
কখনও কি এমন হয়েছে রাত একটায় ঘুম না এসে আপনি মোবাইলে গুগল করছেন, ‘‘গলা ব্যথা কেন হয়’’ বা ‘‘বুক ধরফড় করছে কেন’’? একটা ছোট উপসর্গ থেকেই শুরু, এরপর একের পর এক ভয়ঙ্কর রোগের নাম পড়তে পড়তে আপনি পড়ে যাচ্ছেন আতঙ্কের গভীরে।
আমরাও অনেকেই এমনটা করেছি। এবং সত্যি কথা বলতে কী এর ফল খুব একটা আশাব্যঞ্জক হয় না। বরং উল্টো, মন আরও অস্থির হয়ে ওঠে। বাড়ে উৎকণ্ঠা, মাথার ভেতর ভয় গেঁথে বসে, মন হয়ে যায় ভারাক্রান্ত।কেন আমরা এমন করি? কেন ভয়াবহ সব তথ্যে মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে? স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন এই আচরণের পেছনে রয়েছে গভীর মানসিক ও স্নায়বিক ব্যাখ্যা।
১. উপসর্গ খুঁজতে গিয়ে বাড়ে দুশ্চিন্তা
সবচেয়ে সাধারণ ফল চোখে পড়ার মতো ভাবে বেড়ে যায় আমাদের উদ্বেগ। আপনি যখন বারবার গুগলে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য খুঁজছেন, তখন মস্তিষ্ক যেন শূন্য থেকে সোজা ষাটে পৌঁছে যায়!এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তাদের ক্ষেত্রে উপসর্গ গুগল করলে উদ্বেগ আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। আপনি হয়তো ‘সর্দি কেন হয়’ খুঁজতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ক্যানসার রোগী মনে করতে শুরু করেছেন।
২. এই খোঁজ মন খারাপের দিকেও ঠেলে দেয়
শুধু দুশ্চিন্তা নয়, অনেক সময় এই অনবরত খোঁজাখুঁজি আমাদের মনটাকেও বিষণ্ণ করে তোলে। একবার নিজেকে নিয়ে ভয় পেয়ে শুরু করলে, তার শেষে হতাশা এসে ভর করে। যেন কিছুই ঠিকঠাক নয়, সব কেমন একটা অন্ধকার।PubMed-এর একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত উপসর্গ গুগল করেন, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা (ডিপ্রেশন) বাড়ে। মানসিক শক্তি নিঃশেষ হতে হতে একটা সময় আসে, যখন মনে হয় কিছুই ঠিক হবে না। এই অবস্থা থেকে উঠে আসা খুব কঠিন হয়।
৩. ‘সাইবারকন্ড্রিয়া’: গুগল-ভিত্তিক আতঙ্কের শৃঙ্খল
‘সাইবারকন্ড্রিয়া’ এই শব্দটা শুনে প্রথমে মনে হতে পারে, নতুন কোনও ফ্যাশনেবল টার্ম। কিন্তু আপনি যদি নিয়মিত উপসর্গ গুগল করে করে নিজেকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছেন, তাহলে আপনি ঠিক এই সমস্যার মধ্যেই আছেন।গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে ঘন ঘন উপসর্গ খোঁজার অভ্যাস আমাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়, উদ্বেগ বাড়ায় এবং এক ধরনের জড়তা তৈরি করে। এমনও হয়, আপনি ভাবছেন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবেন না, অফিসে যাবেন না, কারণ যদি হঠাৎ ‘আরও খারাপ কিছু’ ধরা পড়ে! এই চিন্তা থেকে জন্ম নেয় আত্মগ্লানি‘‘-আমি কেন নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না?’’
৪. আপনার মস্তিষ্কের গঠনেও হতে পারে পরিবর্তন!
সবচেয়ে চমকে দেওয়া তথ্য: গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য-ভয় নিয়ে থাকেন, তাদের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে শারীরিক পরিবর্তন পর্যন্ত দেখা যেতে পারে!ইমেজিং স্টাডিতে দেখা গেছে, তাদের ‘প্রিকুনিয়াস’ অংশের ধূসর পদার্থ (গ্রে ম্যাটার) কমে যায় এবং মস্তিষ্কের দেখার ক্ষমতাসংক্রান্ত অংশগুলোর সংযোগ এলোমেলো হয়ে যায়। মানে, উদ্বেগ শুধু মনের ভেতর না, সেটা আপনার ব্রেনকেও শারীরিকভাবে প্রভাবিত করছে।
৫. অনিশ্চয়তা: যেটা আমাদের মস্তিষ্ক একদম সহ্য করতে পারে না
আমরা নিশ্চিত হতে চাই। যে কোনও দোদুল্যমান অবস্থা ‘‘হয়তো ঠিক আছে, আবার হয়তো নয়’’ এই ‘হয়তো’ শব্দটাই আমাদের অসহ্য লাগে। ফলে আমরা গুগল করতে থাকি, নিশ্চিত উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মাথা গুলিয়ে ফেলি।
গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের অ্যান্টেরিয়র সিঙ্গুলেট কর্টেক্স যেটা আমাদের ‘ভেতরের এলার্ম’ হিসেবে কাজ করে অনিশ্চিত তথ্য দেখলেই আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। গুগলে যেসব তথ্য আসে, সেগুলো বেশিরভাগই অস্পষ্ট, সন্দেহজনক, একাধিক সম্ভাবনা-ভিত্তিক। ফলে মাথা শান্ত হয় না, বরং আরও বিভ্রান্ত হয়।
৬. ডোপামিন আমাদের আটকে রাখে এই সার্চ চক্রে
আপনি জানেন, এটা আপনাকে ভালো করছে না। তবু আপনি খুঁজতেই থাকেন। কেন? কারণ এর পেছনে আছে ডোপামিন।ডোপামিন এমন একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যেটা আমাদের ‘‘খুঁজে যাও, আরও খুঁজো’’ এই বার্তা দিয়ে যায়। আপনি যখন একটা নতুন তথ্য পান, তখন ডোপামিন সামান্য আনন্দ দেয়। ফলে আপনি ভাবেন, ‘‘এবার বুঝি বুঝতে পারলাম!’’ কিন্তু সেটা হয় না, তাই আবার আরেকটা লিঙ্ক খোলেন। এই চক্র কখনই থামে না।
তাহলে আমরা কেন এতটা নিশ্চয়তা চাই?
একটা বিষয় খেয়াল করেছেন? খারাপ খবর হলেও অনেক সময় আমরা বলি, ‘‘যদি নিশ্চিতভাবে জানতাম, তাহলে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারতাম।’’আমাদের মস্তিষ্ক ‘হয়তো’ শব্দটা সহ্য করতে পারে না। তাই যতক্ষণ না নিশ্চিত তথ্য মেলে, ততক্ষণ গুগল করা ছাড়তে পারি না। অথচ সেই নির্দিষ্ট উত্তর আসেও না।
এই চক্র ভাঙা সম্ভব,কীভাবে?
এই অসুস্থ গুগল-চক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব। কিছু ছোট পরিবর্তন আমাদের সাহায্য করতে পারে:
সময়সীমা নির্ধারণ করুন: গুগল করবেন, ঠিক আছে। কিন্তু সেটা ১০ বা ১৫ মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখুন। এরপর নিজেকে বাধ্য করুন থামাতে।
প্রকৃত বিশেষজ্ঞের কাছে যান: সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বাস্তব কথোপকথন সব সময় ওয়েবসাইট পড়ার চেয়ে বেশি আশ্বস্ত করতে পারে।
নিজেকে দোষ দেবেন না: আপনি যদি উদ্বিগ্ন হন, সেটা দুর্বলতা নয়। বরং স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া।
মনে শান্তি আনতে কাজ করুন: গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, ধ্যান, হাঁটাহাঁটি এসব আপনাকে এই উদ্বেগচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে।
তথ্য খুঁজুন, আতঙ্ক নয়: যদি দেখেন, আপনাকে ডাক্তার দেখাতে হবে তাহলে সেটা করুন। তারপর আর খুঁজে বেড়াবেন না।
স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন থাকা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু গুগল করে করে যদি মনটা আরও বিভ্রান্ত হয়, তাহলে নিজেকে একটু থামান।আপনার দেহের সংকেত বোঝার চেষ্টা করাটাই প্রাথমিক কাজ। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি আপনি ভয়, হতাশা আর অনিশ্চয়তার জালে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে সময় এসেছে বাস্তবিক উপায়ে সমাধান খোঁজার।
সূত্র:https://tinyurl.com/y2f8mtrf
আফরোজা