ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

কবি দাউদ হায়দারের চির নির্বাসন

মাসুদ মুস্তাফিজ

প্রকাশিত: ১৭:১৭, ৮ মে ২০২৫

কবি দাউদ হায়দারের চির নির্বাসন

‘এক নির্বাসন থেকে আরেক নির্বাসন, হয়তো কবির-ই জীবন কিংবা আমার-/- যে আনন্দ নিয়ে জন্মেছিলাম, আমার দেশ দেয়নি ফিরিয়ে সে-প্রতিশ্রুতি/-হে দেশ, তোমাকে ছেড়ে যতদূরেই যাই, তুমি আছো সর্বাঙ্গে জীবনে-সজল-অক্ষিলতায়’(১৪.৯.৮৭, বার্লিন)
কবি দাউদ হায়দারের দীর্ঘ জীবন ও সময়ের জার্নির অবসান ঘটল। তিনি বিশ^বাংলা কবিতার এক পরিব্রাজক। একাধারে কবি, সাংবাদিক, অনুবাদক- প্রায় ২৫টির বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’, ‘নারকীয় ভুবনের কবিতা’, ‘যে দেশে সবাই অন্ধ’, ‘ধূসর গোধূলি ধুলিময়’, ‘আমি ভালো আছি, তুমি?’ প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আরও রয়েছে- ‘নির্বাসিত’, ‘সংগস অভ ডেস্পায়ার’, ‘এই শাওনে এই পরবাসে’, ‘বানিশম্যান্ট’, ‘আমি পুড়েছি জ্বালা ও আগুনে’, ‘এলেন ইন ডার্কনেস অ্যান্ড আদার পোয়েমস’, ‘হোল্ডিং অ্যান আফটারনুন অ্যান্ড আ লিথ্যান ফায়ার আর্ম,’ ‘অবসিডিয়ান’। কবিতা লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। দাউদ হায়দারের কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনা, নির্বাসনের কষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, দ্রোহ এবং মানবতাবাদী চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। দীর্ঘসময় বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় সাহসী উচ্চারণে কলাম লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পান।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর দাউদ হায়দারই প্রথম লেখক যাঁকে লেখালেখির কারণে নির্বাসনে যেতে হয়। এর আগে বাংলাদেশ সরকার কবিতা লেখার দায়ে তাকে ৫ বছর জেল দেন- কারাগারে তখনকার গণকণ্ঠ সম্পাদক, জাসদ নেতা আ স ম রব, এম এ জলিল এবং কবি আল মাহমুদের সঙ্গে মোলাকাত, আলাপের বর্ণনাও উঠে আসে কবির আত্মজীবনীতে। ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ লেখার অপরাধে ঐ বছরে ১১ মার্চ কবি গ্রেপ্তার হন। কবিতাটি প্রকাশিত হবার পরদিনই শুরু হয় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মিছিল। মূলত তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) কে অবমাননা করেছেন। জানা যায়  তিনি এই কবিতার জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে দাউদ হায়দার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। পরীক্ষায় অংশ গ্রহণকালে ভাইভা বোর্ড তাঁকে প্রশ্ন করে- ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ এটা কার কবিতা? তিনি হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন: আমার কবিতা, উত্তর শুনে বোর্ডের শিক্ষকরা প্রথমে অবাক হয়েছিলেন, কী করে এমন একটি কবিতা এ বয়সের কোনো যুবক লিখতে পারে! পরে অবশ্য তার আগের কিছু লেখা দেখে তাঁর প্রতিভা বুঝতে পারে।
‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ এ কবি লেখেন- ‘আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ/ আহা দুঃখ/ দুঃখরে!/ আমি পাপি বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। কবিকে কারাভোগ করতে হয় ছাত্রজীবনেই । নির্বাসনের প্রথমে আশ্রয় নেন কলকাতায়।   অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। তিনি ১৩ বছর কলকাতা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৮৫ সালে পেন আমেরিকান সেন্টারের ২০০০ লেখকের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লেখা হয় যাতে দাউদ হায়দারকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের চাপের কারণে বারবার তা ভেস্তে যায় । তার অনেক পরে নোবেল লরিয়েট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস নির্বাসিত কবিকে আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
 ১৯৮৬ সালের ২২ জুলাই জার্মানি এসে পৌঁছান। তখন থেকেই তিনি জার্মানির বার্লিন শহরে বসবাস করেছেন। এই সময়ে তিনি আর কখনই দেশে যেতে পারেননি। তারপর ১৯৮৬ নোবেল বিজয়ী গুন্টার গ্রাসে জার্মানির বার্লিনে চলে যান। লন্ডনে বসবাসকালে দুঃখ পরিতাপ নিয়ে কবি কবিতা লেখেন: সব-হারানোর দেশগাঁও-‘আজ লন্ডন প্যারিস, পরশু ভিয়েনা হয়ে বার্লিন/-একেই কী বলে ফেরা?/ দেশ এখন জলে ভাসছে, জলস্রোতে ভেসে যায় দেশ, প্রতিদিন/ মৃত্যুর খবর; -লেখেন অগ্রজ; চিঠি জলে ভেজা, ছেঁড়া/ভাসমান একটি জাতির কথা বলছিলাম/যতদূর দেখি, আশ্রয় নেই কোথাও/-আসমুদ্র হিমাচল ঢেকে দেব শব?- তোমাকে দিলাম/ সব-হারানোর দেশগাঁও’ (২০.৮.৮৮ লন্ডন) কবির কবিতায় চিন্তায়-মননে বাস করতো বাংলাদেশ। যে কারণে বারবার তাঁর কণ্ঠে দেশে ফেরার আকুতি উচ্চারিত হয়- চলে যাচ্ছি, ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছি /চলে যাচ্ছি, কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি /চলে যাচ্ছি, নাগরিক ভূমার অসুস্থ পাগলামি ছেড়ে/বিবিক্ত উল্লাসে, সংবেদনে /- চলে যাচ্ছি, যেখানে আমিই আমার একাকী বেদনা (চলে যাচ্ছি, ২.৭.৮৭ কলকাতা) তিনি অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন, স¦প্ন দেখেছেন একদিন দেশে ফিরবেন। বিতর্কের অবসান শেষে দেশের মুক্ত চিন্তার উদয় হবে। তাই তিনি ‘যদি ফেরাও’ কবিতায় দেশে ফেরার গভীর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন- ‘যদি ফেরাও আমি আবার ফিরে যাবো; দূরের আকাশ /সূর্যত্ব প্রাপ্ত হবে, পাখিদের গান উঠবে রণিয়ে /স্বজাতি চিনবে আমাকে, আমার বাংলাদেশ।’ (২৬.১২.৭৭) জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় পার করেন পরবাসে। কিন্তু নির্বাসিত থাকার পরও ভোলেনি প্রিয় মাতৃভূমিকে। সুদূর জার্মানির বার্লিন থেকে লেখা আত্মজীবনী উৎসর্গ করেছেন দেশকে। দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশী বাঙালি কবি, লেখক ও সাংবাদিক। তিনি সত্তর দশকের আধুনিক কবি হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত।
১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের কোনো এক কবিতাকে ‘দ্য বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া’ সম্মানে ভূষিত করেছিল। প্রথাবিরোধী হিসেবে খ্যাত কবি দাউদ হায়দারের জার্নিতে পরিবার, বাংলাাদেশ ও বাংলা সাহিত্যের অবদানের কোনো জুড়ি নেই। তাঁরা সবাই সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িত। কবির মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তোলে-বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তোলে। তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ ভূখণ্ডটির মানুষের অধিকারহীনতা আর শাসকদের দুঃশাসনের নির্মম সত্যব্যঞ্জনা। কবি তাঁর নিজ নামে কবিতায় দেশান্তরী হবার গভীর বেদনাময় উচ্চারণ উঠে আসে বেদনার্ত অনুপ্রাসে- ‘একদা, পাথরে সে পদ্ম ফোটাতে চেয়েছিল- /গ্রীষ্মের দিনে আমাকে ক্রমশ; টেনেছিল কাছে। পিছুটান না রেখে / আমি সৌজন্যবশত গিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম/ রক্তজবায় ভরে যাক যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ।/ একদা সে, অগ্নিকাণ্ডে মাথা গেয়েছিল; ‘ভালোবাসা’। /কামানের মুখ চুম্মন করে বলেছিল: মৃত্যুই জীবনে একমাত্র সৌন্দর্য।’ (কবিতার শিরোনাম- দাউদ হায়দার ৪.৮.৭৮, আমি পুড়ছি জল ও আগুনে)। আমাদের প্রিয় বহুমাত্রিক প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদেরও মৃত্যু হয় প্রবাস জার্মানিতে। সেও ছিল করুণ এক মৃত্যু।
দাউদ হায়দারেরও মৃত্যু হলো জার্মানিতেই। মাত্র ২২ বছর বয়সে তাঁকে দেশান্তরী হতে হয়। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ লেখে তিনি পান ব্যাপক খ্যাতি এবং বিড়ম্বনাও। কবি দাউদ হায়দারের সাথে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কথা বলার- যোগাযোগ হয়েছে অসংখ্যবার বন্ধু জোবায়েন সন্ধির সৌজন্যে। ৭৩ বছর বয়সে কবি চলে গেলেন জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে। এই মহাঅন্তিম যাত্রার ভেতর কবির নির্বাসন শেষ হলো- বিদায় হে কবি তোমার আত্মার শান্তি হোক- তোমাকে শ্রদ্ধা!

প্যানেল

×