে সমতার আলোকে ফিরতে না পারাও আর এক কঠিন বাতাবরণ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন নারীদের প্রতি বৈষম্য তেমন দৃষ্টিগোচর হয় না। বরং বিভিন্ন কল-কারখানা কিংবা অবকাঠামো নির্মাণে নারী শ্রমিকের প্রতি যে বিভাজন তা কোনোভাবেই মান্যতাই পায় না। পোশাক শিল্প থেকে, কৃষি কাজে নিয়োজিত নারী, চা বাগান, ঔষধ শিল্প বলতে গেলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শ্রম বিনিয়োগ সংস্থায় সমসংখ্যক নারীর যে মাত্রায় বঞ্চনা আর হেনস্তার শিকার হতে হয় তা যেন বিভাজনের মাত্রাকে নানাভাবে উসকেও দেয়। মে দিবসের তাৎপর্যে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্য গগনে উঠে আসছে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি হরেক শাসন-শোষণের নগ্ন থাবা। তেমন বিদগ্ধ পরিবেশে মূল্যবান শ্রমশক্তি বিনিয়োগে উদায়াস্ত কর্মযোগ সংশ্লিষ্টদের জন্য অস্বস্তিকর এবং চরম অব্যবস্থাপনার করুন আখ্যান। বিভিন্ন যান্ত্রিক কল-কারখানায় নারী শ্রমিকের উপস্থিতি পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। বরং দিনভর কর্মক্লান্ত দুঃসহ সময়ের ঘানি টানাই শুধু নয়, বরং পরিবারও সংসার চালানোর দায়-দায়িত্বও কখনই সামনে আসে না। সারা দিনের শ্রমঘণ্টা হিসেবে নারীরাই অত্যধিক কাজকর্মে নিবেদিত হওয়ার ইতিবৃত্ত যুগ-যুগান্তরের। বাংলাদেশের সিংহভাগ নারী শ্রমিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। সঙ্গতকারণে তারা তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনি বিধান পর্যন্ত জানে না। মজুরি কম পেলে মনে করে পুরুষরা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী তাদের তো শ্রম মজুরি বেশি পাওয়াই ন্যায্যতা। কিন্তু নারী শ্রমিকের পেশাগত অবস্থানকে বাদ দিলেও গৃহশ্রমে যে দায়িত্ব পালন করতে হয় তা কখনোই হিসেবের মধ্যেই আসে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে অধিকার আর মজুরির ব্যাপারে কোনো বৈষম্য তৈরি করা হয়নি। সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি সেটাও আইনি বিধানে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে। তার ওপর কাউকে না কাউকে কোলের সন্তান নিয়ে তার কারখানার দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোরও ফুরসত থাকে না। তবে শ্রম আইনে কিছু বিধি উল্লেখ করা আছে। নারী শ্রমিকের জন্য বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকাও বাঞ্ছনীয়। বিশে^র বহু উন্নত দেশে তেমন প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালু করা হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই। এক অমানবিক, দূষণ পরিবেশে শিশু সন্তানকে স্নেহ মায়া মমতা দিয়ে বড় করলেও যথার্থ সুস্থ আবহ বাচ্চার জন্য দিতে না পারা এক অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। শুধু কি শ্রম আইন? এছাড়াও রয়েছে নারীর জন্য আলাদা এক সনদ সিডিও সব ধরনের বৈষম্য নিরোধক আইনের যথার্থ রূপরেখা। বাস্তব প্রেক্ষাপটে তেমন দৃশ্য কবে যে সংশ্লিষ্টদের জীবন মানে এগিয়ে আসবে? সেটা আর কত দূর? ভাবনায়ও আসে না। দেশের সংবিধানও আইনি দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের ফারাক দৃশ্যমান নয়। কিন্তু সমাজ সংস্কারের কাঠামোর গভীরে যে চিরায়ত বিধি-নিয়ম গেঁথে থাকে সেখান থেকেই তৈরি হয় যোজন যোজন ফারাক। এমনিতেই শারীরিকভাবে শ্রম বিনিয়োগকারী মানুষরা উদয়াস্ত খাটাখাটনীয় যে অস্বস্তিকর পরিবেশে ৮-১০ ঘণ্টা কাটায় তাও মানবেতর এক অসহিষ্ণু বাতাবরণ। তার ওপর নারীদের যে বিভাজনের অপঘাত সেটাও কোনো যৌক্তিক নিয়মে আসেই না। সংবিধানে জাতীয় জীবনে সার্বিক কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ফারাকের কোনো নির্দেশনা নেই বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, আইন কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন বারবার। তাছাড়া নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সুরক্ষার দায়-দায়িত্ব অতি অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সেখানে নারী শ্রমিকরা কতভাবে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা আর হেনস্তার শিকার হচ্ছেন তাও গণমাধ্যমের পাতা ভারী হতে সময় লাগে না। আমাদের দেশে মূলত নারী-পুরুষ কোনো শ্রমিকই সুস্থ পরিবেশ, ন্যায্য পাওনা এবং স্বস্তিকর অবস্থায় শ্রম বিনিয়োগ করতে বারবার হোঁচট খাবার করুন আখ্যান নতুন কিছু নয়। শিল্পবিপ্লবের আগে যে দাস কিংবা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ছিল যাকে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো হয় সেখানে নারীদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয় মানবতা বিবর্জিত। তাই সমাজের নিম্নবিত্তের শ্রমিক নারী পুরুষ যেই হোক না কেন অধিকার, স্বাধীনতা, আইনি বিধান কিংবা বেতন ভাতায় যে লাগাতর দুর্ভোগ তা সভ্যতা সূর্য অস্তমিত হবার উপক্রম।
সেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নারীদের অবস্থা ততোধিক দুর্বিষহ বলে জানা যায় বিভিন্ন পণ্ডিতের সত্যকথন লেখনীতে। তাই শ্রম দিবসের তাৎপর্য শুধু দিন উদযাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সারা বছরের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সূর্য উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত যে মাত্রায় শারীরিক ধকলে ক্লান্ত, শ্রান্ত হয় তার দাম সত্যিই অমূল্য। আধুনিকতার নবযুগেও তেমন শ্রম বিনিয়োগের কোনো বিরাম-বিরতি নেই। আছে সেই পুরাকাল থেকে ঘানি টানা শ্রমের চরম অপমান, অসম্মান। নারীদের বেলায় তা হয়েছে আরও বেদনাবিধুর, লোমহর্ষক আর মানবতা বিবর্জিত এক চরম দাবানল। তবে নারী শ্রমিকরাও এখন যথেষ্ট সচেতন, সাবধানতায় তাদের যথার্থ কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি আর সুস্থ কর্ম পরিবেশের দাবিতে প্রতিবাদমুখর হচ্ছেন। যাদের মূল্যবান শ্রমের বিনিময়ে সারাদেশের কর্মযোগের সর্ববৃহৎ আঙিনা এগিয়ে যান সেখানে যদি সমতা, ন্যায্যতা আর স্বাভাবিক নিয়মনীতি পরাভূত হয় তা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলবার্তা নিয়ে আসে না। প্রতি বছর ১ মে কে সামনে রেখে নতুন করে শপথ, অঙ্গীকার নিয়ে আসা হয় মজুরি বৈষম্য থেকে আঁচড় লাগানো বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের বৃহৎ পরিসরে। তারপরও আজ অবধি তেমন বৈষম্য সংকট, নির্যাতন কেন ঠেকানো যাচ্ছে না সে প্রশ্নের উত্তর অজানা এক বিস্ময়। সময় অসময়ে নারী শ্রমিকরাও তাদের জোরালো দাবিতে সড়ক, মহাসড়ক অবরোধ, সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়া অবহিতভাবে চলেছে। সহজে তা ঘোচারও নয়। নির্দিষ্ট সুসংবদ্ধ আইনি পরিকল্পনা জরুরি বলেও আওয়াজ তোলা হচ্ছে।
অপরাজিতা প্রতিবেদক
প্যানেল